জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : শাহজাদপুর উত্তর বাড্ডা
আমাদের দেশটা দীর্ঘ সময় ধরে অরাজকতা ও জুলুমের মধ্য দিয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ গত ৫ আগস্ট আমরা আওয়ামী জুলুম থেকে মুক্তি পেয়েছি তার জন্য মহান আল্লাহ পাকের কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। আমাদের এই জুলুমের হাত থেকে রক্ষা করতে যে সমস্ত মানুষ নিহত হয়েছে তাদের অবদান আমরা কখনো ভুলব না। শহীদ মো: নাইমুর রহমানের মতো অকুতোভয় সাহসী যুবকদের জন্যই আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করতে পারছি। নাইমুর রহমানের মতো হাজারো যুবক তাদের তাজা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে স্বৈরশাসকের পতনের মাধ্যমে এ দেশ থেকে বৈষম্য দূর করেছে। দীর্ঘদিন জুলুম নির্যাতন আর বৈষম্যের ভিতরে বাংলাদেশের মানুষ অতিষ্ট হয়ে পড়েছিল। অত্যাচার নির্যাতন আর বৈষম্য দেখে বাংলাদেশের ছাত্র জনতাসহ সকল মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা এবং সাধারণ মানুষ আর বিরোধী দলগুলো আন্দোলনে রাজপথে নামে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মতো তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য শপথ গ্রহণ করে। অবশেষে ৫ আগস্ট ২০২৪ এদেশের গণহত্যাকারী শাসক আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকবার স্বাধীনতার নাম লিখিত হয়। প্রাথমিক পরিচিতি বাপ মায়ের ভিটে মাদারীপুরে হলেও নাইমুর জন্মসূত্রে ঢাকার ছেলে। ২০০৩ সালের প্রথম দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি পিতা মো: খলিলুর রহমান এবং মাতা মোছাঃ নাসিমা খাতুনের মুখ উজ্বল করে জন্ম নেয় নাইমুর রহমান। তিনি তার আচরণে সৎ ছিলেন। তার অশ্রুসিক্ত চোখ সততাকে নির্দেশ করে এবং তার সম্পূর্ণ লক্ষ্য ছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য। তিনি সর্বদা পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করতেন। তিনি তার পিতাকে সম্মান করতেন এবং তার মায়ের প্রতি স্নেহশীল ছিলেন। নাঈমুর ছোটকাল থেকেই অনেক মেধাবী ছিলেন। প্রাইমারি স্কুলে এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অনেকগুলো সম্মানজনক পুরস্কার অর্জন করেছেন। কলেজের পড়ালেখার পাশাপাশি তেজগাঁও এলাকার নর্থ ইন্ড কফি রেস্তোরাঁয় পার্টটাইম কাজ করতেন। পড়ালেখার খরচ জুগিয়ে সংসারে বাবাকে সহায়তাও করতেন। সরকারি বড় কোনো ব্যাংকে চাকরি করবে এই আশায় ভালো সাবজেক্ট নিয়ে গুলশান কমার্স কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু যত ভালো বিষয়ই হোক আর যত বড় কলেজই হোক না কেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে কোনো লাভ নেই। কারণ কোটার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে নিজেদের মনঃপুত ব্যক্তিদের ছাড়া চাকরি সাধারণ ছাত্রদের ভাগ্যে হবে না। নাঈমুর রহমান এই চক্রান্তকে নস্যাৎ করার জন্য বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। অবশেষে সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগের চক্রান্ত ঠিকই নস্যাৎ হয়। সাথে সাথে নাইমুরও দুনিয়ার সফর শেষ করেন। শহীদ নাইমুর রহমানের শাহাদত সম্পর্কে সামগ্রিক বর্ণনা মায়ের শত বাধা উপেক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন রাজধানীর গুলশান কমার্স কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী মো: নাইমুর রহমান। প্রতিদিনই বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মাকে বলতেন স্বৈরাচারের পতন হবেই। সেই পতন ঠিকই হলো তবে দেখে যেতে পারলেন না নাইমুর। স্বৈরাচারের দোসরদের বুলেটে প্রাণ দিলেন তিনি। হাসপাতালের মর্গে নাইমুরের মা আট থেকে দশটি লাশ সরিয়ে ছেলের লাশ খুঁজে পান। এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজন ও এলাকাবাসী। স্বজনরা জানান, ১৯ জুলাই বিকালে নাইমুরের ফোন থেকে কল আসে বাবা মো: খলিলুর রহমানের ফোনে। সেই কলেই জানতে পারেন রাজধানীর উত্তর বাড্ডার এ এম জেড হাসপাতালে আছে নাইমুরের গুলিবিদ্ধ লাশ। গুলশান কমার্স কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন নাইমুর। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় তিনি। পড়ালেখার পাশাপাশি তেজগাঁও এলাকার নর্থ ইন্ড কফি রেস্তোরাঁয় পার্টটাইম কাজ করতেন। পড়ালেখার খরচ জুগিয়ে সংসারে বাবাকে সহায়তাও করতেন। রাজধানীর গুলশান থানাধীন কালাচাঁদপুর পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা মো: খলিলুর রহমানের বড় ছেলে তিনি। খলিলুর প্রাইভেটকার চালক হিসেবে কাজ করে সংসার চালান। কালাচাঁদপুর পশ্চিমপাড়ার পাকা মসজিদ সংলগ্ন দুই রুমের ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকেন নাইমুরের পরিবার। শহীদের পিতা জানান, ২২ হাজার টাকা বেতনে তিনি সংসার চালান। নাইমুর ছিল তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। পড়ালেখা শেষ করে সংসারের হাল ধরবেন এমন আশা ছিল বাবা খলিলের। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন নাইমুর। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর উত্তর বাড্ডা বাজার সংলগ্ন প্রধান সড়কে পুলিশের গুলিতে মারা যান। বুকের মাঝখানে গুলিবিদ্ধ হন নাইমুর। তার মুখ দিয়ে প্রচুর রক্ত বের হয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। ১৯ জুলাই বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে গুলিবিদ্ধ হন নাইমুর। তিনি বলেন, “আমার ছেলের মোবাইল থেকে একটি ফোন আসে। আমার কাছে জানতে চায় আমি সম্পর্কে নাইমুরের কী হই?’ আমি বললাম, ‘আমার ছেলে।’ তখন ওপাশ থেকে বলে আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। উত্তর বাড্ডার এ এম জেড হাসপাতালে আসেন। আমি সাথে সাথেই দুই ছেলে, স্ত্রী ও এক ভাগিনাকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলাম। যাওয়ার পথে রাস্তায় প্রচণ্ড গুলির শব্দ আর কাঁদানে গ্যাস দেখতে পাই।” জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হয়ে অবশেষে হাসপাতালে পৌঁছালাম। হাসপাতালের লাশঘরে আট থেকে দশটি লাশ ছিল। এর মধ্য থেকে নাইমুরের লাশ শনাক্ত করে তার মা। সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। পরিবারের অন্যরাও লাশ জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তিনি বলেন, “হাসপাতালের লোক তখন বলে, “এখানে পরিস্থিতি খারাপ। লাশ বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। আপনারা লাশ নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।” হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স চাইলে দেয়নি। পরে অটোরিকশায় করে হাতের ওপর লাশ নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওয়ানা হই। বাসায় আসার পথে নতুন বাজার এলাকায় এলে প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে পড়ি আমরা। কোকাকোলা ব্রিজের ওখানে এলে আমার ছোট ছেলে মাইবুর রহমান আর ভাগিনার রিকশাটি আটকে দেয় পুলিশ। রিকশা থেকে নামিয়ে দেয় তাদের। তখন আমার ছোট ছেলে ভয়ে প্রচণ্ড কান্নাকাটি করে। ওর বয়স মাত্র ৮ বছর। পরে বারিধারার ভেতর দিয়ে চলে আসে তারা। তবে আমি ও আমার স্ত্রী ছেলের লাশ নিয়ে কোকাকোলা মোড়ে এলে আন্দোলনকারী ছাত্ররা আমাদের রাস্তা পার করে দেয়। তখন সোয়া ৬টা বাজে। মারামারি চলছিল পুরো এলাকায়। আমার মেজো ছেলের পায়ের ওপর নাইমুরের লাশ ছিল। নদ্দা এলাকায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আমার মেজো ছেলে সাইমুর রহমানের হাতে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে। অনেক কষ্টে লাশ নিয়ে প্রথমে কালাচাঁদপুরের বাসায় আসি। এরপর সেখানে জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর সদর থানার খোয়াজপুর ইউনিয়নের মঠেরবাজার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করি।” (নানাদের এলাকা) খলিলুর রহমান বলেন, আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। মামলার এক নম্বর আসামি করা হবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী,পুলিশের সাবেক আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিপি, ডিএমপির সাবেক কমিশনারসহ পুলিশের বেশ কয়েকজনকে। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই “ শহীদের বন্ধু এহতেশাম বিল্লাহ সিয়াম বলেন: “শহীদ নাইমুরের সাথে আমার ক্লাস টু থেকে পরিচয়। সেই থেকে আমাদের দীর্ঘ ১২ বছরের বন্ধুত্ব। সে একজন ভদ্র, নম্র ও বিনয়ী মানুষ ছিল। নিয়মিত নামাজ পড়ত। পরোপকারী ও মিশুক প্রকৃতির ছিল। এই আন্দোলনে শুরু থেকেই সক্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে শহীদ নাইমুর রহমান। আমি আমার বন্ধুর হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করছি এবং হুকুমদাতা-সহ হত্যাকান্ডে জড়িত প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রত্যাশা করছি।” এক নজরে শহীদ নাইমুর রহমান পূর্ণাঙ্গ নাম : মো: নাইমুর রহমান পিতা : মো: খলিলুর রহমান মাতা : মোছা: নাসিমা খাতুন জন্ম তারিখ : ০১-০১-২০০৩ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মুন্সীকান্দি, ইউনিয়ন :ভান্ডারিকান্দি , থানা:শিবচর, জেলা: মাদারীপুর বর্তমান ঠিকানা : বাসা ক-৭৫/২, কালাচাঁদপুর, গুলশান, ঢাকা শিক্ষাগত যোগ্যতা : গুলশান কমার্স কলেজ, অনার্স প্রথম বর্ষ, একাউন্টিং বৈবাহিক অবস্থা : অবিবাহিত পরিবারের সদস্যদের পরিচয় পিতা : মো: খলিলুর রহমান (৪৪) পেশায় কার ড্রাইভার মাতা : মোছা: নাসিমা খাতুন (৩৮) গৃহিণী ভাই বোন : ২ ভাই বোন নেই ১. সাইমুর রহমান(১৮) নবম শ্রেণির ছাত্র, কালাচাঁদ উচ্চ বিদ্যালয় ঢাকা ২. মাইবুর রহমান (৮) দ্বিতীয় শ্রেণি, কনফিডেন্স স্কুল ঢাকা আক্রমণের স্থান ও সময় : শাহজাদপুর (উত্তর বাড্ডা) ১৯-০৭-২০২৪ বিকাল ৪:৩০ শাহাদাতের সময় : শাহজাদপুর (উত্তর বাড্ডা) ১৯-০৭-২০২৪ বিকাল ৪:৩০ আক্রমণকারী : সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ এবং পুলিশ গুলি করার নির্দেশদাতা : শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাবেক সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ আরো অনেকে জানাজা : ১ম জানাজা: ১৯-০৭-২০২৪, ঢাকা কালাচাঁদপুর, সন্ধ্যায় : ২য় জানাজা: ২০-০৭-২০২৪, শিবচর, মাদারীপুর (গ্রামের বাড়ি), সকালে দাফন : মাদারীপুর খুজপুর মটের বাজার কবরস্থান