জন্ম তারিখ: ১২ জুলাই, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা: শ্রমিক, রিক্সা চালক শাহাদাতের স্থান: গাজীপুর, শ্রীপুর, মাওনা, চৌরাস্তা
বাবা মায়ের মুখ আলোকিত করে ২০০৫ সালের ১৭ জুলাই নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার বাউসি ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত সুন্দরপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন একটি নবজাতক। তিনি ছিলেন মোঃ রাসেল। তিন ভাই বোনের মধ্যে রাসেল ছিলেন সবার ছোট। বাবা মোঃ মুন্সি মিয়া দীর্ঘদিন ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন। এমতাবস্থায় মমতাময়ী মা কঠোর পরিশ্রম করে লালন পালন করেন তার তিন সন্তানকে। এভাবে অভাব অনটনে কোন রকমে চলে যায় তাদের সংসার। দিনে দিনে বড় হয় এই তিন ভাই বোন। বড়ভাই কওছার মিয়া পেশায় একজন শ্রমিক। রাসেল মিয়াকে ও সংসারের টানাপোড়েনের জন্য খুব অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে হয়। তিনি নম্র, ভদ্র এবং পরোপকারী ছিলেন। গ্রামের সবার বিপদে আপদে আগে ছুটে যেতন। যেভাবে শহীদ হলেন জুলাই ২০২৪ জুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনে সারাদেশ ছিল উত্তাল। আর এই আন্দোলনে শুরু থেকেই রাসেল মিয়া ছিলেন সরব। তিনি মুখ বুঝে বসে না থেকে আন্দোলনের শুরু থেকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। তিনি ভাবতেন, সরকার যেন এই কোটা সংস্কারের মাধ্যমে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মেধাবীদের চাকরি পাওয়ার পথ সুগম করেন। পরবর্তীতে এই আন্দোলন যখন সরকার পতনের দিকে ধাবিত হলো তখন রাসেল আরো সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে যুক্ত হলেন। তিনি মনে করতেন যেভাবে হোক দেশের মানুষকে স্বৈরাচারী সরকার থেকে বাঁচাতেই হবে। এরই পথ ধরে আন্দোলনে অংশ নিতে ৪ আগস্ট ২০২৪ সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যোগদান করেন প্রতিবাদী সমাবেশ। জুলাই জুড়ে খুনি হাসিনার চাটুকার ও সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে ছাত্র-জনতার একাংশ ছিল অত্যন্ত ক্ষিপ্ত। তারা এদিন খালি হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে অনেকস্থানে পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ভয়াবহতা অনুভব করে হাসিনার গডফাদারেরা একে একে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে। পরদিন ৫ আগস্ট মার্চ ফর ঢাকা কর্মসূচীতে জনতা রাস্তায় নেমে আসে। রাসেল নিজেও হাসিনা খেদাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দুপুর ১ টা ৫০ এর দিকে বিজয় মিছিলে যোগদান করেন রাসেল। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, বিজয়ের এ স্বাদ বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারেননি তিনি। মিছিলের এক পর্যায়ে পুলিশের গুলির মুখে পড়েন রাসেল। একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় তার চোখে। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মাটিতে ঢলে পড়েন এই যুবক। আশপাশের কিছু জনতা তখন আহত অবস্থায় রাসেলকে হাসপাতালে নিয়ে যান বিকাল ৪:৩০ টার দিকে। কিন্তু বিধিবাম , ঐ দিনেই রাত ১১ টার দিকে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে ইহকালের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পড়ি জমান এই যুবক। শহীদ হলেন মো: রাসেল মিয়া, ঝরে গেলো আরো একটি তাজা প্রাণ। খালি হলো আরো একটি মাতাপিতার কোল। এইসব তাজা প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হলো ঠিকই কিন্তু সেই মুক্ত দেশের মুক্তির আনন্দ উপভোগ করতে পারেননি দেশের এই বীর সন্তানরা। তারই জন্য কবি হয়তো লিখেছিলেন- “উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই নিঃশেষে প্রান যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।” কেমন আছে শহীদ রাসেলের পরিবার রাসেলের বাবা মুন্সি মিয়া একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি। তার উপর পরিবারের ছোট সন্তানকে হারিয়ে পাগল প্রায় মমতাময়ী মা কুলসুম আক্তার। শোকে কাতর তার বড় ভাই বোনেরা। বাড়ির সমস্ত আঙ্গিনা জুড়ে তারা রাসেলের স্মৃতি দেখতে পায়। রাসেলের শোকে তারা দিশেহারা। দুই ছেলের উপার্জনে সংসার চালাতেন কুলসুম আক্তার। ছোট ছেলেকে হারিয়ে বড় ছেলে কওসার মিয়াই একমাত্র ভরসা। পাড়াপড়শিরা তাদের বিপদে পাশে থাকার বন্ধুকে হারিয়ে শোকে কাতর। জীবন শুরু হওয়ার আগেই হারিয়ে গেলো সম্ভাবনাময় একটি নিষ্পাপ প্রাণ। প্রতিবেশি ও স্বজনদের অনুভুতি কর্মের কারণে পৃথিবীতে মানুষ অমর হয়। মানুষ চলে গেলেও থেকে যায় তার কর্ম। তেমনি মৃত্যুর পরেও শহীদ রাসেল মিয়া অমর। এলাকাবাসীর মুখে মুখে আজও তার সম্পর্কে বন্দনা। শহিদ রাসেল সম্পর্কে তার এক প্রতিবেশী শেখ নেয়াজ বলেন- “খুব মানবিক, ভদ্র ও নম্র ছিলো সে। পরিবারের ছোট সন্তান হিসেবে অনেক দায়িত্বশীল ছিল সে। সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করতো সে।” তার ফুফাতো ভাই বলেন- “ রাসেল নামাজী ছিলেন এবং সে অত্যন্ত নম্র ভদ্র একটা ছেলে ছিলেন।” রাসেল সম্পর্কে জানতে চাইলে তার চাচাতো ভাই আরও বলেন- “তার ভেতরে প্রবল মনুষত্ব্য ছিলো। সে অন্যের বিপদকে নিজের মনে করে সবার আগে ছুটে যেতো।” সর্বোপরি মহৎ হৃদয়ের মানুষেরা বুঝি এমনই হয়, মহাকাল তাদেরকে অমর করে রাখে। তেমনি শহীদ রাসেল মিয়ার মতো মহৎ মানুষেরা পৃথিবীতে আসে স্বল্প সময়ের জন্য কিন্তু ফেলে রেখে যায় দীর্ঘ পদচিহ্ন। দেশের ক্রান্তিলগ্নে তাঁর এই অবদান জাতি আজীবন মনে রাখবেন। মহান আল্লাহ তাঁর শাহাদাতকে কবুল করে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুক (আমিন)। প্রস্তাবনা ১. বড় ভাইয়ের চাকরির ব্যবস্থা করা ২. তাদের থাকার জন্য স্থায়ী বাড়ির ব্যবস্থা করা ৩. বাবার চিকিৎসার খরচ বহন করা। এক নজরে শহীদ মো: রাসেল নাম : মো: রাসেল পেশা : শ্রমিক, রিক্সা চালক জন্ম তারিখ ও বয়স : ১২/০৭/২০০৫ আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৫ আগস্ট ২০২৪, সোমবার, আনুমানিক রাত ১১ টা দাফন করা হয় : নিজ গ্রামে-সুন্দর পাড়া স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: সুন্দর পাড়া, থানা/উপজেলা: বারহাট্টা, জেলা: নেত্রকোনা কারেন্ট এড্রেস : এমসি বাজার, মাওনা, গাজিপুর পিতা : মো: মুন্সি মিয়া মাতা : মোসা: কুলসুম আক্তার ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : নিজস্ব সম্পদ বলতে ভিটা বাড়ি ছাড়া কিছুই নেই ভাইবোনের বিবরণ : ২ জন আশা মনি (২১) এবং কাওসার মিয়া ২০