জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : ছাত্র ( প্রবাসী ) , শাহাদাতের স্থান : জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় গেইট
“টুনু নামে এক ছেলে আমাকে কল দেয়। আমাকে জানায় শ্রাবণের গুলি লেগেছে। গুলির কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো আমার। জিজ্ঞাসা করলাম, গুলিটা কোথায় লেগেছে। ভাবলাম, হাতে পায়ে লাগলে তো তাও বের করা যাবে, কিন্তু আমার প্রশ্ন শুনে ছেলেটা কেঁদে উঠলো, বলে ‘আঙ্কেল শ্রাবণের মাথায় গুলি লাগছে’। আমার আর কিছু বুঝতে বাকি থাকলো না,” কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শ্রাবণের বাবা মান্নান গাজী। ‘মা, আমি যুদ্ধে যাইতেছি’ পরিচিতি মো: শ্রাবণ গাজী (২০) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন আশুলিয়ার গেরুয়া এলাকার মো: মান্নান গাজী ও শাহনাজ বেগম দম্পতির একমাত্র ছেলে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে শ্রাবণ ছিল বড়। মালয়েশিয়ার টুঙ্কু আব্দুল রহমান ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করছিল শ্রাবণ। গত ১৬ই জুলাই দেশে আসে সে। এর আগে ২০২২ সালে সাভার ল্যাবরেটরি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৫৮ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে শ্রাবণ। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তার পরিবার তাকে উচ্চ শিক্ষার জন্য মালয়েশিয়ায় পাঠায়। ছোট বোন মহিমা এলাহীর বয়স মাত্র ১০ বছর। ঘটনা সংক্রান্ত বিবরণ ঘটনার দিন ৫ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ছাত্র-জনতার যে পদযাত্রা শুরু হয়, সেই পদযাত্রার অগ্রভাগে ছিলেন শ্রাবণ। পদযাত্রাটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাভারে পৌঁছানোর পর হঠাৎ একটি গুলি এসে শ্রাবণের মাথায় লাগলে মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে উদ্ধার করে আশুলিয়ার গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজে নেওয়া হলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পদযাত্রায় অংশ নেওয়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, সেদিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার দিকে প্রথমে পদযাত্রাটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে প্রধান ফটক হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে নেমে আসে। এরপর সেখানে কিছু সময় অপেক্ষার পর এটি ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। প্রথম দিকে পদযাত্রায় লোকসংখ্যা কম হলেও সময়ের সাথে সাথে এতে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। পদযাত্রাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। এরপর কয়েক দফায় এমএইচ হল গেটের সামনেসহ বিভিন্ন পয়েন্টে স্বল্প সময়ের জন্য বিরতি দেয়। বিরতির এই সময়গুলোতে বিভিন্ন স্থান ও এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী ও জনতা এই পদযাত্রায় যোগ দিতে থাকেন। পদযাত্রাটি যখন সাভারের নিউ মার্কেট এলাকায় পৌঁছায় তখন এতে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১০/১২ হাজারে, যা কিনা শুরুর দিকে ছিল মাত্র ৭০০ থেকে ৮০০। পদযাত্রাটি যখন সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছায় তখন এর সামনের কাতারে থাকা শিক্ষকদের ৭/৮ জনের একটি প্রতিনিধি দল সামনে থাকা পুলিশ সদস্যদের সাথে কথা বলতে এগিয়ে যান। শিক্ষকরা চেয়েছিলেন কোনো সংঘর্ষ ছাড়াই পদযাত্রাটি এগিয়ে নিতে কিন্তু শিক্ষকদের প্রতিনিধি দল কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ শুরু করে। শিক্ষকরা এসময় হাত উঁচু করে গুলি ছুঁড়তে নিষেধ করলেও পুলিশ তা শোনেনি। এক পর্যায়ে পুলিশের ছোঁড়া টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটের মুখে পদযাত্রার সামনের দিকে থাকা অনেকেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী মো: বিপ্লব হোসেনের ভাষ্যমতে, “পুলিশ যখন গুলি শুরু করে তখন পুলিশের অবস্থান আমাদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে। আমরা গুলির মুখে বেশ খানিকটা পিছিয়ে সাভারের নিউ মার্কেটের দিকে চলে আসি। তখন আশেপাশে পুলিশের আর কাউকে দেখাও যাচ্ছিল না। হঠাৎ শব্দ শুনে মনে হলো কাছাকাছি কোথাও থেকে গুলি করা হচ্ছে। আমি তখন শিমুলতলা এলাকা সংলগ্ন স্বরণিকা আবাসিক এলাকার বিপরীত দিকের রাস্তায়, অর্থাৎ নবীনগরমুখী লেনে অবস্থান করছি। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয় যে একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমি তখন সামনে এগিয়ে যাই। এগিয়ে গেলে দেখি সবাই ধরাধরি করে একটা ছেলেকে নিয়ে আসছে, তার মাথায় গুলি লেগেছে, কোনো জ্ঞান নেই।” তিনি আরও বলেন, “সময়টা তখন ২টা বা তার আশেপাশে। আমি তখনও শ্রাবণকে চিনি না। পরে দ্রুত সেই পথ দিয়ে যাওয়া একটি অ্যাম্বুলেন্স দাঁড় করিয়ে সেটিতে করে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে জানলাম ছেলেটির নাম শ্রাবণ গাজী, দেশের বাহিরে লেখাপড়া করতো সে।” শ্রাবণের বাবা মান্নান গাজী বলেন, “বেলা সাড়ে ১২টার দিকে শ্রাবণকে আমি দেখেছি ডেইরি গেটের সামনে সড়কের আইল্যান্ডের উপর বসা। হাতে একটা রড। আমি তখন ডেইরি গেটের ওভারব্রিজের উপরে। শিক্ষার্থীরা সব তখন ওখানেই। আমি শ্রাবণকে চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করেছি যেন সে দূরে না যায়, এখানেই থাকে। ওর সাথের ৩০/৪০ জন বন্ধুরাও সবাই সেখানেই ছিল। এক পর্যায়ে মিছিল সাভারের দিকে এগোলেও শ্রাবণ তখনও সেখানে বসা। ওকে স্থির দেখে কিছুসময় পর আমি নামাজ পড়তে ডেইরি ফার্মের ভিতরে চলে আসি। ভাবলাম ও হয়তো যাবে না। আমি আসার পর সম্ভবত ও আর দেরি করেনি, চলে গেছে মিছিলে।” জানাযা ও দাফন শহীদ শ্রাবণের শাহাদাতের পর গত ৫ আগস্ট ঘটনার দিন রাতে শ্রাবণকে কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার (ডেইরি ফার্ম) এলাকার স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। শহীদ শ্রাবণ সম্পর্কিত স্মৃতিচারণ একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে যেমন দিশেহারা শ্রাবণের পরিবার, একইসাথে শ্রাবণের মৃত্যুতে এলাকায়ও নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সেদিনের সকালের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঘুম থেইকা উইঠা, গোসল কইরা, নাস্তা কইরা ইউনিভার্সিটির টিচারগো লগে ইমেইলে কথা বলতেছিল শ্রাবণ। কথা শেষ কইরা আলনা থেইকা নিয়া জামা-কাপড় পড়লো। আমি কইলাম, “বাজান, তোমার না কত জামা-কাপড়, অন্য কিছু পড়ো।” পরে ওয়্যারড্রবের ড্রয়ারটা টান দিয়া মেরুন কালারের একটা গেঞ্জি পরলো। আমারে কইলো, “মা, ঘড়িডা কই?” কইলাম, তোমার ড্রয়ারে আছে।” এরপর ঘড়িডা হাতে দিয়া গায়ে সেন্ট দিয়া কয়, “মা, আমি যুদ্ধে যাইতেছি।” ১০টা ৪০ মিনিটের দিকে ঘর থেইকা বাইর হইয়া গেল।” “বাসা থেইকা বাইর হওয়ার আগে ছেলে আমারে কয়, “মা, আমি যুদ্ধে যাইতেছি”। ছেলের কথা শুইনা শরীরে কেমন জানি কাঁপুনি উইঠা গেল। ছেলের হাতটা ধইরা কইলাম, “বাজান, আমার যদি দুইডা ছেলে থাকতো, তাইলে তোমারে আমি যাইতে দিতাম। একজন গেলে আরেকজন তো আমার বুকে ফিরা আইতো। আমার তো একটাই মাত্র পোলা, তোমারে যাইতে দিলে আমি কী নিয়া থাকুম, বাজান? তুমিই তো আমার একমাত্র ভরসা।” আমি হাত ধরছি দেইখা পোলায় আমার মুখের দিকে তাকাইয়া কয়, “না মা, কোথাও যামু না, আমি ক্যান্টিনেই আছি।” এই কথা কইয়া যে পোলা আমার বাহির হইলো, আর ফিরলো লাশ হইয়া,” — কান্না জড়ানো কণ্ঠে এভাবেই ছেলের সাথে নিজের শেষ মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করছিলেন শহীদ শ্রাবণ গাজীর মা শাহনাজ বেগম। শহীদ শ্রাবণের বাবা মান্নান গাজী বলেন, “শ্রাবণ বা আমাদের কারোরই কখনো পরিকল্পনা ছিল না যে শ্রাবণ পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি করবে। শ্রাবণ দেশে থাকা অবস্থায় ভালো রেজাল্ট নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর আমরা আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে প্রায় ৬ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে শ্রাবণকে চলতি বছর মালয়েশিয়ায় পাঠাই পড়াশোনা করতে। শ্রাবণ আমার একমাত্র ছেলে। আশা ছিল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা শেষে হয়তো দেশের বাইরেই ভালো কোনো চাকরি করবে কিংবা দেশে ফিরে প্রাইভেট সেক্টরেই ভালো কিছু করবে।” “দুপুর ২টার পর আমরা সবাই ডেইরি ফার্ম ক্লাবে অপেক্ষা করছিলাম সেনাপ্রধানের ভাষণ শোনার জন্য। সেনাপ্রধানের ভাষণের সময় পরিবর্তন করা হয়েছে তখন। এর কিছুক্ষণ পর টুনু নামে এক ছেলে আমাকে কল দেয়। কল দিয়ে জিজ্ঞাসা করে আমি কোথায় আছি। এক পর্যায়ে সে আমাকে জানায় শ্রাবণের গুলি লেগেছে। গুলির কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো আমার। জিজ্ঞাসা করলাম গুলিটা কোথায় লেগেছে। ভাবলাম, হাতে পায়ে লাগলে তো তাও বের করা যাবে, কিন্তু আমার প্রশ্ন শুনে ছেলেটা কেঁদে উঠলো, বলে “আঙ্কেল শ্রাবণের মাথায় গুলি লাগছে”। আমার আর কিছু বুঝতে বাকি থাকলো না,” কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শ্রাবণের বাবা মান্নান গাজী। শ্রাবণের মা শাহনাজ বেগম বলেন, “ঘটনার দিন শ্রাবণের লগে আমার শেষ কথা হয় দুপুর দেড়টার দিকে ফোনে। নামাজ পইড়া উইঠা আমি শ্রাবণরে ফোন দেই। জিগাইলাম বাজান তুমি কই? কইলো “আমি ডেইরি গেইটে”। কইলাম, গেইট থেইকা বাজান তাড়াতাড়ি বাড়িত আসো। নামাজের পর আমরা সবাই একসাথে বইসা ভাত খাই। আমি তখন উইঠা পোলার লাইগা ভাত বাইড়া থুইয়া মহিমারে (মেয়ে) ভাত খাওয়াইতাছি। কিন্তু পোলা আর আমার আইলো না, আর কোনদিন ফিরা আইবো না আমার বুকে।” এভাবে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছেলের সাথে নিজের শেষ মুহুর্তের স্মৃতিচারণ করেন শ্রাবণ গাজীর মা শাহনাজ বেগম। যেই বিজয়ের জন্য তার ছেলে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছে, সেই সেই বিজয়গাঁথার কোথাও লেখা থাক তাদের সন্তানের এই মহান আত্মত্যাগ। এইটুকু সান্ত্বনা, একমাত্র ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই তারা আগামীর সময়টুকু বেঁচে থাকতে চান। পারিবারিক অবস্থা আর্থিকভাবে খুব একটা সচ্ছল নয় শ্রাবণের পরিবার। শ্রাবণের বাবা মান্নান গাজী দীর্ঘদিন পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন। ২০১৬ সালে পোশাক খাত ছেড়ে মাস্টাররোলে তিনি সাভারের কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের 'প্রজনন সহকারী' পদে যোগ দেন। তখন থেকেই পরিবার নিয়ে ডেইরি ফার্মের আবাসিক কোয়ার্টারে বসবাস করছেন তারা। প্রস্তাবনা ১. শহীদ শ্রাবণের ছোট বোনের পড়াশুনাসহ যাবতীয় খরচের ব্যবস্থা করা ২. শহীদ পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করে দেয়া। একনজরে শহীদ সম্পর্কিত ব্যক্তিগত তথ্যাবলি নাম : মো: শ্রাবণ গাজী পেশা : ছাত্র প্রতিষ্ঠান : টুঙ্কু আব্দুল রহমান ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি, মালয়েশিয়া বিষয় : সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বর্তমান ঠিকানা : বাসা: ডেইরি ফার্ম আবাসিক কোয়ার্টার, এলাকা: সাভার, জেলা: ঢাকা পিতার নাম : মো: মান্নান গাজী, পিতার পেশা : প্রজনন সহকারী কর্মরত প্রতিষ্ঠান : সাভারের কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামার পদবী : মাস্টার মাতার নাম : শাহনাজ বেগম মায়ের পেশা : গৃহিণী বোন : ১ জন মহিমা এলাহী, বয়স: ১০ বছর ঘটনার স্থান : সাভার আক্রমণকারী : পুলিশ আহত হওয়ার সময় : ৫ আগস্ট ২০২৪ আঘাতের ধরন : মাথায় গুলিবিদ্ধ মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : ৫ আগস্ট, ২০২৪, সাভার, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় গেইট থেকে পদযাত্রার সময়