জন্ম তারিখ: ৩১ ডিসেম্বর, ২০০০
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ময়মনসিংহ
পেশা: শ্রমিক, শাহাদাতের স্থান: গাজীপুর বাসন থানার সামনে
নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানাধীন দলপাড়া ইউনিয়নের ভূঁইয়া পাড়ায় শহীদ জিন্নাতুল ইসলাম খোকন ২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। আলোক ঝলমলে সুন্দর এই দিনটাতে ভূঁইয়াপাড়া গ্রামের মৃত গোলাম মোস্তফা ও চম্পা আক্তার দম্পতির কোল জুড়ে আগমন ঘটে তার। বছর খানেক আগে শহীদ জিন্নাতুল ইসলাম খোকন তার পিতাকে হারান। তার মা মোসা: চম্পা আক্তার একজন মাঝ বয়সী নারী। থাকতেন তার সাথেই। শহীদ জিন্নাতুলরা দুই ভাই। তার বড়ভাই আশরাফুল ইসলাম। তাদের পরিবার হতদরিদ্র হওয়ায় দু ভাইয়ের কারও পক্ষেই বেশি পড়ালেখা করার সুযোগ হয়নি। অভাব ছিল তাদের পরিবারের নিত্যসঙ্গী। পরিবারের সেই দরিদ্রতা ঘোচাতে তাদের পুরো পরিবার গাজীপুরে চলে আসে। সেখানে তার বাবা গোলাম মোস্তফাসহ সবাই পোশাক কারখানায় কাজ নেন। বছরখানেক আগে জিন্নাতুল তার বাবাকে হারানোর পরপরই তারা যে কারখানায় কাজ করতেন, সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর জিন্নাতুল বালু পরিবহনের গাড়িতে শ্রমিকের কাজ নেন। তার বড় ভাই আশরাফুল ইসলাম জয়দেবপুরের অন্য আরেকটি কারখানায় যোগ দেন। দুই ভাইয়ের আয় দিয়েই চলছিল পরিবারটি। পরবর্তীতে তার বড় ভাই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে হোসেন মার্কেট এলাকায় চলে যান। জিন্নাতুল এক বছর আগে ময়মনসিংহের গৌরীপুর এলাকার রিনা আক্তারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি শহীদ হওয়ার কালে তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। যেভাবে শহীদ হন জিন্নাতুল ইসলাম খোকন গত ৫ আগস্ট ২০২৪ ছিল জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন। এদিন স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী সরকার প্রধান গণখুনি শেখ হাসিনা পালিয়ে যান দেশ থেকে। যবনিকাপাত ঘটে তার দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের। বাংলার আপামর ছাত্র-জনতা বিজয়ের আনন্দে এদিন হয়ে উঠেছিল উলসিত। কিন্তু এই আনন্দ-উল্লাসের মিছিলেও স্বৈরাচারী হাসিনার পোষা পুলিশ বাহিনী ও ক্যাডার বাহিনী কুখ্যাত ছাত্রলীগ যুবলীগ নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় শহীদ জিন্নাতুল ইসলামও। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সারা দেশ থেকে যখন ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসে, সেই সময় জিন্নাতুলের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তখন থেকেই তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন। ৫ আগস্ট স্বৈরাচারের চূড়ান্ত পতনের দিন দুপুর ৩টার দিকে গাজীপুরের বাসন থানার সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জিন্নাতুল অংশ নেন। এ সময় আন্দোলন দমাতে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের ঘাতক পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছোঁড়ে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে। এমতাবস্থায় হঠাৎ দুটি গুলি লাগে জিন্নাতুলের শরীরে। একটি পেটে ও আরেকটি উরুতে। এই দুটো বুলেটের আঘাতে সাথে সাথেই জিন্নাতুল মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। বুলেটের আঘাতে থেমে যায় জিন্নাতুল। কিছুদিন আগে বিয়ে করা স্ত্রী অকালে হয়ে যায় বিধবা আর তার স্ত্রীর গর্ভে থাকা অনাগত সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই হয়ে যায় এতিম। যে সন্তানের আগমনের খুশিতে আত্মহারা ছিল জিন্নাতুল, সেই সন্তানকে দেখে যাওয়ার সৌভাগ্যও হলো না তার। নিয়তি তাদেরকে এমন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করাবে, তা কি জানতো কেউ? শহীদ সম্পর্কিত আরো কিছু বিবরণ শহীদ জিন্নাতুল ইসলাম খোকন ছিলেন সংগ্রামী জীবনযাপনকারী এক যুবক। তার জীবনের প্রতিটি দিন কেটেছে কঠিন বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করে। বালুর পরিবহন গাড়িতে শ্রমিকের কাজ করতেন তিনি। তবে তার হৃদয়ে ছিল মানুষের জন্য, ন্যায়ের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছা। সংসারের অভাব মেটাতে ১০ বছর আগে পুরো পরিবার নিয়ে গাজীপুরে চলে আসেন তিনি। বাবার মৃত্যু, কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সব কিছু মিলিয়ে জীবন যুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছিল তাকে। তাদের পরিবারটি ছিল নিম্নবিত্ত, যেখানে প্রতিটি টাকার মূল্য ছিল অনেক । । জিন্নাতুলের বড় ভাই আশরাফুল ইসলাম একটি পোশাক কারখানায় কাজ করে সংসার চালাতেন। দুই ভাইয়ের আয়েই চলছিল তাদের পরিবার। বালুর ট্রাকে শ্রমিকের কাজ করতে থাকা জিন্নাতুলের জীবনে নতুন আশার আলো জ্বলে উঠেছিল বছরখানেক আগে যখন তিনি ময়মনসিংহের রিনা আক্তারকে বিয়ে করেন। সদ্য বিবাহিত জীবন শুরুর সাথে সাথে জিন্নাতুলের সংসারে নতুন অতিথি আসার অপেক্ষায় ছিল। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রিনা আক্তারের গর্ভে ছিল তাদের প্রথম সন্তান। সুখময় দিনগুলো হঠাৎ করেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় তাদের। ৫ আগস্টের একই সাথে আলো ঝলমল উজ্জ্বল ও তিমির ঘন কালো দিনে গাজীপুরের বাসন থানার সামনে নিভে যায় তার জীবন প্রদীপ। তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের, যেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার থাকবে। তবে তার সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই তিনি বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে। তার মৃত্যু শুধু পরিবারকে নয়, পুরো সমাজকে শোকাবহ করে তোলে। অন্তঃসত্ত্বা রিনা আক্তার এখন অনাগত সন্তান নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তার সন্তানটি পৃথিবীতে আসার আগেই বাবাকে হারালো। আর সেই সন্তানটির জীবন এখন শুরু হবে একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। স্বামীহারা শোকাহত রিনার এখন প্রশ্ন, কীভাবে চলবে তাদের সংসার? কীভাবে টিকে থাকবে সন্তানটি, যার কখনোই বাবার মুখ দেখার সুযোগ হবে না? জিন্নাতুলের মা চম্পা আক্তার বলেন, "আমার ছেলে এতদিন বালুর গাড়িতে শ্রমিকের কাজ করত। আন্দোলনের সময় কাজ বন্ধ ছিল। সেই থেকে ছাত্রদের সাথে মিলে আন্দোলনে যেত। তাকে নিষেধ করলেও সে শোনেনি। আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলা হলো, তাকে হত্যার বিচার কে করবে? আমরা গরিব মানুষ, একদিন কাজ না করলে খেতে পারি না। এখন বিপদ কাটবে কীভাবে, কিছুই বুঝতে পারছি না।" জিন্নাতুলের বড় ভাই আশরাফুল ইসলাম বলেন, "ছোট ভাইয়ের লাশ দেখে নিজেকে বোঝানোর ভাষা নেই আমার। আমার ভাইয়ের সন্তান বাবার মুখ দেখতে পারবে না—এটা ভাবতেই কষ্টে বুক ফেটে যায়।" শহীদ জিন্নাতুল ইসলাম খোকনের এই অকাল মৃত্যু শুধু তার পরিবারই নয়, সমগ্র সমাজকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। তার এই আত্মত্যাগ একটি অন্যায় ও বৈষম্যমুক্ত সমাজের জন্য লড়াইয়ের মশাল হয়ে থাকবে। তার পরিবারের দাবি, জিন্নাতেরহত্যাকারীদের যেন বিচার করা হয় এবং জিন্নাতকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়। সেই সাথে তারা তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতারও প্রত্যাশী। এক নজরে শহীদ সম্পর্কিত তথ্যাবলি নাম : মো: জিন্নাতুল ইসলাম খোকন জন্ম তারিখ : ৩১ ডিসেম্বর, ২০০০ শহীদ হওয়ার স্থান ও সময়কাল : গাজীপুর বাসন থানার সামনে, ৫ আগস্ট ২০২৪, বিকাল: ৩:৩০ মিনিট আঘাতের ধরন : গুলিবিদ্ধ আক্রমণকারী : স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের ঘাতক পুলিশ দাফনস্থল : নিজগ্রাম, নেত্রকোনা পেশা : শ্রমিক পিতা : মৃত গোলাম মোস্তফা মাতা : চম্পা আক্তার স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: ভূঁইয়াপাড়া, ইউনিয়ন: দলপাড়া, থানা: কেন্দুয়া, জেলা: নেত্রকোনা স্ত্রী : রিনা আক্তার, গৃহিণী (অন্তঃসত্ত্বা) শহীদ পরিবারের জন্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ১. নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন ২. অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী এবং অনাগত সন্তানের ভরণপোষণ প্রয়োজন