জন্ম তারিখ: ১ নভেম্বর, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ময়মনসিংহ
পেশা: ছাত্র, ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজ শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল -ঢামেক
শহীদ শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন ময়মনসিংহের কুমড়াশাসন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামে সকলের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। বন্ধু-পাড়া-প্রতিবেশি সকলের সাথে ছিল তার সৌহার্দ্য পূর্ণ সম্পর্ক। তার মৃত্যুর পর এলাকাবাসী ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় শহীদ শাহরিয়ার চত্ত্বর নামে একটি সড়কের নাম ঘোষণা করেন। বাবার চাকরির সুবাদে অনেক সময় ঢাকাতেও থাকতেন শহীদ শাহরিয়ার। রাজধানীর কুড়িল কুড়াতলী বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন তার পরিবার। ঈশ্বরগঞ্জ পৌর এলাকার আইডিয়াল কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে ২০২৪ সালের চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। পাঁচটি পরীক্ষা শেষ হলেও বাকি পরীক্ষাগুলোয় তিনি আর উপস্থিত হতে পারেননি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে পরীক্ষা বন্ধ হওয়ায় ১০ জুলাই ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন। এরপর ঢাকাতেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। শহীদের ৮ বছর বয়সি একটি ছোটো বোন আছে। ২য় শ্রেণিতে পড়াশুনা করা শেখ মুমতাহিনা বিনতে মতিন-ই এখন তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। শহীদের পরিবার আর্থিকভাবে মোটামুটি স্বচ্ছল ছিলেন। তার বাবা ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে চাকরি করতেন। বর্তমানে মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায় চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। তার মা হবিগঞ্জ শাহজালাল সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু আওয়ামী সরকার দলীয় স্থানীয় এমপির রোষানলে পড়ে ২০১৬ সালে তিনি চাকরি হারান। বর্তমানে কর্মহীন হয়ে তার বাবা এবং মা বাড়িতে অবস্থান করছেন। ঘটনার বিবরণ শহীদ শাহরিয়ার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের জন্য পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। অবসর সময়ের জন্য ঢাকায় মায়ের কাছে যায় সে। পরে মিরপুর ২ নম্বরে খালার বাসায় বেড়াতে যায়। সেখানে খালাতো ভাই বাদলের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেয়। ১৮ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বরের গোলচত্বরের কাছে গুলিবিদ্ধ হয় শাহরিয়ার। সেদিন বাদলও গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। একপাশে ছিল আন্দোলনকারীরা, অপর পাশে ঘাতক পুলিশ ও সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ। শহীদের বাবা আব্দুল মতিন বলেন, “১৮ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে ঢাকার মিরপুরে ১০ নম্বরের গোলচত্বরের কাছে গুলিবিদ্ধ হয় শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন। ডান চোখের পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে তার মস্তিষ্ক ছেদ হয়ে যায়। তখন আমি গ্রামের বাড়িতে। ছেলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পৌঁছাতে রাত প্রায় একটা বেজে যায়। পথে পথে অনেক বাধা পেরিয়ে ছেলের কাছে গেলেও তাকে জীবিত ফেরাতে পারিনি।” একটানা কথাগুলো বলেই শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করেন শহীদের পিতা। তিনি আরো বলেন, “লাইফ সাপোর্টে থাকা ছেলেকে ২০ জুলাই ২০২৪ বেলা দুইটার দিকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। জিডি করার জন্য মিরপুর থানায় গেলে কর্তৃপক্ষ জিডি রিসিভ করেনি। পরে শাহবাগ থানায় জিডি করি। ময়নাতদন্ত শেষে ২১ জুলাই রোববার রাত সাড়ে ১২টায় বাড়িতে আনা হয় লাশ। যদিও পুলিশ লাশ আনতে বাধা দিয়েছিল। ২২ জুলাই সোমবার সকাল ১০ টায় জানাজা শেষে দাফন করা হয় বাড়ির সামনের গোরস্থানে।” একটু থেমে আব্দুল মতিন আবার বলতে শুরু করলেন, “ছোটো একটা গুলি আমার ছেলেটারে শেষ করে দিলো! ছেলে হত্যার বিচার চাই। কিন্তু কার কাছে বিচার চাইব?” শাহরিয়ারের বাবা জনাব আবদুল মতিন আহাজারি করে বলেন, ছেলে হারানোর শোক সইতে পারছেন না। মনের পর্দায় বারবার ভেসে ওঠে ছেলের মুখ ও তার স্মৃতি। সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘আমাকে চাকরি করে অনেক কষ্টে জীবন চালাতে হতো। এসব দেখে ছেলে বড়ো ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু আমার তো সব শেষ হয়ে গেছে। ছেলে আন্দোলনে যাবে, এটি জানলে কখনোই তাকে ছাড়তাম না। ঢাকায় যাওয়ার সময়ও অনেক নিষেধ করেছিল তার চাচা, যেন কোনো আন্দোলনে অংশ না নেয়।” এ ঘটনায় কোনো ধরনের প্রশাসনিক, পুলিশি কিংবা রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হতে চায় না শাহরিয়ারের পরিবার। এ প্রসঙ্গে তাঁর চাচা আবদুল মোতালিব বলেন, “আমার ভাতিজাকে হারিয়েছি। প্রশাসন নানা তথ্য নিচ্ছে। আমরা কোনো ধরনের প্রশাসনিক, পুলিশি কিংবা রাজনৈতিক হয়রানি চাই না। বিচার একদিন পাব, এ আশায় বাকি জীবন কাটাবো।” শাহরিয়ারের মা মমতাজ বেগম কোনো সান্ত্বনাই মানছেন না। একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোকে ভেঙে পড়েছেন তিনি। তবু তার কান্না থামছিল না, বারবার একই কথা বলছিলেন, ‘‘ওরা আমার বুকের ধন কেড়ে নিল।” শহীদ শাহরিয়ারের বাবা জনাব আবদুল মতিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাকে ১ নম্বর আসামী, রাশেদ খান মেননকে ২ নম্বর আসামী এবং হাসানুল হক ইনুকে ৩ নম্বর আসামী করে মোট ৫২ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। আল্লাহ যেন শহীদ শেখ শাহরিয়ার বিন মতিনের শাহাদাতকে কবুল করে নেন এবং হাশরের দিন যেন তাকে শহীদ হিসেবে উঠান, এই দোয়া তার পরিবারের সকল সদস্যদের। শহীদের চাচা বলেন, “আমার অত্যন্ত আদরের ভাতিজা ছিল শাহরিয়ার। আমার সাথে এবং পরিবারের সবার সাথে খুব গভীর সুসম্পর্ক ছিল তার। এলাকার সবার সাথে ছিল ভালো সম্পর্ক। সবাই ওকে খুব স্নেহ করতো। আদরের ভাতিজাকে হারিয়ে আমার ভাই নিঃস্ব হয়ে গেছেন। আমরা এই হত্যার সুষ্ঠ বিচার চাই।” পরামর্শ ১. শহীদের পিতা-মাতার খোঁজখবর রাখা যেতে পারে। ২. শহীদের মায়ের চাকরিটা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। ৩. শহীদের পিতার চাকরির ব্যবস্থা করা। একনজরে শহীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নাম : শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন জন্ম তারিখ : ০১-১১-২০০৫ জন্মস্থান : কুমড়াশাসন পেশা : শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজ আহত হবার স্থান : মিরপুর-১০, গোলচত্ত্বর, ঢাকা শহীদ হবার স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ আঘাতের ধরন : মাথায় গুলিবিদ্ধ আক্রমণকারী : পুলিশ/ছাত্রলীগ/যুবলীগ আহত হবার তারিখ ও সময় : ১৮ জুলাই; বিকাল ০৫:০০ টা শহীদ হবার তারিখ ও সময় : ২০ জুলাই; দুপুর ০২: ০৬ টা শহীদের কবরস্থান (জিপিএস লোকেশনসহ) : কুমড়াশাসন, মাইজবাগ, ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ-৯০.৬২৩১৯,২৪৬৬১৮৯ স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: কুমড়াশাসন, ইউনিয়ন: মাইজবাগ, থানা: ঈশ্বরগঞ্জ, জেলা: ময়মনসিংহ পিতা : মো: আব্দুল মতিন পিতার পেশা ও বয়স : চাকুরিজীবী, ৪৯ বছর মাতা : মমতাজ বেগম মাতার বয়স : ৪৫ বছর মাসিক আয় : উল্লেখযোগ্য আয় নেই বোন : শেখ মুমতাহিনা বিনতে মতিন, বয়স ও পেশা : ৮ বছর, শিক্ষার্থী, ২য় শ্রেণি