জন্ম তারিখ: ১৭ এপ্রিল, ২০০৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১০ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : ছাত্র প্রতিষ্ঠান : বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি-বিইউবিটি ডিপার্টমেন্ট : কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল -সিএসই ইন্টেক : ৫১, সেমিস্টার: তৃতীয় শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
‘মা, তুমি কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর না, আমাকেও করতে দিতে চাও না। আজকে তুমিও চল আন্দোলনে।’ শহীদ পরিচিতি ২০০৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রয়াত আবুল হোসেন ও মোসা: তানজিল আক্তারের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেন তাহমিদ আব্দুল্লাহ অয়ন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তাহমিদ সবার বড়। ছোট দুই বোন ফাতেমা তাসনিম (১৫) ও খাদিজা নুসরাত (৯) মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত। তাহমিদের বাবা আবুল হোসেন (৪৬) বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট বোর্ডের স্কোরার ছিলেন। তিনি ২০২০ সালের জুলাই মাসে করোনা মহামারির সময় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন। চার বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর তাহমিদের পড়াশোনা শেষ করার অপেক্ষায় ছিলেন মা। শিক্ষা তাহমিদ আব্দুল্লাহ অয়নের স্কুল জীবন কেটেছে রাজধানীর মিরপুর-১৪ এলাকায় অবস্থিত শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল এন্ড কলেজে। সকল প্রতিকূলতা পার করে তাহমিদ সফলতার সাথে ২০১৯ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক ও একই বিভাগে ২০২১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এরপর ভর্তি হন মিরপুর-০২ রূপনগর আবাসিক এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি-বিইউবিটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সি এস ই) বিভাগে। স্বপ্ন দেখতেন প্রকৌশল হয়ে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবেন। স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে ঠিকই তবে স্বৈরাচারের কবলে পড়ে নিজের প্রাণের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করে গিয়েছেন উদ্যমী এই তরুণ। সিএসই-৫১ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তাহমিদ। তৃতীয় সেমিস্টার শেষ করেছিলেন মাত্র। শাহাদাতের পর ক্যাম্পাস তাঁকে ভুলে যায়নি। দেশ মাতার এই তেজস্বীর নামে একটি ভবনের নামকরণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বন্ধুত্ব পরায়ণ তাহমিদ বাল্যকাল থেকে শিশুসুলভ ও বন্ধুত্ব পরায়ণ ছিলেন। পশু-পাখিকে ভীষণ ভালবাসতেন। বিড়াল ছিল তাঁর সবচেয়ে আদরের পোষা প্রাণী। শাহাদত বরণ করার পূর্বে দুটি বিড়াল পালতেন তাহমিদ। আদর করে যাদের নাম দিয়েছিলেন ব্রাউনি বেবি ও টাইগার। তাহমিদের মৃত্যুর পর তাঁর গুছিয়ে রাখা প্যান্ট শুঁকে-শুঁকে এখনও কাঁদে বিড়ালদ্বয়। ন্যায়ের পথে অবিচল খুনি হাসিনা সরকার পতনের দিন গত ৫ আগস্ট ২০২৪ বিজয় মিছিলে গুলিবিদ্ধ হন তাহমিদ। ২৪ এর গণ অভ্যুত্থানে তিনি শুরু থেকেই ছিলেন সরব। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এই অকুতোভয় যোদ্ধা। মায়ের বকুনি, সন্ত্রাস পুলিশের লাঠিচার্জ ও ছররা গুলিও থামাতে পারেনি এই তরুণ তুর্কিকে। ছেলের নিরাপত্তা নিয়ে তীব্র ভয়ে ছিলেন তাঁর মা। একদিন বের হওয়ার সময় মা’কেও আন্দোলনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন নবীন এই মুক্তিযোদ্ধা। বলেছিলেন, ‘মা, তুমিও আন্দোলনে চল।’ উত্তরে মমতাময়ী মা তানজিল আক্তার বলেছিলেন- ‘তোমার বাবা নেই। যদি আমরা মরে যাই! তোমার বোনদের কে দেখবে?’ মায়ের এই প্রশ্নের জবাবে তাহমিদ বলেছিলেন, ‘ওদের আল্লাহ দেখবেন, তুমি চল।’ মা যেতে চাননি দেখে রাগ করে বলেছিলেন, ‘মা, তুমি কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর না, আমাকেও করতে দিতে চাও না।’ যেভাবে শহীদের কাতারে নিজেকে শামিল করলেন তাহমিদ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর মিরপুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘাতক পুলিশ ও স্থানীয় নরখাদক আওয়ামী লীগ কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছিল। এর মধ্যে গত ১৯ ও ২০ জুলাই ২০২৪ মিরপুর রণক্ষেত্র তৈরি হয়। তাহমিদের বাড়ির গলিতে কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় পুরো রাস্তা অন্ধকার করে দেয় পেটুয়া পুলিশ বাহিনী। আগস্টের দ্বি-জবানবন্দী ঘটনা প্রবাহ-১: ৪ আগস্ট ২০২৪ পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি পায়ে ঢুকে আহত হন তাহমিদ আব্দুল্লাহ অয়ন। এরপর ব্যান্ডেজ পায়ে বাসায় ঢোকেন। শোয়া থেকে উঠতে গিয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে গেলে আঘাত পাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন তাঁর মা। জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারেন, পায়ে ছররা গুলি ঢুকেছিল। তবে স্থানীয় ক্লিনিক থেকে গুলি বের করা হয়েছে। তাহমিদের মা বলেন- ‘একদিন পুলিশের লাঠিপেটায় আমার ছেলে ভীষণ আহত হয়। তবুও আমাকে কিছু জানায়নি ও। ঘটনা প্রবহ-২: ৫ আগস্ট ২০২৪, দুপুর তিন ঘটিকা। বন্ধুদের সাথে মিরপুর এলাকায় স্বৈরাচার হাসিনা পতনের আনন্দ মিছিলে যোগ দেন তাহমিদ। বিজয় মিছিলকে কেন্দ্র করে আওয়ামী দালাল পুলিশ বাহিনী অতর্কিত গুলি চালায়। মিরপুর মডেল থানা থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হলে বন্ধুদের থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। গুলি শুরু হওয়ার পর দৌড়ে একটি খাম্বার আড়ালে আশ্রয় নেন। এ-সময় ঘাতক পুলিশের গুলি থেমে গেলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। উঠামাত্র নরপিশাচ পুলিশের বুলেট তাঁকে এফোঁড়ওফোঁড় করে। বুকের বাম ও ডানপাশে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পথমধ্যে জনৈক ব্যক্তি তাহমিদকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করেন। এরপর তাঁকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) সুবিধা না থাকায় অন্য হাসপাতালে ফেরত পাঠান হয়। পরবর্তীতে তাহমিদকে তিনি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। তাঁর বন্ধুরা হয়রান হয়ে খুঁজে না পেয়ে একপর্যায়ে মুঠোফোনে কল করেন। ওঁই ব্যাক্তি ফোন ধরে বলেন- ‘আপনারা দ্রুত হাসপাতালে এসে রক্ত জোগাড় করেন। এরপর তাহমিদের অবস্থার অবনতি হলে সন্ধ্যা ৬টার দিকে মহাখালী জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ফুসফুস থেকে গুলি বের করেন। তবুও অবস্থার উন্নতি হয় না। বাধ্য হয়ে দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁকে চারদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১০ আগস্ট ২০২৪ দুপুর ১:১৫ মিনিটে শাহাদাতের সুধা পান করেন নব জাগরণের চির অজেয় বীর শহীদ তাহমিদ আব্দুল্লাহ অয়ন। নিকটাত্মীয়ের অভিব্যক্তি শহীদের প্রতিবেশী হাজেরা চৌধুরী বলেন, “তাহমিদের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত অনেক স্মৃতির সাক্ষী আমি। ওর বাবা আবুল ভাইয়ের মতো ওকেও কোন কিছু জিজ্ঞেস করলে আগে বড় করে হাসি দিত। তারপর কথা বলত।” শহীদের বন্ধু ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন- “বিশ্বাস করতে পারতেছি না, বন্ধু তুই আর নেই, আল্লাহ তোরে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। সবাই তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করবেন।” তাহমিদের মা তানজিলা আক্তার বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর আমার জীবন অনেক এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। এরপরও সন্তানদের দিকে তাকিয়ে সাহস যোগান দেই। ওর বাবার সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল তাহমিদের। তার হঠাৎ মৃত্যুর পর পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ বেড়ে যায় আমার ছেলের। সবসময় পড়াশোনা শেষ করে সংসারের হাল ধরার তাগিদ ছিল ওর। আর্থিক অনটনের মধ্যে ছেলে-মেয়েদের বড় করছি। শুধু আক্ষেপ হয়, আন্দোলনের শেষে তাহমিদ গুলিবিদ্ধ না হলে কী হতো! এত কষ্ট করেও ছেলেটা আমার বিজয় উদ্যাপন করতে পারল না! সেদিন দুপুরে ভাতের সঙ্গে আলুভর্তা, লালশাক আর মুড়িঘণ্ট রান্না করেছিলাম। আমার ছেলে লালশাক দিয়ে মাখাভাত কিছুটা খেয়ে বের হয়েছিল। আমাকে বলেছিল- ‘মা, আমি বাকি ভাত এসে খাব।’ পারিবারিক ও আর্থিক বিবরণ রাজধানীর মিরপুর-২ এলাকার এইচ ব্লকে শহীদ তাহমিদের প্রয়াত পিতার পৈতৃক বাড়ি অবস্থিত। ব্লকের চওড়া গলির দুই পাশে সারি-সারি দুটি বহুতল ভবনের মধ্যখানে একমাত্র সেকেলে একতলা বাড়ি এটি। পিতামাতার একমাত্র সবেধন নীলমণি ছিলেন তাহমিদের পিতা। সেই সূত্রেই বাড়িটি এখন তাঁদের। লোহার ফটকের দরজা ও একচিলতে সরু জায়গায় দুই পাশে সারিবদ্ধ সাতটি কক্ষ বিশিষ্ট ঘর। দুটি কক্ষে শহীদ জননী কন্যাদ্বয়কে নিয়ে থাকেন। আর পাঁচটি কক্ষ ভাড়া দিয়েছেন। বর্তমানে স্বামী-সন্তান হারানো তানজিল আক্তারের পরিবারটি এই ভাড়ার অর্থেই যাপিত জীবনের সুখ খুঁজে চলেছেন। তাহমিদকে নিয়ে মিডিয়ায় প্রচারিত নিউজ লিংক সমূহ 1. https://www.prothomalo.com/bangladesh/a3xuj0d9ci 2. https://bonikbarta.com/bangladesh/D8XAA1WLiaQH3jzG 3. https://bn.wikipedia.org/wiki/QvΖRbZvi_Afz¨Ìv‡b_wbnZ‡`i_ZvwjKv একনজরে শহীদ সম্পর্কিত তথ্যাবলি নাম : তাহমিদ আব্দুল্লাহ অয়ন পেশা : ছাত্র প্রতিষ্ঠান : বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি-বিইউবিটি ডিপার্টমেন্ট : কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল -সিএসই ইন্টেক : ৫১, সেমিস্টার: তৃতীয় জন্ম তারিখ : ১৭ এপ্রিল ২০০৩, বয়স: ২১ বছর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা : মহল্লা: মিরপুর ০২, ব্লক: এইচ, থানা: মিরপুর, জেলা: ঢাকা পিতা : মৃত আবুল হোসেন (৪৬), জীবিত অবস্থায় পেশা: বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট বোর্ডের স্কোরার মাতা : তানজিল আক্তার, পেশা: গৃহিণী বোন : ১. মোসা: ফাতেমা তাসনিম, বয়স: ১৫ বছর, পেশা: ছাত্রী, প্রতিষ্ঠান: মাদরাসা : ২. মোসা: খাদিজা নুসরাত, বয়স: ০৯ বছর, পেশা: ছাত্রী, প্রতিষ্ঠান: মাদরাসা সম্পদের পরিমাণ : পৈতৃক সাত কক্ষ বিশিষ্ট একতলা জরাজীর্ণ বাড়ি পরিবারের মাসিক আয় : ১৫০০০ টাকা, আয়ের উৎস: বাসা ভাড়া আহত হওয়ার সময় : ৫ আগস্ট ২০২৪, আনুমানিক দুপুর ৩:০০টা ঘটনার স্থান : মিরপুর-০২ থানা সংলগ্ন, ঢাকা আক্রমণকারী : পুলিশ আঘাতের ধরন : বুকে গুলি (তিনটি), ২টি ফুসফুস ভেদ করে বেরিয়ে যায়, ১টি বিদ্ধ অবস্থায় ছিল আঘাতকারী : মিরপুর থানার ঘাতক পুলিশ বাহিনী চিকিৎসা সেবা নেওয়া হাসপাতাল সমূহ ১. কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা ২. জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট, ঢাকা ৩.ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-ঢামেক শাহাদাতের তারিখ, সময় ও স্থান : ১০ আগস্ট ২০২৪, দুপুর ১:১৫ মিনিট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, আইসিইউ শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : মিরপুর, ঢাকা প্রস্তাবনা ১. বোন দ্বয়ের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেওয়া যেতে পারে ২. জরাজীর্ণ বাড়িটির সংস্কার কিংবা পুনঃনির্মাণ করে দেওয়া যেতে পারে ৩. পরিবারের মাঝে মাসিক বা এককালীন আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে