জন্ম তারিখ: ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ময়মনসিংহ
পেশা :রিকশা চালিক, শাহাদাতের স্থান:গ্রিন স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা।
শহীদ বকুল মিয়া ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পেশায় তিনি রিকশাচালক। ঢাকা শহরে রিকশা চালিয়ে যে ইনকাম করতেন, তা পাঠাতেন গ্রামের বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের কাছে। তার উপার্জনে বেশ ভালোভাবেই চলছিল তার সংসার। ঢাকায় তিনি থাকতেন উত্তরাতে। যেভাবে শহীদ হলেন জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে সারাদেশ উত্তাল ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পর থেকে ঢাকাসহ সারা দেশ আরো বেশি উত্তাল হয়ে ওঠে। ঢাকার রাজপথে প্রতিদিন ছাত্র-জনতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে অবরোধ-আন্দোলন। ১৮ জুলাই ২০২৪। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচির অংশ হিসেবে সারাদেশে চলছিল কমপ্লিট শাটডাউন। অন্যদিকে এই আন্দোলন দমাতে সরকার জারি করেছিল কারফিউ। কিন্তু কারফিউ ভেঙে সারা ঢাকার ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসে। বকুল মিয়া সেদিন বিকেলে তার রিকশা গ্যারেজে রেখে বন্ধুদের সাথে উত্তরার আজমপুরে যান আন্দোলন দেখার উদ্দেশ্যে। রাজনৈতিক কোনো মতবাদে কিংবা আন্দোলনে জড়িয়ে না থেকেও তিনি হঠাৎই এক নির্মম ঘটনার শিকার হন। বিকাল পাঁচটা নাগাদ আজমপুর থানার সামনে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। একটি গুলি এসে লাগে বকুল মিয়ার মাথায়। স্থানীয়রা দ্রুত গুলিবিদ্ধ বকুল মিয়াকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু তার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে চিকিৎসকরা তাকে গ্রিন স্পেশালাইজড হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেন। সেখানেই চিকিৎসা হতে থাকে তার। রাত পেরিয়ে আসে নতুন আরেকটি দিন। ১৯শে জুলাই ২০২৪। বকুল মিয়ার অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। বরং সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে তার অবস্থার অবনতি ঘটছিল। একসময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল ৩:৩৮ মিনিটে সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে বকুল মিয়া ছুটি নেন এই পৃথিবীর রঙ্গশালা থেকে। সংগ্রামী বকুল মিয়া শহীদ মোহাম্মদ বকুল মিয়ার জীবন ছিল একজন সংগ্রামী ও সাধারণ মানুষের প্রতীক, যিনি নিজের পরিবারকে ভালোভাবে বাঁচাতে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করেছেন। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ রিকশাচালক। জীবনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বকুল মিয়া ঢাকায় রিকশা চালিয়ে উপার্জন করতেন, যাতে করে তার পরিবার সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারে। বকুল মিয়ার মৃত্যুর ঘটনা শুধুমাত্র একজন নিরীহ রিক্সা চালকের জীবন হানি নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ট্রাজেডি, যা সমাজের বৈষম্য ও অবিচারকে প্রকাশ করে। বকুল মিয়ার মৃত্যুতে তার পরিবার যেন অথই সাগরে তলিয়ে যায়। তিনি ছিলেন পরিবারটির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার উপার্জনেই চলতো স্ত্রী ও দুই সন্তানের ভরণপোষণ এবং পড়াশোনা। তার পরিবার অসহায় হয়ে পড়েছে। বকুল মিয়ার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও সন্তানেরা বকুল মিয়ার দুই ভাইয়ের সংসারে ঠাঁই নিয়েছেন। তার দুই ভাই কৃষি কাজের মাধ্যমে কষ্টক্লেশে যৌথ পরিবার চালানোর চেষ্টা করেন। এমনিতেই তাদের আয় রোজগার পর্যাপ্ত নয়, তার ওপর বকুল মিয়ার স্ত্রী সন্তানের দায়িত্ব কাঁধে পড়ায় অর্থনৈতিকভাবে তারা আরো দুর্দশার মধ্যে নিপতিত হয়েছেন। আশেপাশের প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝে তাদেরকে আর্থিক সাহায্য দিলেও সেটি স্থায়ী কোনো সমাধান দিতে পারে না। শহীদ বকুলের ঘটনা শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত ট্রাজেডি নয়, বরং এটি সমাজের বৈষম্য ও অভাবের প্রকট চিত্র ।একজন দরিদ্র রিক্সাচালক, যিনি জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ঋণের বোঝা থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন, তাকে হারাতে হয়েছে তার জীবন। তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির সাথে যুক্ত না থেকেও একটি আন্দোলনের শিকার হয়েছেন। তার সংগ্রামী জীবন ও করুণ মৃত্যু আমাদের সমাজে গভীর বৈষম্য ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতীক। শহীদ বকুল মিয়ার জীবনের এই করুণ অধ্যায় শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, আমাদের পুরো সমাজের জন্য একটি বড় ক্ষতি। সমাজের প্রান্তিক মানুষদের জীবনযাত্রা কতটা কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তা বকুল মিয়ার জীবন থেকে স্পষ্ট হয়। তার ত্যাগ ও কষ্ট সমাজের বৈষম্য দূর করার জন্য আমাদের সকলের কাছে একটি অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত। শহীদ বকুল মিয়ার নাম হয়তো অনেকের স্মৃতিতে ম্লান হয়ে যাবে, কিন্তু তার আত্মত্যাগের মূল্য সমাজে রয়ে যাবে হাজার জনম। তার জীবন ও মৃত্যুর কাহিনি আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং মানবিক সহমর্মিতার একটি গভীর পাঠ হিসেবে আমাদের সামনে থাকবে চিরকাল। বকুল মিয়ার শোকাহত স্বজনেরা শহীদ বকুলের স্ত্রী মনিকা বেগমের ভাষায়, 'আমাদের সংসার ভালই চলছিল, কিন্তু গেল ঈদের পর থেকে কাজ কমে গেলে ধারদেনা করে চলতে হতো। ঋণের বোঝা বাড়তে থাকায় আমার স্বামী ঢাকায় রিক্সা চালাতে গেল, কিন্তু ফিরলো লাশ হয়ে।' এই কথাগুলো একজন নিরীহ স্ত্রীর অন্তরের যন্ত্রণা প্রকাশ করে, যিনি তার স্বামীকে হারিয়ে সংসার চালানোর সকল আশা হারিয়েছেন। বকুলের সন্তানদের পড়াশোনা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শুভ ও মিতুর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে গেছে। তাদের শিক্ষার খরচ চালানোর মতো আর কেউ নেই। শহীদ বকুলের এক প্রতিবেশী আব্দুল মান্নান বলেন, 'শহীদ বকুলের ছেলেমেয়ে আছে; তাদের সাংসারিক অবস্থা এবং পড়াশোনা সব মিলিয়ে এখন একটা এলোমেলো অবস্থা। বকুলের বাবাও খুব অসুস্থ, ধরতে গেলে একদমই শয্যাশায়ী। কোনোরকম আয়ের পথ এখন তাদের পরিবারের নেই। এ অবস্থায় তাদের আর্থিক সহযোগিতা খুবই জরুরি। এখন কোনো হৃদয়বান মানুষ বা সংস্থা যদি তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়, খুবই উপকার হবে। আর আমরা এলাকাবাসীরা তার এই নির্মম খুনের সুষ্ঠু বিচার চাই।' স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল পরিবারের অবস্থা দেখে তাদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, 'বকুলের পরিবারটি অত্যন্ত গরিব। আমি তাদের সন্তানদের পড়ালেখার খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।' তার এই কথা কিছুটা সহানুভূতির নিদর্শন হলেও বকুলের মৃত্যুতে তার পরিবারে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণ করা অসম্ভব। শহীদ পরিবারের জন্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ১. নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন ২. এতিম সন্তানদের লালনপালন ও পড়াশোনার খরচ যোগানো প্রয়োজন ৩. স্ত্রীর জন্য একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজনশহীদ পরিচিতি শহীদ বকুল মিয়ার জন্ম ১৯৮৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। তার গ্রামের বাড়ি শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার গড়জরিপা ইউনিয়নের চাউলিয়া গ্রামে। তার পিতার নাম মো: ছামছুল হক। ৭০ বছর বয়সী তার পিতা বর্তমানে শয্যাশায়ী। তার মাতা এফাতন নেছা পৃথিবীতে বেঁচে নেই। শহীদ বকুল মিয়া বিবাহিত। তার স্ত্রী মনিকা বেগম গৃহিণী। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। ১ ছেলে ও ১ মেয়ে। ছেলে মাহাদি হাসান শুভ (১২) হিফজ শিক্ষা করছে। আর মেয়ে নুসরাত জাহান মিতু (৬) প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। এক নজরে শহীদের তথ্যাবলি পূর্ণ নাম : মো: বকুল মিয়া জন্ম তারিখ : ০৫.০২.১৯৮৯ জন্মস্থান : চাউলিয়া, শেরপুর শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৯ জুলাই, ২০২৪, বিকাল: ৩:৩৮ শহীদ হওয়ার স্থান : গ্রিন স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা আহত হওয়ার তারিখ ও স্থান : ১৮.০৭.২০২৪; আজমপুর, উত্তরা, ঢাকা আঘাতের ধরন : গুলিবিদ্ধ ঘাতক : পুলিশ দাফনস্থল : নিজগ্রাম পেশা : রিকশাচালক কর্মস্থল : ঢাকা পিতা : মো: শামছুল হক মাতা : এফাতন নেছা (মৃত) স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: চাউলিয়া, ইউনিয়ন: গড়জরিপা, থানা: শ্রীবরদী, জেলা: শেরপুর স্ত্রী-সন্তান : স্ত্রী মনিকা বেগম, গৃহিণী, ১ ছেলে মাহাদি হাসান শুভ, বয়স ১২, হিফজ শিক্ষার্থী ১ মেয়ে নুসরাত জাহান মিতু, বয়স ৬, ১ম শ্রেণির শিক্ষার্থী