জন্ম তারিখ: ১২ ডিসেম্বর, ২০০০
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২৫ জুলাই, ২০২৩
বিভাগ: ময়মনসিংহ
পেশা : চাকরিজীবী, শাহাদাতের স্থান : জিরো পয়েন্ট, মিরপুর-১৩
কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলার দামিহা ইউনিয়নের সবুজ শ্যামল এবং সুন্দর একটি গ্রাম হাছলা। এই গ্রামে বাস করেন মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন এবং হেলেনা আক্তার দম্পতি। এই দম্পতির কোলজুড়ে ২০০০ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম হয় শহীদ তরিকুল ইসলাম রুবেলের। ২ বোন ও ৪ ভাইয়ের মধ্যে রুবেল ছিলেন তৃতীয়। গ্রামের বাড়িতে ভাই-বোনদের সাথে আনন্দ আহ্লাদে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। কৃষক পিতা অনেক কষ্টে সন্তানদেরকে লালন-পালন করেন। বড় ভাই মো: সোহেল ছোট্ট একটা চাকরি করেন। মেজ ভাই জুয়েল শিক্ষার্থী, আর সবার ছোট ভাই আশরাফুল ইসলাম রয়েল বর্তমানে বেকার। বড় ভাইয়ের চাকরির সামান্য বেতন আর পিতার অক্লান্ত পরিশ্রমেই চলছিল তাদের সংসার। এরই মধ্যে এই সংসারে আশীর্বাদ হয়ে আসে রুবেলের ভালো বেতনের চাকরি। পেশায় চাকরিজীবী রুবেল ঢাকার মিরপুর-১৩ নম্বরে রাকিন সিটিতে চাকরি করতেন। তার মাসিক বেতন ছিল প্রায় ৪০,০০০ হাজার টাকা। পরিবারের সবার মুখে ফুটে ছিল স্বস্তির হাসি। কার্যত এই চাকরির কারণেই পরিবারের সমস্ত ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন শহীদ তরিকুল ইসলাম রুবেল। তরিকুল ইসলাম রুবেলের বড় দুই বোন বিবাহিতা আর মেজ ভাই বিএ অনার্সের ছাত্র। তার চাকরির অর্থেই ভাইয়ের পড়াশোনা চলছিল। রুবেলের মৃত্যুতে তার ভাইয়ের পড়াশুনা এবং তার পরিবার গভীর সংকটের মধ্যে পড়েছে। বর্তমানে তার বড় ভাইয়ের চাকরির অল্প বেতন ও বাবার কৃষি কাজের মাধ্যমে সামান্য যা আয় হয়, তা দিয়েই পুরো পরিবার কষ্টে দিন যাপন করছেন। তাদের নিজেদের কোনো কৃষি জমি নেই। ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যের জমিতে চাষাবাদ করতে হয়। যেভাবে শহীদ হন তিনি জুলাইয়ে উত্তাল সারা দেশ। চলছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর থেকে সারা দেশের ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। একদিকে চলছিল ছাত্রদের কমপ্লিট শাটডাউন, অন্যদিকে আন্দোলন দমাতে স্বৈরাচার সরকারের কারফিউ। সেদিন ছিল ১৯ জুলাই। রুবেল তার ডিউটি শেষে মিরপুরের অফিস থেকে বাসার দিকে ফিরছিলেন। রাত তখন আনুমানিক ৮টা। রাজপথে তখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্র আর পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। তিনি পড়ে যান সেই সংঘর্ষের মধ্যে। নিজেকে রক্ষা করার জন্য রাস্তার পাশে থাকা একটি ভ্যান গাড়ির নিচে লুকিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি দেখার জন্য তিনি ভ্যান গাড়ির নিচ থেকে মাথা তুলে উঁকি দেন। সাথে সাথে ঘাতক পুলিশের ছোঁড়া দুটি বুলেট এসে লাগে তার মাথায়। দুটি গুলিই একই সাথে লাগার কারণে তার মাথার খুলি উড়ে গিয়ে মগজ ছিটকে পড়ে ১০ হাত দূরে। সাথে সাথেই মৃত্যু হয় তার। ঘটনাস্থলে থাকা আন্দোলনকারীরা তার লাশ হেফাজত করে রাখে। পরিবারের ভাষ্যমতে, লাশ যদি সেদিন আন্দোলনকারীরা না সরিয়ে নিতো, তবে হয়তো পুলিশ রুবেলের লাশ গায়েব করে ফেলতো এবং পরিবার তার লাশ কখনোই খুঁজে পেত না। পরবর্তীতে আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে খবর পেয়ে রুবেলের চাচাতো ভাই লাশ নিয়ে আসে এবং কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার দামিহা ইউনিয়নের অন্তর্গত হাছলা গ্রামের পঞ্চগ্রাম গোরস্থানে দাফন করেন। শহীদের জানাজায় বিপুল পরিমাণ মানুষের উপস্থিতি হয়েছিল এবং উপস্থিত সকল গ্রামবাসী রুবেলের জন্য চোখের পানি ফেলেছিল। শহীদ সম্পর্কিত আরো কিছু তথ্য বাবামায়ের চক্ষু শীতলকারী সন্তান কেমন হয়, তার উজ্জ্ব্বল দৃষ্টান্ত শহীদ তরিকুল ইসলাম রুবেল। বাবা-মায়ের চোখের মণি এবং মনের শান্তি ছিলেন রুবেল। কৈশোর থেকেই পরিবার ও এলাকাবাসীর কাছে সহজসরল ও চরিত্রবান ছেলে হিসেবে সুনাম ছিল তার। কৃষি কাজের সামান্য আয় দিয়ে ৮ সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে বৃদ্ধ বাবাকে হিমশিম খেতে হতো। তাই সংসারের অভাব দূর করার জন্য রুবেল ঢাকায় একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। বেতন ভালো হওয়ার সুবাদে প্রতি মাসে বাবা-মাকে সামর্থ্য অনুযায়ী অনেক অর্থ দিতে পারতেন তিনি। বলতে গেলে পুরো পরিবারের দায়িত্ব রুবেল নিজ কাঁধে নিয়ে নেন। এভাবে তাদের সংসার বেশ ভালই চলছিল। বাবা-মা, ভাই-বোনকে কখনো মুখ ফুটে কিছু চাইতে হয়নি রুবেলের কাছে। ২৩ বছর বয়সী রুবেল সবার সব চাহিদাটুকুই পূরণ করার চেষ্টা করতেন। হঠাৎ করেই সুন্দর ও সুখী এই পরিবারের উপর বিষাদের কালো মেঘ নেমে আসে। স্বৈরাচারী রাক্ষুসী খুনি হাসিনা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য নিরীহ ছাত্র-জনতার উপর হত্যাকাণ্ড চালায়। তার মধ্যেই পড়ে যান তিনি। থেমে যায় তার জীবন প্রদীপ। বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসে একটি সুখী সংসারে। রুবেলের প্রতিবেশী ও এলাকাবাসী জানিয়েছেন, খুব ভালো ছিলেন তিনি। ঈদের সময় বাড়িতে আসলে সাধ্যমত গরিব মানুষকে সহযোগিতা করতেন। গ্রামের ছেলেদের খেলাধুলার জন্য ব্যাট, ক্রিকেট বল, ফুটবল কিনে দিতেন। তিনি নিজেও খেলাধুলা করতে পছন্দ করতেন। তার স্বপ্ন ছিল, বাবা-মায়ের জন্য একটা পাকা ঘর বানিয়ে দিবেন। তিনি কখনো কারো সাথে ঝগড়াঝাটি, মারামারি, গালাগালি করতেন না। অনেক ভালো ছেলে ছিলেন রুবেল। রুবেলের মৃত্যুর পর পুরো গ্রামবাসী তার জন্য কান্না করেছে। উপার্জনক্ষম এবং যুবক ছেলেকে হারিয়ে তার বাবা-মা দিশেহারা, শোকে মূহ্যমান। রুবেলের বড় ভাইয়ের ছোট্ট চাকরির সামান্য বেতন আর বাবার অন্য মানুষের জমিতে কৃষি কাজের অল্প আয় দিয়ে এত বড় সংসার কোনো মতেই চলে না। তাই সংসারে সহযোগিতা করতে ছোট ভাই রয়েলও কাজ শেখা শুরু করেছেন। এমতাবস্থায় রুবেলের পরিবারের দাবি, রুবেলের হত্যাকারীদের যেন উপযুক্ত বিচার করা হয় এবং রুবেলকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়। একই সাথে পরিবারের আর্থিক ভার বহনকারী রুবেল দেশের জন্য জীবন দেওয়ার ফলে তারা আর্থিকভাবে দুরবস্থায় পড়ার কারণে সরকারিভাবে সহযোগিতাও প্রত্যাশা করেন। শহীদের সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল নাম : মো: তরিকুল ইসলাম রুবেল জন্ম তারিখ : ১২-১২-২০০০ শহীদ হওয়ার স্থান ও সময়কাল : জিরো পয়েন্ট, মিরপুর-১৩, ১৯ জুলাই, ২০২৪, রাত ৮টা আঘাতের ধরন : মাথায় বুলেট লেগে খুলি ও মগজ বিচ্ছিন্ন ঘাতক : পুলিশ দাফনস্থল : নিজগ্রাম পেশা : চাকরিজীবী কর্মস্থল : রাকিন সিটি, মিরপুর-১৩ পিতা : মো: ফরিদ উদ্দিন মাতা : হেলেনা আক্তার স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: হাছলা, ইউনিয়ন: দামিহা, থানা: তারাইল, জেলা: কিশোরগঞ্জ ভাইবোন : ২ বোন, ৩ ভাই, সাবিনা (৩৭), হিমা আক্তার (৩৬), সোহেল (৩৫), জুয়েল (২৫), আশরাফুল রয়েল (২০) শহীদ পরিবারের জন্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ১. আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন ২. বিএ পড়ুয়া মেজ ভাইয়ের একটা চাকরির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন