জন্ম তারিখ: ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ময়মনসিংহ
পেশা : শিক্ষার্থী, শাহাদাতের স্থান :খড়মনুর খাদ্য গুদামের সামনে, শেরপুর সদর।
শহীদ সারদুল আশিষ সৌরভের জন্ম ২০০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার জরাকুরা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। এই গ্রামের শিক্ষক দম্পতি মো: সোহরাব হোসেন ও শামসুন্নাহারের গৃহ আলো করে এই ধরণীতে আগমন ঘটেছিল তার। এই দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে শহীদ সৌরভ দ্বিতীয়। সারদুল আশিষ সৌরভের পিতা সোহরাব হোসেন স্থানীয় বিএম কলেজের শিক্ষক। তার মাতা শামসুন্নাহারও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পিতা-মাতা দুজনই শিক্ষক হওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে তারা যথেষ্ট সচ্ছল। এছাড়া তাদের বসত বাড়িটাও বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। পারিবারিক সূত্রেই তারা অনেক কৃষি জমির মালিক। সৌরভ পেশায় শিক্ষার্থী। পড়াশোনা করেন সেকান্দার আলী কলেজে। এই কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের বাংলা বিভাগের এক সাধারণ কিন্তু পরিশ্রমী ছাত্র তিনি। তার বড় ভাই শাহরিয়ার আশিষ শোভনও অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। আর একমাত্র ছোট বোন সুমনা আক্তার, তিনিও তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। যেভাবে শহীদ হন সৌরভ ৪ আগস্ট ২০২৪ স্বৈরাচার খুনি হাসিনার নির্মম পারাজয়ের একদিন আগের এই তারিখটি শহীদ সারদুল আশিষ সৌরভের জীবনে এক মর্মান্তিক এবং ঐতিহাসিক দিন হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেদিন ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। শহীদ সারদুল আশিষ সৌরভ তার স্কুল ও কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা, এই দেশের সাধারণ জনগণের ওপর জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসা আওয়ামী ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী সরকারকে বিতাড়িত করা এবং দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরত আনা। পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী সৌরভ ও তার বন্ধুরা সেদিন দুপুর ২:৩০ মিনিটে শেরপুর সরকারি কলেজের সামনে একত্রিত হয়। সেখানে তারা আন্দোলনের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হয় এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেখান থেকে তারা ৩:৩০ এর দিকে খড়মনুর খাদ্যগুদামের সামনে গিয়ে অবস্থান নেয়। কিন্তু পরিস্থিতি হঠাৎই পাল্টে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা অতর্কিতভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। পরিস্থিতি হঠাৎ করেই সহিংস রূপ নেয় এবং চারিদিকে চিৎকার ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না এবং নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য এদিকসেদিক ছোটাছুটি শুরু করে। শহীদ সারদুল আশিষ সৌরভও এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যান এবং এই ছোটাছুটির মাঝেই পুলিশের একটি গাড়ি তাকে চাপা দিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। মুহূর্তকাল পরে ঘটনাস্থলেই তিনি জীবনের মায়া ত্যাগ করেন। সৌরভের শরীর এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, সেখানে উপস্থিত কেউই তাকে হাসপাতালে নিতে পারেনি। পুলিশের এই বর্বর আচরণের ফলে শহীদ সারদুল আশিষ সৌরভ সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন, যা তার পরিবারের জন্য চিরকালের শোক এবং অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শহীদ সম্পর্কে সামগ্রিক বর্ণনা শহীদ সৌরভ ছিলেন মেধাবীছাত্র। সবসময় পড়াশোনায় মনোযোগী এবং বিনয়ী ছিলেন। তার বড় ভাই বা ছোট বোন যেমন পরিবারের আশা ছিল, তেমনি সৌরভও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতেন। তার পরিবার ছিল সাধারণ উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার। পরিবারের প্রত্যেক সদস্য পরিশ্রম করতেন এবং একে অপরকে সমর্থন দিয়ে জীবনযাপন করতেন। তার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো এবং নিজেকে স্টাবলিশ করা। সাধারণ ছাত্র হলেও তিনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতন এবং সমাজের যেকোনো অসাম্য বৈষম্যের বিষয়ে স্পষ্ট মতামত পোষণকারী। শহীদ সৌরভের পিতামাতা দুজনই চাকরিজীবী ছিলেন, যার ফলে তাদের পরিবার আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল ছিল। তাদের কঠোর পরিশ্রম এবং দায়িত্বশীলতার ফলে পরিবারটি সুন্দর ও স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন করত। তার পিতামাতা দুজনই নিজ নিজ পেশায় নিজ নিজ স্থানে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং নিজেদের উপার্জন দিয়ে সন্তানদের শিক্ষার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। সৌরভের পরিবারে শিক্ষার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তার পিতামাতা দুজনই শিক্ষক হওয়ায় সব সময় চাইতেন তাদের সন্তানরা যেন সুশিক্ষা লাভ করে এবং জীবনে উন্নতি করে। তাদের এই আর্থিক সচ্ছলতা এবং সুস্থির পরিবারিক পরিবেশের মধ্যেই বড় হয়ে ওঠেন তারা। পরিবারটি ছিল পরিপূর্ণ এবং সুখী। শহীদ সম্পর্কে স্বজনের অনুভব-অনুভূতি শহীদ সৌরভের দাদা বলেন, 'আমার তিনজন নাতি। তার মধ্যে সৌরভ দ্বিতীয়। খুব সুন্দর চেহারা ছিল সৌরভের। উঁচু, লম্বা, সবদিক থেকে সে পুরো এলাকায় নাম্বার ওয়ান ছেলে ছিল। পড়াশোনাতেও আমার নাতি সৌরভ ১ নাম্বার ছিল। খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল সে। কখনো কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ করত, না মারামারি করত না। অনেক আদর সোহাগ করতাম আমার প্রিয় নাতিটারে। এখন আর আমাকে দাদা দাদা বলে ডাকবে না সৌরভ। আমার নাতিটারে আমি আর ফিরে পাবো না কোনোদিন। এত কষ্ট আমি কই রাখবো এখন? কী দোষ ছিল আমার নাতির?' সৌরভের মৃত্যুতে তার পুরো পরিবার শোকাহত, ব্যথিত, মর্মাহত। বুকের সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় কাতর বাবা-মা। ভালোবাসার প্রিয় ভাইকে হারানোর বেদনায় বেদনাহত ভাইবোন। পুরো পরিবারটা যেন এখন শোকের নগরী। সৌরভের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তার হত্যার সঠিক বিচার চান। হত্যাকারীর কঠিন শাস্তি চান। দেশ ও জনগণের কাছে তাদের এখন এই একটাই দাবি। শহীদ পরিবারের জন্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ১. নিয়মিত শহীদ পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া যেতে পারে। ২. শহীদের স্মৃতি সংগ্রহে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে । এক নজরে শহীদের সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল পূর্ণ নাম : সারদুল আশিষ সৌরভ জন্ম তারিখ : ৩১.১২.২০০৫ জন্মস্থান : জরাকুরা, শেরপুর শহীদ হওয়ার তারিখ : ৪ আগস্ট, ২০২৪; বিকাল: ৪টা শহীদ হওয়ার স্থান : খড়মনুর খাদ্য গুদামের সামনে, শেরপুর সদর আঘাতের ধরন : গাড়িচাপা ঘাতক : পুলিশ দাফনস্থল : নিজ বাড়ির আঙিনা পেশা : শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : সিকান্দার আলী কলেজ পিতা : মো: ছোহরাব হোসেন মাতা : শামসুন্নাহার স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: জরাকুরা, ডাকঘর: পাইকুরা, থানা: ঝিনাইগাতি, জেলা: শেরপুর ভাইবোন : ১ ভাই, ১ বোন, ভাই শাহরিয়ার আশীষ শোভন, বয়স ২৫, শিক্ষার্থী, বোন সুমনা আক্তার, বয়স ৭, শিক্ষার্থী