জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ময়মনসিংহ
পেশা : দিনমজুর, শাহাদাতের স্থান : জায়নবাজার, গাজীপুর
শহীদ তোফাজ্জল হোসেন জন্মগ্রহণ করেন ২০০৩ সালে। তার জন্মের দিন এবং মাস সম্পর্কে পরিবার কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তার পিতা মৃত রশিদ মিয়া এবং মাতা হারেসা আক্তার। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার মাসকা ইউনিয়নের পিজাহাতি গ্রামে। তোফাজ্জল হোসেন তার বাবাকে হারান প্রায় ২০ বছর আগে। বিধবা মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। ৩ বোন এবং ২ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ৪র্থ। বড় ৩ বোন সবাই বিবাহিতা। তোফাজ্জল মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে থাকতেন গাজীপুরে। পরিবারের দৈন্যদশার দরুণ কারো পড়াশুনা বেশি দূর এগোয়নি। তাছাড়া পিতৃহীন পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় তার ওপর ছিল গুরুদায়িত্ব। বড় তিন বোনের ভারও ছিল তার কাঁধে। তাই ছোটবেলা থেকেই তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সংগ্রামী এই তরুণ পেশায় ছিলেন শ্রমিক। গাজীপুরের শ্রীপুর থানার স্কয়ার মাস্টারবাড়ি এলাকায় আর এ কে সিরামিকস কোম্পানিতে তিনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। বড় তিন বোনকে বিয়ে দিয়ে ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েন তিনি। তাইতো মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে এসেছিলেন গাজীপুরে। ঋণ পরিশোধ আর পরিবারের সুদিন ফেরানোর আশা ছিল তার দুচোখে। কিন্তু স্বৈরাচারের ক্যাডার বাহিনীর কালো থাবায় থেমে যায় স্বপ্ন পিপাসু এই তরুণের সকল আশা ভরসা। যেভাবে শহীদ হন তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত বিজয়ের আগের দিন। ৪ আগস্ট ২০২৪, রবিবার। কোটা সংস্কারের যৌক্তিক আন্দোলন তখন স্বৈরাচার পতনের এক দফা আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। সারা দেশ থেকে লাখ লাখ ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছে আন্দোলনে। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার স্কয়ার মাস্টারবাড়ি এলাকাও সেদিন আন্দোলনে উত্তাল। শহীদ তোফাজ্জল হোসেনও যোগ দেন আন্দোলনে। ঠিক সন্ধ্যার সময় নিরীহ-নিরস্ত্র মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের ক্যাডার বাহিনী যুবলীগ-ছাত্রলীগের কুখ্যাত নেতাকর্মীরা। এরা শহীদ তোফাজ্জল হোসেনকে ধরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কুপিয়ে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মারাত্মক জখম করে তার মাথাসহ শরীরের অন্যান্য স্থানে। সহযোদ্ধারা তাকে স্থানীয় আলহেরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে শ্রীপুর উপজেলা হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। থেমে যায় এক তরুণের সকল স্বপ্ন আশা ভরসা। নিভে যায় জীবন প্রদীপ। ৫ আগস্ট তার মরদেহ আনা হয় গ্রামের বাড়ি কেন্দুয়ার পিজাহাতি গ্রামে। এরপর নামাজে জানাজা শেষে গ্রামের কবরস্থানে চিরনিদ্রায় তাকে শায়িত করা হয়। শহীদ তোফাজ্জলের সংগ্রামী জীবন ২১ বছরের টগবগে যুবক তোফাজ্জল। জমিজমা বলতে কিছুই নেই তাদের। বাবা মারা গিয়েছেন প্রায় ২০ বছর আগে। বড় তিন বোনেরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মা ও ভাইকে নিয়ে নিতান্তই অভাবের সংসার তার। এছাড়া সংসারে রয়েছে ঋণের বোঝা। তাই পেটের তাগিদ ও ভবিষ্যৎ স্বপ্নে মা এবং ভাইকে নিয়ে বছর তিনেক আগে পাড়ি জমান গাজীপুরে। শ্রমিকের কাজ নেন আর এ কে সিরামিকস কোম্পানিতে। মোটামুটি ভালোই চলছিল সংসার কিন্তু সরকার পতনের আন্দোলন যেন তাকে উদ্বেলিত করে তোলে। তাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে যোগ দিলেও স্বৈরাচারী হাসিনার পতন দেখে যেতে পারেননি তিনি। পতনের একদিন আগে খুনি হাসিনার পোষা আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিভিয়ে দেয় তার জীবন প্রদীপ। বিয়ের কথাবার্তা চলছিল তোফাজ্জলের কিন্তু বিয়ের পিঁড়িতে বসার নতুন জীবনে পা দেওয়ার সৌভাগ্য আর হলো না। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, তার দোচালা টিনের ভাড়া বাসাটিতে তালা ঝুলছে। মা, ছোট ভাই এবং বোনেরা যার যার কর্মে চলে গিয়েছেন। মুঠোফোনে তার বড় বোন আকলিমা আক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হলে কান্না বিজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, "আমার ভাইয়ের কোনো অন্যায় ছিল না। গিয়েছিল অধিকার আদায়ের মিছিলে কিন্তু আমার ভাইকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আমার ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। সে বিয়ে করবে, সুন্দর সংসার সাজাবে কিন্তু তার সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ ও আমাদের বিয়ে দিতে গিয়ে সংসারে প্রায় ২ লাখ টাকা ঋণ করতে হয়েছে। আমার ভাই সেই ঋণের টাকা, কাজ করে পরিশোধ করতে চেয়েছিল কিন্তু সেটা করে যেতে পারল না। এই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আমার অসহায় মা এবং ছোট ভাই পাগলপারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।" প্রতিবেশী আবুল কালাম, “বলেন এরা অত্যন্ত গরিব মানুষ। এই ঘরের জায়গাটুকু ছাড়া আর জমিজমা বলতে কিছুই নেই। তোফাজ্জলের পরিশ্রমের উপর সংসার চলত। তার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। খুব ভালো ছেলে ছিল তোফাজ্জল।” এ সময় তোফাজ্জলের মা হারেসা আক্তারের কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। তিনি শুধু বলতে থাকেন, "আমার কী হলো রে আমার কী হলো রে! তার বিলাপে সমবেত কেউ ধরে রাখতে পারেনি চোখের জল। চোখ মুছতে মুছতে এই নিষ্ঠুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন তার ছোট ভাই মোফাজ্জল এবং এলাকাবাসী। শহীদের সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল নাম : মো: তোফাজ্জল হোসেন জন্ম সাল : ২০০৩ শহীদ হওয়ার স্থান ও সময়কাল : জায়নবাজার, গাজীপুর, ৪ আগস্ট ২০২৪, আনুমানিক সন্ধ্যায় আঘাতের ধরন : কুপিয়ে হত্যা আক্রমণকারী : যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী নেতাকর্মী দাফনস্থল : নিজগ্রাম পেশা : শ্রমিক পিতা : মৃত আব্দুর রশিদ মিয়া মাতা : হারেসা আক্তার স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: পিজাহাতি, ইউনিয়ন: মাসকা, থানা: কেন্দুয়া, জেলা: নেত্রকোনা ভাইবোন : ৩ বোন, ১ ভাই বাড়িঘর ও সম্পদ : গ্রামের বাড়িতে ১টি ঘর, সম্পদ নেই, ২ লাখ টাকা ঋণ শহীদ পরিবারের জন্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ১. নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন ২. ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করা দরকার ৩. ছোট ভাইয়ের একটা চাকরির ব্যবস্থা করা জরুরী