জন্ম তারিখ: ১৫ নভেম্বর, ১৯৯২
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ময়মনসিংহ
পেশা: বিক্রয়কর্মী , শাহাদাতের স্থান : রায়েরবাগ, কদমতলী থানার সামনে, ঢাকা
শহীদ মোবারক হোসেন ১৯৯২ সালের ১৫ নভেম্বর কিশোরগঞ্জের নোয়াকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা মো: হাশেম দিনমজুর এবং মা আমেনা একজন গৃহিণী। শহীদের বাবা অন্যত্র বিবাহ করে স্ত্রী নিয়ে আলাদা থাকেন। মোবারক মেসার্স শতরূপা ট্রেডার্স, দীপা ইলেকট্রনিক্স মার্কেট, ১৫৯ নবাবপুর রোড, ঢাকায় ইলেকট্রিক্যাল দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। বিবাহিত শহীদ মোবারক-এর আদিবা নামে দুই বছরের একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। স্ত্রী-কন্যা নিয়ে মা ও ভাই মোশাররফ হোসেনের সাথে ঢাকার রায়েরবাগের আপন বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের সমর্থকদের সাথে সরকার সমর্থক ও পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। শহীদ মোবারক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মিছিলে যোগদান করে। মিছিলটি কদমতলার সামনে আসলে ঘাতক পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। একটি গুলি মোবারকের এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। তখন তাকে পাশের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং ব্যান্ডেজ করা হয়। পরবর্তীতে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেন। শাহাদাতের প্রেক্ষাপট একই দেশের নাগরিক আমরা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা তৃতীয় বিশ্বের অতি সাধারণ নাগরিক। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ন্যায় ও সাম্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করার উদ্দেশ্যেই পাকিস্তানি হানাদার গোষ্ঠীকে এ দেশ হতে বিতাড়িত করেছিলাম। দেশ হানাদার মুক্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেনি কখনোই। দুর্নীতি, অনিয়ম আর বৈষম্য এদেশের প্রতিটি পরতে পরতে গেঁথে গিয়েছিল। চেপে বসেছিল কোটানামক নানাবিধ বৈষম্য। যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতি কোটা অন্যতম। মুক্তিযোদ্ধারা এদেশের মহান সন্তান। তাদের মহান আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভাতা দেয়া হোক, সম্মান প্রদর্শন করা হোক, সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন করা হোক এতে কোন মানুষের কোন অভিযোগ থাকার কথা নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে জাতি কখনো কার্পণ্য করেনি। তার সন্তানদের মূল্যায়নের প্রশ্ন আসলে সেখানেও জাতি কোন কথা বলেনি। কিন্তু বিপত্তি বেধেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মুক্তিযোদ্ধার নামে সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে। দৈনিক প্রথম আলোর মতে, এদেশে ৫৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে যাদের জন্ম ৭১ সালের পরে। এর মানে হচ্ছে চেতনা ব্যবসায়ী স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধকে উপলক্ষ করে তাদের দলীয় ক্যাডারদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনের দায়িত্ব হস্তান্তর করা। আওয়ামীলীগের এই জাতি বিনাশী অপতৎপরতাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী কাজ। তাইতো এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগঠিত হলো অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানে সকল শ্রেণীর সকল পেশার মানুষের সমান অংশীদারিত্ব ছিল। শহীদ মোবারক হোসেনও এ আন্দোলনের গর্বিত অংশীদার। ১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। সারাদেশ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে টালমাটাল। শহীদ মোবারক হোসেন জুমার নামাজ আদায় করে বাসায় ফিরছিলেন। বাসায় আসলে একমাত্র মেয়ে আদিবা চিপস খাওয়ার জন্য বায়না ধরে। বাসার নিচে তখন ঘাতক পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। চিপস আনতে বাসার বাইরে হলেও ভুলে যান চিপস কেনার কথা। যোগ দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার মিছিলে। মিছিলটি এক সময় কদমতলী থানার সামনে আসে এবং খুনি পুলিশ তাতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে একটি গুলি শহীদ মোবারক এর মাথায় আঘাত হানে। রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। সহকর্মীরা ধরে হাসপাতালে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তার আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। লাশ গুমের সেই পুরনো খেলায় আওয়ামীলীগ বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নিয়ম তান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতিপক্ষের নাম। জন্ম হতে এই অবধি তারা কখনোই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করত না। অপরাজনীতির এমন গলি নেই যেখানে আওয়ামী লীগের পদচারণা নাই। লাশের রাজনীতিকরণ এবং লাশ গুম করে ফেলা, এসব কাজে সন্ত্রাসী আওয়ামীলীগের প্রতিপক্ষ কেবল আওয়ামীলীগ। লাশ গুম করে ফেলেছিল শহীদ মোবারক হোসেনের। দুইদিন কোন খোঁজই ছিল না লাশের। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দুইদিন পর পাওয়া যায় তার লাশ। অতঃপর গ্রামের বাসায় নিয়ে গিয়ে ২২ জুলাই তাকে গ্রামে দাফন করা হয়। শহীদের স্বজনদের প্রতিক্রিয়া শহীদ মোবারক হোসেনদের গল্পটা অনেক কষ্টের। তার ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন বলেন, “ছোটবেলাতেই বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মা ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজ করে তাদের বড় করেছেন। দুই ভাই নবাবপুর এলাকার একটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানে বিক্রয় কর্মী হিসেবে কাজ করতাম। মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকার মতো বেতন পেতাম। সংসারটা কোনরকমে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু ভাইয়ের মৃত্যুতে হঠাৎ যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। তার স্ত্রী ও দেড় বছরের একটি সন্তান রয়েছে। একার আয়ে ৬ সদস্যের এই সংসার কিভাবে চলবে? স্বামীকে হারিয়ে যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন স্ত্রী শান্তা আক্তার। কথা বলার সময় মেয়েকে কোলে টেনে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। বলেন, কি অপরাধ ছিল আমার স্বামীর? এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলি নাম : মো: মোবারক হোসেন পিতা : মো: আবুল হাশেম মাতা : মোসা: জামেনা খাতুন জন্ম তারিখ : ১৫ নভেম্বর, ১৯৯২ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: নোয়াকান্দি, ইউনিয়ন: ৮ নং আনন্দ বাজার, থানা: করিমগঞ্জ, জেলা: কিশোরগঞ্জ বর্তমান ঠিকানা : রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা সিটি দক্ষিণ আহত হওয়ার স্থান : রায়েরবাগ, কদমতলী থানার সামনে, ঢাকা আহত হওয়ার সময়কাল : ১৯ জুলাই ২০২৪, বিকাল: ৩.২০ মিনিট শহীদ হওয়ার সময় ও স্থান : ১৯ জুলাই বিকাল: ৫টা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল যাদের আঘাতে শহীদ : স্বৈরাচারী হাসিনার ঘাতক পুলিশ শহীদের কবরস্থান : নিজ গ্রাম, করিমগঞ্জ মডেল মসজিদ সংলগ্ন মাঠ শহীদ পরিবারের জন্য করণীয় ১. শহীদের পরিবারকে এককালীন অনুদান দেয়া ২. শহীদের বাসস্থান নির্মাণ করে দেওয়া ৩. শহীদের মেয়ের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা ৪. শহীদের স্ত্রীর কর্মসংস্থানে সহায়তা করা