জন্ম তারিখ: ২ অক্টোবর, ২০০৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ময়মনসিংহ
পেশা: ছাত্র শাহাদাতের স্থান: এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাভার, ঢাকা
২০০৯ সালের ২ অক্টোবর জামালপুর জেলার শরীফপুর ইউনিয়নের সবুজ শ্যামল গ্রাম রঘুনাথপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আগস্ট বিপ্লবের অন্যতম নায়ক বীর সেনানী সাফওয়ান আখতার সদ্য। বাবা মো: আখতারুজ্জামান (৪৮) ভেটেরিনারি ডাক্তার (মিল্ক ভিটা) এবং মা সমাজ সেবিকা খাদিজা বিন জুবায়েদ (৪৪)। সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণীর শাপলা সেকশনের বিজ্ঞান বিভাগ শিক্ষার্থী সদ্যের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হবে। স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় বরাবরই ছিল তার সরব উপস্থিতি। ঝোঁক ছিল খেলাধুলায়, ছবি আঁকায় আর এনিমেশন বানানোতে। কোরআন-হাদিস আর বিজ্ঞানের বই থাকত তার টেবিল জুড়ে। জানতে চাইত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের বিভিন্ন বিষয়াদি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শুরু থেকেই যোগদান করার জন্য বাবার কাছে বায়না ধরতো দশম শ্রেণি পড়ুয়া সদ্য। ৫ আগস্ট ইতিহাসের নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার খুনি হাসিনার পলায়নের দিন অর্থাৎ সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে শহীদ সদ্য গিয়েছিলেন বিজয় মিছিলে। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ তিনি এই বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করতে পারেননি। পলাতক হাসিনার পেটুয়া বাহিনী তখনো সরব ছিল। ঘাতক সেই বাহিনীর গুলিতেই চিরতরে হারিয়ে যায় মেধাবী সন্তান শহীদ সাফওয়ান।শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ৫ আগস্ট ২০২৪, সোমবার। নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদের কবর থেকে পুনর্জন্ম ঘটে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের। বন্ধুবেশী ভিনদেশী শকুন খামচে ধরেছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা, স্বপ্ন দেখেছিল এই দেশটিকে তাবেদার-করদ রাজ্যে পরিণত করার। দেশের এই ক্রান্তি লগ্নে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় চিরতরু দামাল ছাত্র-জনতা। শত শত মানুষ তরুণ-যুবক অকাতরে রক্ত ঢেলে দেয় খুনি হাসিনার রক্তপিপাসা মিটাতে। অবশেষে রক্ত রাঙ্গা পিচ্ছিল পথ বেয়ে আসে এদেশের মুক্তি। জন্ম হয় প্রকৃত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। এই দিন দুপুর একটার দিকে বাবার সাথে বিজয় মিছিলে অংশ নিতে বেরিয়েছিলেন শহীদ সদ্য। বাবা ছেলে মিলে হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিলেন সাভারের পাকিজা স্ট্যান্ডে। বিকেল ৪:১৫টা পর্যন্ত বাবার সাথেই ছিলেন তিনি। এরপর বন্ধুদের সাথে চলে যান সদ্য। স্বাধীন বাংলাদেশে হয়তোবা পেটোয়া হাসিনার বাহিনী আর গুলি করবে না এই ভরসায়। তার বাবা আখতারুজ্জামান এর ধারণা, পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ঘাতক পুলিশের গুলি লেগেছে সদ্যর গায়ে। একটা গুলি লেগেছিল ওর হাতে অন্যটা বুকের পাঁজরে। রাত ৯ টা পর্যন্ত সদ্য ফিরে না আসায়; বাবা খুঁজতে খুঁজতে রাত সাড়ে নয়টার দিকে চলে যান এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই স্ট্রেচারে পড়েছিল ছিলো সদ্যের লাশ। ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়ে সাফওয়ান আখতার সদ্য। শহীদের স্বজনদের প্রতিক্রিয়া শহীদ সদ্যের শাহাদাতের খবরে তার বিদ্যালয়ে, সাভারের আশেপাশের লোকজনের মধ্যে এবং গ্রামের বাড়ি জামালপুরে নামে শোকের ছায়া। শহীদের মা খাদিজা বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন ছেলের মৃত্যুর সংবাদে। মনে হচ্ছিল সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। শহীদ সাফওয়ান আখতার সদ্যর মা বলেন, “সদ্য আমাকে বলতো মা তুমি আমাকে কি বানাতে চাও”। আমি বলতাম আমি তোমাকে কিছুই বানাতে চাই না, তুমি অলরেডি আমার সবকিছু হয়ে গেছো। সদ্য সারাদিন আমাকে মা মা বলে ডাকাডাকি করত। কারণেও ডাকতো অকারণেও ডাকতো। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতো আপু তো কথা বলতে পারেনা তোমাকে মা বলেও ডাকতে পারে না। তাই আমি তোমাকে এতবার মা বলে ডাকি আমার ভাগেরটা ডাকি, আপুর ভাগেরটাও ডাকি। সদ্যের উপর কখনো রাগ বা অভিমান করে বেশীক্ষণ থাকতে পারতাম না। এসে জড়িয়ে ধরে বলতো মা তুমি কেন রাগ-অভিমান কর? বাবাকে সারাদিন বাসায় পাই না। এখন তুমি যদি রাগ করে থাকো তাহলে আমি কি করবো? কোথায় যাবো বলোতো? আমার তো ভালো লাগে না তুমি রাগ করলে।” সদ্যের মা আরো বলেন, “কত যে স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম আমার ছেলেকে নিয়ে। সব শেষ হয়ে গেল।" ঢুকরে কাঁদতে কাঁদতে শহীদ সাফওয়ান আখতার সদ্যের গর্ভধারিণী মা খাদিজা বিনতে জুবায়েদ বলেন, “আমার সদ্য কে যদি বলতাম সদ্য আজকে টিফিনে কি খেতে চাও বাবা? আমি কি বানাবো আজ তোমার জন্য? সদ্য জবাব দিতো, মা আমি আজ টিফিন নিব না। তোমাকে কিছু বানাতে হবে না। তুমি এমনিতেই সারাদিন কষ্ট কর। বাসায় কাজ করো, রান্না করো। তোমাকে এত কষ্ট করে এত সকালে উঠে আমার টিফিন বানাতে হবে না। তুমি বিশ্রাম নাও মা।” শহীদ সদ্যর চাচা মো: তমল উদ্দিন বলেন, “সদ্য খুব মেধাবী এবং বুদ্ধিমান ছেলে ছিল। শুধু লেখাপড়া নয় চেহারার দিক দিয়েও সদ্য ছিল অনন্য। সবাই তাকে খুব পছন্দ করত। আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সদ্য দেশের নেতৃত্ব দিবে। বড় আর্মি অফিসার হবে কিন্তু তা আর হলো না। সদ্যর মৃত্যুতে আমাদের পুরো এলাকাবাসী শোকাহত। এতটাই কষ্ট আমাদের মনে হয় যে, ওর চেহারা মনে পড়লে সেদিন আর আমি ভাত খেতে পারি না। সদ্য কখনো সালাম না দিয়ে কথা বলতো না। সবসময় মানুষকে সালাম দিয়ে চলতো। বর্তমানে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের আবেদন একটাই সদ্যকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই। আমার ভাতিজার হত্যার সুষ্ঠু বিচার হলে কেবল আমাদের মন শান্ত হবে। আপনারা সবাই আমার ভাতিজার জন্য দোয়া করবেন; যেন আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতবাসী করেন।” শহীদ পরিবারের বিশেষ তথ্য শহীদের গর্বিত পিতা মো: আকতারুজ্জামান পেশায় একজন ভেটেরিনারি ডাক্তার। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের স্বনামধন্য মিল্কভিটা কোম্পানিতে কর্মরত আছেন। চাকুরীর সুবাদে জনাব আখতারুজ্জামান এর আর্থিক অবস্থা বেশ সচ্ছল। তিনি বর্তমানে পিএইচডি ফেলো। শহীদের মা খাদিজা বিন জুবায়েদ একজন সমাজসেবিকা। শহীদ সদ্যের বড়বোন আতিয়া জামান তিশমা (১৯) একজন ছাত্রী। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলি নাম : সাফওয়ান আখতার সদ্য পিতা : মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান (৪৮) মাতা : খাদিজা বিন জুবায়েদ (৪৪) জন্ম তারিখ : ২ অক্টোবর ২০০৯ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: রঘুনাথপুর, ইউনিয়ন: শরীফপুর, শ্রীরামপুর, জামালপুর সদর, জেলা: জামালপুর বর্তমান ঠিকানা : ১০৮/৫ মামনি প্রপার্টিস টু, সিআরপি রোড, সাভার, ঢাকা আহত হওয়ার স্থান ও সময় : পাকিজা স্ট্যান্ডের সামনে, সাভার শহীদ হওয়ার সময় ও স্থান : ৫ আগস্ট ২০২৪, বিকাল: ৫টা, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাভার, ঢাকা যাদের আঘাতে শহীদ : ঘাতক পুলিশ শহীদের কবরস্থান : নিজ গ্রাম ১. শহীদের পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল। শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে তার বাবা জনাব মো: আখতারুজ্জামান শহীদ সদ্যের নামে চিকিৎসা কেন্দ্র, মসজিদ, মাদ্রাসা, ওযুখানা, স্কুল ইত্যাদি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। এইসব উদ্যোগ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য আর্থিক সহায়তা করা প্রয়োজন।