জন্ম তারিখ: ১ মে, ১৯৮২
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা : চাকুরিজীবী, শাহাদাতের স্থান : শনির আখড়া, ঢাকা
সৈকত চন্দ্র দে, একজন সাহসী এবং বৈষম্যবিরোধী সংগ্রামী, যিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে সমাজের প্রতি প্রেরণার আলোকবর্তিকা হয়ে আছেন। তিনি ১লা মে, ১৯৮২ সালে চাঁদপুর জেলার মতলব থানার উপাদি গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মা শিখা রানী দে গৃহিনী তার পিতা দুলাল চন্দ্র দে ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ, যিনি তার সন্তানকে সততা ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতে অনুপ্রাণিত করেন। গ্রামের হিমেল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা সৈকত চন্দ্র দে শৈশব থেকেই বৈষম্যের করুণ চিত্রের মুখোমুখি হন। শহরে এসে আনন্দ হাউজিং সোসাইটিতে চাকরি জীবন শুরু করলেও তিনি সবসময় সমাজের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কাজ করার স্বপ্ন দেখতেন। ঢাকার শনির আখড়ায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার সাহসী অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। এই আন্দোলন চলাকালীন তিনি শাহাদাত বরণ করেন, ত্যাগের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়ের দাবিকে জাগ্রত করে রেখে গেছেন প্রেরণার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার এই ত্যাগ এবং সাহস আমাদের সকলের জন্য এক অসামান্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। অর্থনৈতিক অবস্থা সৈকত চন্দ্র দে ছিলেন এক সংগ্রামী তরুণ, যিনি নিজের কষ্টার্জিত আয় দিয়ে পরিবারের অভাব-অনটনের দিন কাটানোর চেষ্টা করতেন। ভিটে-মাটি হারানো এই পরিবারটির জীবনে যেন প্রতিটি দিন ছিল এক নতুন যুদ্ধ। আবাদি জমি কিংবা কোনো স্থায়ী সম্পদ না থাকায় সৈকতের ছোট চাকরিই ছিল পরিবারের একমাত্র ভরসা। সেই সামান্য আয়ে চলত তার মা-বাবা, এক ছেলে ও এক মেয়ের জীবনের ন্যূনতম চাহিদাগুলো। তার জীবন যেন ছিল দিন এনে দিন খাওয়ার মতো। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মুখে এক টুকরো হাসি ফোটানোর জন্য সৈকত দিনরাত পরিশ্রম করতেন। কিন্তু এই সংগ্রামী জীবনের গল্প শেষ হয়ে যায় ২০ জুলাই ২০২৪-এ, যেদিন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হন তিনি। সৈকতের মৃত্যু শুধু তার পরিবারের ভালোবাসার একজন সদস্যকে কেড়ে নেয়নি, বরং তাদের একমাত্র আশ্রয়কেও কেড়ে নিয়েছে। তার অনুপস্থিতিতে পরিবারের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। এক ছেলে ও এক মেয়ের লেখাপড়া আজ প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। পরিবারের জন্য প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এই দারিদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে সৈকতের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। তার আত্মত্যাগ আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকলেও, তার পরিবারের এই দুঃখের গল্প আমাদের সমাজের চোখে বড় এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। যেভাবে শহীদ হোন ২০২৪ সালের ২০ জুলাই, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোর মধ্যে যাত্রাবাড়ী ছিলো এক রণক্ষেত্র। পুলিশের তাণ্ডব এবং নৃশংস হামলায় পুরো এলাকা এক নরকে পরিণত হয়েছিল। এই দিনেই শহীদ হন সৈকত চন্দ্র দে, এক সংগ্রামী তরুণ, যিনি সেদিন তার অসুস্থ মায়ের জন্য ওষুধ আনতে শনির আখড়ায় গিয়েছিলেন। সৈকতের মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন, এবং তার প্রতিদিনের ওষুধ ছিল অত্যন্ত জরুরি। মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ থেকে তিনি রাস্তায় বের হয়েছিলেন। কিন্তু সেই যাত্রা-ই হয়ে যায় তার জীবনের শেষ যাত্রা। পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে সেদিন সৈকত আহত হন। মায়ের ওষুধ নিয়ে ঘরে ফেরার বদলে তিনি ফিরে আসেন। তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক বীর সৈনিক হিসেবে। তার মৃত্যু শুধু তার পরিবার নয়, পুরো সমাজকে শোকাহত করে। তার এই আত্মত্যাগ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতার মূল্য কতটা চড়া, আর ন্যায়ের জন্য লড়াই কতটা গুরুত্বপূর্ণ। শহীদ সৈকত চন্দ্র দে বীরত্বের এক মূর্ত প্রতীক হয়ে চিরদিন আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। শহীদ সম্পর্কে অনুভুতি একজন প্রতিবেশী জানান,শহীদ সৈকত চন্দ্র দে ছিলেন আমাদের এলাকার এক মানব দরদী মানুষ। আমরা তাকে কখনো কারো সাথে খারাপ আচরণ করতে দেখিনি। যে কোনো প্রয়োজনে তিনি সবার আগে ছুটে যেতেন, তা সে পরিচিত হোক বা অপরিচিত। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার সঙ্গে মিশে তিনি এমন এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন, যা আমাদের মুগ্ধ করত। তার মতো উদার ও মানবিক মানুষ আজকের দিনে খুব কমই দেখা যায়। আমরা তার মতো একজন মানুষকে হারিয়ে গভীর শোকাহত।" একনজরে তথ্যাবলি নাম : সৈকত চন্দ্র দে পেশা : চাকুরিজীবী, আনন্দ হাউজিং সোসাইটি জন্মস্থান : গ্রাম: উপাদি, থানা মতলব, জেলা: চাদপুর জন্মতারিখ : ০১/০৫/১৯৮২ পিতা : দুলাল চন্দ্র দে মাতা : শিখা রানী দে আয়ের সংস্থান : নেই শাহাদাতের তারিখ : ২০ জুলাই ২০২৪ শাহাদাতের স্থান : শনির আখড়া, ঢাকা