Image of কোরমান শেখ

নাম: কোরমান শেখ

জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ০০০১

শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা: মুরগী ব্যবসায়ী, শাহাদাতের স্থান : সাভার, ঢাকা

শহীদের জীবনী

কোরমান শেখ, এক সংগ্রামী আত্মার নাম। বয়সে প্রবীণ, ৬৫ বছর পেরিয়েও জীবনের প্রতিটি ধাপে লড়াই করে গেছেন। তার জন্ম হয়েছিল রাজবাড়ীর কালুখালী থানার রতনদিয়া গ্রামের নির্মল পরিবেশে। প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠলেও, জীবনের বাস্তবতা তাকে দারিদ্রের নির্মম মুখোমুখি করেছিল। “ প্রতিবন্ধী হয়েও প্রতিবাদের মশাল জ্বালিয়ে রেখেছিলেন “কোরমান শেখ জীবিকার জন্য মুরগির ব্যবসায় জড়িয়েছিলেন। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তার ছোট্ট পরিবার। পিতার দায়িত্ব পালনে কখনো পিছপা হননি, তবে হৃদয়ে বয়ে বেড়াতেন সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভ। দারিদ্রের বেড়াজালে বন্দি হয়েও তিনি বিশ্বাস করতেন, সমতার সমাজ গড়ার লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে, যেখানে তরুণেরা স্বাধীনতার নতুন সূর্যের খোঁজে পথে নেমেছিল, সেখানেই তিনি নিজের বয়স্ক শরীর নিয়ে সাহসিকতার প্রমাণ দেন। সাভারের বাসস্ট্যান্ডে তিনি ছিলেন সেই মিছিলে, যেখানে স্বৈরাচারের পুলিশি বলপ্রয়োগের সামনে প্রতিবাদের মশাল জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়েন তিনি, কিন্তু তার মৃত্যু আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায় রচনা করে। কোরমান শেখের জীবন ছিল এক সাধনার প্রতীক। দারিদ্রের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে রইলেন। আজ, তার আত্মত্যাগ গ্রামের প্রতিটি শিশুর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়, প্রতিটি সংগ্রামী হৃদয়ে প্রেরণা জোগায়। কোরমান শেখ শহীদ হয়েও আমাদের জন্য রেখে গেছেন মুক্তি আর সমতার এক অনন্ত বার্তা। শহীদের অর্থনৈতিক অবস্থা কোরমান শেখের জীবন ছিল এক দীর্ঘ দারির্দ্যের লড়াই। রাজবাড়ীর কালুখালী থানার রতনদিয়া গ্রামের নির্মল পরিবেশে তার জন্ম হলেও, সেই নির্মলতা কখনো তার জীবনের বাস্তবতায় পৌঁছায়নি। প্রকৃতি ছিল শান্ত, কিন্তু তার জীবনের প্রতিটি দিন ছিল দারিদ্রের চোরাবালিতে ডুবে থাকার সংগ্রাম। জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী কোরমান শেখের শারীরিক অক্ষমতা তাকে কখনো থামাতে পারেনি। জীবিকার তাগিদে মুরগির ব্যবসা শুরু করেছিলেন, কিন্তু তা দিয়ে সংসারের চাহিদা মেটানো ছিল এক অসম্ভব কাজ। তার ভাঙাঘর, ফাটা দেয়াল, আর অশ্রুসিক্ত রাতগুলো ছিল অভাবের গল্পের নীরব সাক্ষী। দিন এনে দিন খাওয়া ছিল তাদের জীবনের চিরচেনা চিত্র। তার দুই সন্তান—এক ছেলে ও এক মেয়ে—বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত। তাদের শিক্ষার খরচ যোগানো কোরমান শেখের কাছে ছিল এক পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ। কিন্তু পিতার মন কি কখনো হাল ছেড়ে দেয়? নিজের অক্ষম শরীর আর দারিদ্রের ঘেরাটোপে থেকেও তিনি সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। প্রতিদিন বাজারে গিয়ে মুরগি বিক্রি করতেন, আর সেই সামান্য আয় দিয়ে পরিবারের জন্য একটু সুখ খুঁজে আনতে চাইতেন। তার ভাঙা ঘরে ছাওয়া ছিল আকাশ, আর মাটিতে বিছানা। তবুও তিনি স্বপ্ন দেখতেন—একদিন তার সন্তানরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্নের গল্প একদিন থেমে গেল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে শামিল হয়েছিলেন তিনি, যেখানে নিজের জীবনের গল্পের শেষ অধ্যায় রচনা করলেন। কোরমান শেখের জীবন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় দারিদ্রের কেবলই এক সংগ্রামের নাম নয়; এটি সাহস, ত্যাগ, আর ভালোবাসার এক অনন্য গল্প। তার জীবন ও মৃত্যু দারিদ্রের অন্ধকারে জ্বলতে থাকা এক দীপশিখা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রেরণা জোগাবে। শহীদের পরিবারের সদস্যদের অনুভুতি: শহীদ কোরমান আলীর ছেলে মো রমজান বলেন, আমার বাবা সোজা হয়ে হাটতেও পারতেন না। তার মেরুদন্ডে সমস্যা ছিল। তিনি প্রতিবন্ধী ভাতা পেতেন। সাভার এলাকায় ঝামেলার কথা শুনে দুপুর ১ টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে আসতে বলে আমার ছোট বোন। বাবা বলেছিল, দোকান বন্ধ করেছি, বাসায় চলে আসব। এটাই ছিল বাবার সাথে শেষ কথা। ঢাকার সাভারে গত ২০ জুলাই কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সহিংশতায় শাহাদাত বরণ করেন। রমজান জানান, দুপুর ১ টার দিকে আমার চাচা মোতালেব বাবার গুলি লাগার বিষয়টি নিশ্চত করেন। দ্রুত সেখানে উপস্থিত হয়ে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাই। কর্তব্যরত ডাক্তার বাবাকে মৃত ঘোষণা করে। কোরমান আলীর গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ি জেলার কালুখালি থানার রতনদিয়া গ্রামে। ছয় সাত বছর ধরে ঢাকায় সাভার বাসস্ট্যন্ডে তাদের মুরগীর দোকান দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। এর আগে সবজির দোকান করতেন তিনি। বাবার পায়ে ও বুকে গুলির চিহ্ন পেয়েছি। বুকে অনেকগুলো ছররা গুলির চিহ্ন ছিলো। আর ডান পায়ে ছিল গুলির আঘাত। ঘটনার দিন রাতেই গ্রামের বাডিতে তাকে দাফন করা হয়। কোরমান শেখের পরিবারের সদস্যরা জানান, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন কোরমান শেখ। তার আয়েই এক ছেলে ও এক মেয়েসহ চারজনের সংসার চলত। ছেলে রমজান আলী জনগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ৪র্থ বিভাগের ছাত্র এবং মেয়ে বেসরকারী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ১ম বর্ষের ছাত্রী। পরিবার নিয়ে সাভারের একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। ছেলে রমজান বলেন ,আমার বাবা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এমনকি কোন আন্দোলনের সাথেও না। তার প্রশ্ন, আমার শারীরিক প্রতিবন্ধী বাবার কি দোষ ছিলো। কোরমান শেখের স্ত্রী শিল্পী আক্তার টিসিবিকে বলেন, আমার স্বামী মারা গেলো। কি দোষ ছিল। মুরগির দোকানের আয় দিয়ে আমাদের সংসার চলত। এখন আমরা কি করব। সন্তান নিয়ে কোথায় যাবো। এসময় স্বামী হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। ছেলে রমজান বলেন, ওইদিন সকালবেলা মা বাবাকে বলেছিলো, আজ দোকানে যাওয়া দরকার নাই। বাবা বলেন, দোকানে কয়েকটা মুরগী আছে , ওগুলো বিক্রির পরই চলে আসব। সেই যাওয়াই লাশ হয়ে ফিরলেন শহীদ কোরমান শেখ। গ্রামে তাদের পরিত্যাক্ত একটি ঘর আছে । এছাড়া সম্পদ বলতে কিছু নেই। যেভাবে শহীদ হলেন শহীদ কোরমান শেখ—এক নাম, যা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হয়ে থাকবে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সংগ্রামের সঙ্গী এই মানুষটি প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মাথা নত করেননি জীবনের কাছে। সাভারের এক কোণে ছোট্ট মুরগির দোকান চালিয়ে জীবিকার তাগিদে তিনি নিরলস পরিশ্রম করতেন। কিন্তু কে জানত, তার মতো এক সাধারণ মানুষের রক্তই একদিন শোষণ আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অগ্নিশিখা জ্বালাবে? সেদিন ছিল ২০ জুলাই। সাভারের আকাশ ভারী হয়ে উঠেছিল ছাত্রদের কণ্ঠে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা এই আন্দোলনে কোরমান শেখ হয়তো সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু তার হৃদয় আন্দোলনের সঙ্গে স্পন্দিত হচ্ছিল। সেই দিন, পুলিশের নির্মম গুলিতে সাভারের রাস্তাগুলো রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ গোলাগুলির আওয়াজে থমকে যায় চারপাশ। জীবন বাঁচাতে কোরমান শেখ তার দোকান ছেড়ে পাশের একটি দোকানে আশ্রয় নেন। কিন্তু বর্বরতার কাছে আশ্রয়ের দেয়াল কোনো বাধা হতে পারেনি। পুলিশের গুলি ঠিক খুঁজে নেয় তাকে। বুক আর পায়ে আঘাত হানে সেই নির্মম বুলেট। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন কোরমান শেখ। তিনি ছিলেন একজন প্রতিবন্ধী, যার জীবন ছিল সংগ্রামের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। কিন্তু সেই প্রতিবন্ধকতাও তার জীবনকে রক্ষা করতে পারেনি পুলিশের হিংস্র হাত থেকে। তার রক্তে ভিজে যায় সাভারের মাটি। এক মুহূর্তেই নিভে যায় এক সংগ্রামী জীবনের প্রদীপ। কোরমান শেখের আত্মত্যাগ আজ শুধু একটি নাম নয়, এটি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক। তার রক্তাক্ত ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মানবতা আর ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম কতটা কঠিন, কতটা মূল্যবান। শহীদ কোরমান শেখ, তোমার আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে যুগ যুগান্তর। প্রস্তাবনা ১) পরিবারের মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা দরকার ২) শহীদের ছেলেমেদের পড়াশুনার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন ৩) হত্যার বিচার যেনো দ্রুত সময়ের মধ্যে হয়। এক নজরে শহীদ মো: কোরমান আলী নাম : মো: কোরমান শেখ পেশা : মুরগী ব্যবসায়ী জন্মস্থান : গ্রাম: রতনদিয়া, থানা: কালুখালি, জেলা: রাজবাড়ী পরিবারের সদস্য : ৩ জন, এক ছেলে এবং এক মেয়ে শাহাদাতের তারিখ : ২০ জুলাই ২০২৪ শাহাদাতের স্থান : সাভার, ঢাকা কবর : গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of কোরমান শেখ

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মোঃ জালাল উদ্দিন

ইমন মিয়া

মো: ইমন

 তাহমিদ ভূঁইয়া

আবু মুজাহিদ মল্লিক

তামিম শিকদার

দীপ্ত দে

বাবু মোল্লা

জসিম ফকির

মো: মনিরুজ্জামান মোল্লা

রমজান মিয়া জীবন

মো: মাহফুজ

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo