জন্ম তারিখ: ১১ মার্চ, ১৯৮৬
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা: ব্যবসা (ফুতপাতে গার্মেন্টস আইটেম) শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ি কুতুবখালি পকেটগেট
“ আন্দোলনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পানি পান করাতো “ শহীদ পরিচিতি ১৮ জুলাই শনির আখড়া এলাকায় নিহত হন ব্যবসায়ী ওয়াসিম শেখ। তার মাথায় গুলির আঘাতের চিহ্ন ছিল। ফুটপাতে পোশাকের দোকান ছিল তার। মারামারির কথা শুনে দোকান দেখতে এসে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তার পিতার নাম মৃত আওলাদ হোসেন। মাতা জোসনা বেগম। জুলাই বিপ্লবে আন্দোলনে কোন রকম সংশ্লীষ্টতা না থাকার পরেও তাকে প্রাণ দিতে হয়। ওয়াসিম শেখের একমাত্র কন্যা তাসনিয়া শেখ। সাত মাসের শিশুটির চোখে-মুখে শূন্যতা। বাবার স্পর্শ আর তাকে ছুঁয়ে যায় না। মুখ ফুটে বলতে না পারলেও নীরবে বাবাকে খুঁজতে থাকে শিশুটি। জন্মের ২ মাস ১২ দিন পর হারায় বাবাকে। গত ১৮ই জুলাই বিকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গুলিতে মারা যান ৩৮ বছর বয়সী ওয়াসিম শেখ। গুলিতে তার মাথার এক পাশের খুলি উড়ে যায়। এ সময় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। শনির আখড়ায় ফুটপাথে কাপড়ের ব্যবসা করে সংসার চালাতেন ওয়াসিম। একমাত্র সন্তানটিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন তিনি। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি তার। শাহাদাতের প্রেক্ষাপট আজ থেকে ৬ বছর আগে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। পুলিশ-ছাত্রলীগের হামলা-নির্যাতন মোকাবেলা করে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিলের ঘোষণা দেন। ঐ বছরের অক্টোবর মাসে সরকার কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। আওয়ামী লীগ ও তার অবৈধ সরকার দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার জন্য কোটা পদ্ধতিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তাদের পরিকল্পনা ছিল নিজেদের চাটুকার কর্মী বাহিনী এবং অনুগত ছাত্রলীগ কর্মীদের কোটা সিস্টেমের মাধ্যমে সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ প্রদান করা। শেখ হাসিনা আগে থেকে বিচারপতিদের তার অনুগত দাসে পরিণত করেছিলেন। তার নির্দেশনা পেয়ে ৫ জুন বুধবার হাইকোর্ট কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দেয়। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের ( ৯ম-১৩ তম গ্রেড) পরিপত্র অবৈধ বলে ঘোষণা করে। এরই প্রেক্ষাপটে আবারও সারা দেশ আন্দোলনে ফেটে পড়ে। ৬ জুন বৃহস্পতিবার: আদালতের রায়ের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচীতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নেয়। ৯ জুন রোববার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবারও কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি মানতে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেধে দেয়। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ঢাকায় বিক্ষোভ শেষে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি দল অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর স্মারকলিপি দিতে যায়। একই দাবিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও কর্মসূচি পালন করে। এদিন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে। ছাত্ররা জুলাই মাস জুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচী আহ্বান করে। আওয়ামী লীগ প্রত্যেক কর্মসূচীতে ছাত্রলীগ ও পুলিশের মাধ্যমে নীপিড়ন চালায়। ফলে দিনে দিনে ছাত্রদের পাশাপাশি দেশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ছাত্র ও ছাত্রীদের উপরে হামলা চালায়। ১৬ জুলাই বেশ কিছু ছাত্র নিহত হওয়ায় সন্ধ্যা ৭ টায় কালো শাড়ি পড়ে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ দেন। তিনি একবারের জন্যও আগের দিন ঘটা নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করলেন না। প্রতারণাপূর্ণ তার এ সাত মিনিটের লিখিত বক্তব্য আন্দোলনকারীদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। আন্দোলনকারীরা পরদিন সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচীর ঘোষণা দেয়। এদিন আন্দোলন সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী মাফিয়াদের সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অজস্র মানুষের গৌরবগাঁথা রচিত হয়। রাতে আইনমন্ত্রী আলোচনার জন্য আন্দোলনকারীদের প্রতি আহ্বান জানান। আন্দোলনকারীরা সাফ জানিয়ে দেয়, ‘রক্তের উপর দিয়ে কোন সংলাপ হবে না।’ তিনি বলেন, আমার চিন্তা এখন মেয়েকে নিয়ে। আমি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর পড়তে পারিনি। এখন মেয়ের কথা চিন্তা করে আমাকে চাকরি করতে হবে, না হলে মেয়েকে নিয়ে কোথায় কার কাছে যাবো। ওর বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়েকে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করাবে কিন্তু সেই ইচ্ছা তো আর পূরণ করতে পারেনি। সে তো একদিকে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, আরেক দিকে আমার সন্তান তার বাবাকে হারিয়েছে। ওর বাবার একমাত্র সন্তান ছিল। এর প্রতি অনেক টান ছিল, মেয়েও তার বাবাকে পেলে আর কাউকে চিনতো না। সারাদিন বাইরে থেকে যখন কাজ শেষে বাসায় আসতো তখন ওর বাবাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না, অনেক রাত পর্যন্ত বাবার সঙ্গে খেলতো। এখন বাবাকে দেখতে না পেয়ে চারিদিকে খুঁজতে থাকে। আমি তো মা আমি বুঝি আমার সন্তান কি চায়। হয়তো সে বলতে পারে না কিন্তু বাবা না থাকার শূন্যতা ঠিকই বুঝতে পারে। নিহতের মা জোসনা বেগম বলেন, আমি আমার সন্তানরে দুপুরের খাবার খাইয়ে দিলাম। ও বের হওয়ার সময় বলেছিল মা আমি একটু দোকান দেখে আসি যদি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় দোকানটা। এ কথা শুনে আমি তাকে বাধা দেইনি আমি খাবার খাইয়ে দিলাম কিন্তু আমার সন্তান তো আর ফিরে এলো না। এখন আমার ছোট ছেলেটি ব্যবসা চালায়। আমার সন্তান যেভাবে বেচাকেনা করতো এখন সেটি আর হয় না। এখন সবসময় মনে হয় আমার সন্তান যেন কোথায় গিয়েছে। আমাদের গ্রামে কোনো বাড়িঘর নেই, নদীতে ভেঙে গেছে। অনেক আগে আমরা ঢাকায় এসেছি। ওর বাবাও গুলিস্তানে ব্যবসা করতো। সরকার থেকে এখানো কিছু পাইনি, আমার আত্মীয়স্বজনরা কিছু সহযোগিতা করেছে। ছেলে থাকতে আগে তিন রুমের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতাম এখন একটি টিনশেডের বাসায় উঠেছি। তখন ১০ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতাম এখন ৫ হাজার টাকা দেই। এত টাকা কীভাবে জোগাড় করবো আমরা। ওয়াসিমের বোন তামান্না ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, গত ১৮ জুলাই দুপুরে খাবার খেয়ে দোকান দেখার কথা বলে বাইরে যায়। শনির আখড়ায় ভাইয়ের দোকানটি ছিল। এভাবে প্রায়ই সে আন্দোলনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পানি খাওয়াতো। আমার ভাই মারা যাওয়ার ৪ মাস আগে আমার বাবা ব্রেন স্ট্রোক করে মারা যায়। বাবা গুলিস্থানে ব্যাবসা করতো। ওইদিন বিকাল ৫টায় আমার মোবাইলে কল আসে। তখন তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি জানতে পারি। তাকে উদ্ধার করে শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। এটি শোনার পর আমরা সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিকেলে যাই। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভাইকে খুঁজতে থাকি। এক ঘণ্টা পরে মর্গে গিয়ে ভাইকে পাই। সেখানে অসংখ্য লাশ ছিল। আমার ভাইয়ের মাথার একপাশের খুলি উড়ে যায় গুলিতে। পরদিন অনেক ঝামেলার মধ্যে গিয়ে আমরা মরদেহ হাতে পাই। কাজলা ব্রিজের সামনে মারা যায়। তিনি বলেন, ফুটপাথে প্যান্টের দোকান ছিল। এই দোকানের আয় দিয়ে পরিবার চলতো। তার পরিবারে মা, তার স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। আমরা তিন ভাই দুই বোন। এই ভাই মেজো ছিল। একামাত্র সন্তান রেখে ভাই মারা যায়। বাবার মৃত্যুর ৪ মাসের মাথায় ভাই মারা গেল। পরিবারে একজনের শোক কাটাতে না কাটাতে আরেক জনের মৃত্যু হলো। এখন সবচেয়ে ভাইয়ের সন্তানটিকে দেখলে কষ্ট হয় কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই বাবাকে হারালো। ও বাবার অনেক আদরের ছিল। এখন মা, ভাবী ও তার সন্তানের চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। মা অসুস্থ, ভাবী তার ছোট সন্তানকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এখনো পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে আমরা কোনো সহযোগিতা পাইনি। প্রস্তাবনা ১. মাসিক ও এককালীন সহযোগিতা প্রদান করা ২. স্ত্রী ও সন্তানের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা একনজরে শহীদের পরিচয় নাম : ওয়াসিম শেখ পেশা : ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জন্ম তারিখ : ১৯৮৬ পিতা : আওলাদ হোসেন মাতা : জোসনা বেগম আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৮ জুলাই ২০২৪ শাহাদাত বরণের স্থান : শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ি আক্রমণকারী : পুলিশ দাফন করা হয় : মাতুয়াইল কবরস্থান বর্তমান ঠিকানা : রহমতপুর, আহমদবাগ, যাত্রাবাড়ি ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : নিজস্ব কিছু নেই