জন্ম তারিখ: ১৩ অক্টোবর, ২০০৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : মিরপুর -১০
শহীদ শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ বিএএফ শাহীন কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখার একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলো। আহনাফ ২০০৭ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করে। তার পৈতৃক নিবাস মানিকগঞ্জ। জীবনের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত চার সদস্যের নিম্ন-মধ্যবিত্ত একক পরিবারের বড় ছেলে আহনাফ। পরিবার ও দেশের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত সে। বাবা জনাব নাসির উদ্দিন আহমেদ একজন বিক্রয় প্রতিনিধি আর মা জনাবা পারভীন একজন মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কাজ করতেন। তারা থাকতো মিরপুর মধ্য পাইক পাড়ায়। মানিকগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে একটা কাঁচাঘর ছাড়া তাদের আর কোনো ভিটেমাটি নেই। আহনাফের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে একজন ব্যবসায়ী হওয়া। সে সবসময় বলত, সে চাকরি না করে নিজের কিছু করবে, যাতে পরিবার ও দেশ তাকে নিয়ে গর্বিত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল আহনাফ। প্রথমবার টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেটে আহত হয়েও পুনরায় আন্দোলনে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল সে। মা ও খালা তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আহনাফ তাঁদের বলত, তোমাদের মতো ভীতু মা-খালাদের জন্য ছেলেমেয়েরা আন্দোলনে যেতে পারছে না। ১৯৭১ সালে যদি তোমাদের মতো মা-খালারা থাকতো, তাহলে দেশ স্বাধীন হতো না। এমন কথায় মায়ের মন কাঁদলেও ছেলের সাহসিকতায় গর্ব অনুভব করতেন। ২০২৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল আহনাফের। শহীদ হলো যেভাবে ৪ আগস্ট ২০২৪। রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে বিপুল সংখ্যক ছাত্রজনতা সমবেত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন তখন স্বৈরাচার পতনের এক দফায় পরিণত হয়েছে। স্বৈরাচারী হাসিনার আদেশে পুলিশ ছাত্রদের দমন করতে ভারী অস্ত্র নিয়ে হামলে পড়ে। সাথে যোগ দেয় ছাত্রলীগ। সমবেত ছাত্রদের একজন ছিল আহনাফ। দুপুরের খাবারের পর তিনটার দিকে আন্দোলনের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যায় আহনাফ। পৌঁনে পাঁচটার দিকে পরিবারের সাথে তার ফোনে কথা হয়। তখনও সুস্থ ছিল আহনাফ। সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিওতে দেখা যায় গুলিবিদ্ধ একটি দেহ মিরপুর-১০ থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেই ছিল আহনাফ। পেটে গুলি লেগেছিল তার। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই শাহাদাৎ বরণ করে সে। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। শহীদ সম্পর্কে বক্তব আহনাফের পরিবার এই মৃত্যুর শোকে মুহ্যমান। ছোট ভাই ইফতেখার তার ভাইয়ের গিটার আর টি-শার্ট ধরে কাঁদছে। আহনাফের মা যাকে পাচ্ছে তাকেই ছেলের ব্যবহৃত জিনিসগুলো দেখিয়ে বলছে, ‘ছেলেটা চলে গেছে, কিন্তু ঘরে রেখে গেছে অনেক স্মৃতি’। আমি একমাত্র খালামনি। আহনাফের যতই প্রশংসা করি, কম হয়ে যাবে। সে যেমন ছিল দুষ্ট, তেমন মেধাবী। নাজিয়া আহমেদ (শহীদের খালা) পারিবারিক অবস্থা আহনাফের পরিবার একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার। তার বাবা বিক্রয় প্রতিনিধি আর মা মারচেন্ডাইজার হিসেবে কাজ করে সংসার চালান। মানিকগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে একটি কাঁচাঘর ছাড়া তাদের আর কোনো ভিটেমাটি নেই। তারা কী ফিরবে আজ সুপ্রভাতে? সহপাঠীরা সবাই পরীক্ষা দিতে বসেছে। একটা ডেস্ক খালি। তাতে একটা ফুলের বুকেট। সাদা কাগজের কালো কালিতে লেখা-শহীদ শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ! কলেজের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় সবাই উপস্থিত কিন্তু নেই আহনাফ! কোথায় আহনাফ? যে ছিল প্রাণবন্ত, চঞ্চল আর উদ্যোমী। ঘাতক মাত্র ১৭ বছরের এমন একটি ফুটফুটে কিশোরকে কীভাবে হত্যা করতে পারে? তার পুরো নাম মো: শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ। সে ছিল স্বাধীনচেতা কিশোর। আর আট দশজনের মতো বাঁধা ধরা নিয়মে চাকরি করতে চাইত না সে। হতে চাইত উদ্যোক্তা। নিজেই কিছু একটা করে তাক লাগিয়ে দেয়ার ইচ্ছে ছিল খুব। কিন্তু তার সকল ইচ্ছে স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় নিষ্ঠুরতম স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পেটুয়া বাহিনীর নির্মম বুলেটের কাছে। কে জানত এই ১৭ বছরের কিশোর শহীদের রক্তের বিনিময়েই বাংলাদেশ থেকে বিদায় হবে একটি মাফিয়াতন্ত্রের। এই কিশোর শহীদ এই জাতিকে দিয়ে গেছেন মুক্তির স্বাদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতা সবুজের অভিযানের চিরসবুজ শহীদ আহনাফ। কবির ভাষায়- ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা। সত্যিই এই আধমরা জাতিকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন আহনাফের মতোই কিশোর যোদ্ধারা। শহীদ আহনাফ ছিল বাবা-মায়ের জ্যৈষ্ঠ পুত্র। বাবা নাসির উদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন বিক্রয় প্রতিনিধি। শহীদ জননী সাফাত সিদ্দিকী পারভীন ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানের মার্চেন্ডাইজার। পিতামাতার বড় আদরের তনয় ছিল সে। মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়ার ঘর আলোকিত করে অক্টোবর মাসের ১৩ তারিখ ২০০৭ সালে জন্ম হয় আহনাফের। প্রথম সন্তানকে হৃদয়ের সব আদর বিলিয়ে বড় করে তুলে তার পিতামাতা। এসএসসির পর রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজে বাণিজ্য বিভাগে তাকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। সহপাঠীদের সাথে আহনাফের ছিল অসাধারণ সখ্য। তার অনেকগুলো গুণের মধ্যে অন্যতম একটি হলো অন্যায় প্রতিবাদ করতে পারার সাহস। দীর্ঘ ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, ভোটচুরি, দুর্নীতি, খুন, অন্যায়, অত্যাচার তার কিশোর মনে ফেলেছিল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। ২০২৪ সালের জুলাই মাস। কোটা প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে আওয়ামী সরকার। ২০১৮ সালে ছাত্রছাত্রীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সকল দাবী মেনে নিলেও তার অন্তরে ছিল হিংসার আগ্নেয়গিরি। তাই ২০২৪ তালে একটি বিরোধী দলহীন নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর আবার কোটা ফিরিয়ে আনতে চাইল হাসিনা সরকার। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত ১ জুলাই থেকে। অহিংস এই আন্দোলন সহিংস হয় ১৫ জুলাই থেকে। আন্দোলনে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও পুলিশ, র্যাব সদস্যরা হামলা চালাতে থাকে। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতের পর থেকেই আন্দোলন জনমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। রাজধানী মিরপুরের ১০ নম্বর গোল চত্বর ছিল অন্যতম একটি ব্যাটেল গ্রাউন্ড। আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক কুখ্যাত সন্ত্রাসী মইনুল হোসেন খান নিখিলের ইন্ধনে বার বার হামলা চালানো হয় মিরপুরে। শহীদ আহনাফ ছিল মিরপুর সংগঠিত আন্দোলনের একজন অন্যতম সৈনিক। এর আগে রাবার বুলেট ও টিয়ারগ্যাসে আহত হয়ে বাসায় গেলে তার মা খালারা তাকে আন্দোলনে না যেতে অনুরোধ করে। ৪ আগস্ট বাংলাদেশ জুড়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অসহযোগ কর্মসূচি চলমান। এরই মধ্যে মিরপুর গোল চত্বরে ৯ দফা দাবী আদায়, গণগ্রেফতার বন্ধ ও হত্যাকারীদের বিচারের দাবীতে ৪ ঘণ্টা অবস্থান করে আন্দোলনকারীরা। মিরপুর ৪ আগস্ট শেষ পর্যন্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সবাই দেশীয় অস্ত্র, বন্দুক, শটগান নিয়ে গোলচত্বরে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে তুমুল প্রতিরোধে টিকতে না পেরে পিছু হটে নিখিলের নেতৃত্বে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। শহীদ আহনাফের মা তাকে বাসার বাইরে না যেতে বারবার তাগাদা দিচ্ছিল। চোখে চোখে রাখছিল তাকে। কিন্তু বেলা সাড়ে তিনটার দিকে রেডি হয়ে দ্রুত নিচে নেমে পড়ে শহীদ আহনাফ। বিকেলে চারটায় ফোন দিয়ে মাকে জানায় সে মিরপুর ১০ নম্বরে আছে। টেনশন না করতেও আশ্বস্ত করে সে। মায়ের সাথে তার এই কথাই ছিল সর্বশেষ কথা। এরপর তার সাথে আর যোগাযোগ করা যায়নি। সন্ধ্যা ৭:৩০ এ একটি ফেসবুক ভিডিওতে দেখা যায়- গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই শাহাদাত বরণ করেন বীর কিশোর শহীদ আহনাফ। ঘাতকের বুলেটটি লেগেছিল তার পেটে। আহনাফকে সমাহিত করা হয় মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাদির কবরের পাশে। শহীদ আহনাফের গর্বিত মা বলেন- আমার ছেলে ছিল অসাধারণ সাহসী। তার কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে। "তোমাদের মতো ভীতু মা খালাদের জন্য ছেলে মেয়েরা আন্দোলনে যেতে পারছে না। ১৯৭১ সালে যদি তোমাদের মতো মা-খালারা থাকতো তাহলে দেশ স্বাধীন হতো না! " সত্যি অসীম সাহসের বাতিঘর ছিল আমাদের শহীদ আহনাফ। ব্যক্তিগত প্রোফাইল শহীদের পূর্ণনাম : মোঃ শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ জন্ম : ১৩ই অক্টোবর ২০০৭, ঢাকা শহীদের পেশা : ছাত্র, বিএএফ শাহীন কলেজ, একাদশ শ্রেণি, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ পিতা : নাসির উদ্দিন আহমেদ (৪৭), বেসরকারি চাকুরিজীবী মাতা : পারভীন (৩৭), বেসরকারি চাকুরিজীবী স্থায়ী ঠিকানা : মানিকগঞ্জ বর্তমান ঠিকানা : ৪৪/৫, মধ্য পাইকপাড়া, মিরপুর-২, ঢাকা পরিবারের অন্যান্য সদস্য : ১ ভাই ভাই : ইফতেখার আহমেদ (১২), ছাত্র, ৬ষ্ঠ শ্রেণি শাহাদাৎ : ৪ আগস্ট বিকাল সাড়ে ৫ টায় পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে দাফন : মিরপুর-১ শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান সহযোগিতার প্রস্তাবনা ১. শহীদের পিতার জন্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান করে দেওয়া যেতে পারে ২. শহীদের ভাইকে লেখাপড়ায় সহযোগিতা করা যেতে পারে