জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ময়মনসিংহ
পেশা : জুতার কারখানার শ্রমিক শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল - ঢামেক
‘ওর ছোট একটা বোন লেখাপড়া করছে কে দেখবে এখন ওদেরকে? শহীদ পরিচিতি ইসমাইলের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৌরব উপজেলার জগন্নাথপুরে। তবে জন্ম ২০০৮ সালে রাজধানীর কামারাঙ্গীচর এলাকায়। বাবার নাম জসিম (৪০) ও মায়ের নাম তাসলিমা আক্তার (৩২)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন এই তরুণ তুর্কী। ইসমাইলের রশ্নি নামের সাত বছরের একটি বোন আছে। তারা ভাই-বোন মিলে মায়ের সাথেই থাকতেন। সংসারের হাল ধরতে জুতার কারখানায় কাজ করতেন এই বীর যোদ্ধা। শহীদ জননী বর্তমানে বাসা-বাড়ির গৃহ কর্মী হিসেবে চাকরি করেন। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা তিনি। থেকে থেকেই কেঁদে ওঠেন। প্রায় চার মাস হতে চলল। তবুও কোথাও যেন সান্তনা মেলে না। কান্না থামে না অসহায় এই শহীদ জননীর। আহাজারিতে কেঁপে ওঠে মাটি, আকাশ ও বাতাস। সন্তানের কথা মনে হলেই তিনি কান্না শুরু করেন। প্রতিবেশীরাও তার কান্না থামাতে গিয়ে ফেরেন অশ্রুসিক্ত নয়নে। স্বজনেরাও মর্মাহত হয়ে ভেঙ্গে পড়েছেন। ইসমাইলের মৃত্যুর পরে তাঁর মা তাসলিমা ও ছোট বোন রশ্নি এখন ঢাকা উদ্যানে ইসমাইলের নানা-নানী ও দুই মামার সাথে বসবাস করছেন। রশ্নি স্থানীয় ফুল কলি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। যেভাবে শহীদ হন ইসমাইল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শামিল হয়ে গত ১৯ জুলাই ২০২৪ রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম নগরী মোহাম্মদপুরে ‘আল্লাহ করিম’ মসজিদের পাশে পুলিশের গুলিতে শহাদাত বরণ করেন বীর যোদ্ধা ইসমাইল (১৭)। সেদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়ে কারখানায় যান ইসমাইল। বেতনের টাকা তুলে তার সম্পূর্ণই দেন মায়ের কাছে। এরপর মায়ের হাতে মাখানো ভাত খেয়ে আবারও বের হন তিনি। যাওয়ার সময় মা’কে বলেন- ‘নানীর বাড়িতে যাচ্ছি।’ যা মোহাম্মদপুর, ঢাকা উদ্যানের পাশে অবস্থিত। এরপর, মানুষের বাসা-বাড়ি থেকে কাজ করে ফিরে আসেন ইসমাইলের মা। বাসায় ছেলেকে না পেয়ে ফোন দেন। কয়েকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেন না ইসমাইল। চিন্তায় কাতর হয়ে পড়েন তাসলিমা আক্তার। বাসার আশেপাশের মানুষকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন আমার ছেলে কি বাড়িতে এসেছিল। প্রতিবেশীরা বলেন, আমরা কেউই-তো দেখিনি। এরপর রাত ৯ টার দিকে তার এক বন্ধু ফোন করে জানায়, ইসমাইল পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে। খবর পেয়ে তাঁর মা মোহাম্মদপুরে গিয়ে অনেক খোঁজাখুজি করেও লাশ খুঁজে পান না। আশেপাশের লোকজন থেকে জানতে পারেন অনেক গুলিবিদ্ধ আহত ব্যক্তিদেরকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পাগলের মত সন্তানকে খুঁজতে হাসপাতালে যান তিনি। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন ওয়ার্ড, বিভাগ ঘুরে-ঘুরে রাত ১ টার দিকে সন্তানের লাশ সনাক্ত করেন দুঃখিনী মা। পরবর্তীতে ২০ জুলাই ২০২৪ ময়না তদন্ত শেষে করে আসরের নামাজের পর আজিমপুর কবরস্থানে শহীদ ইসমাইলকে দাফন করা হয়। আন্দোলনের দামামা দেশের জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। ১৯৪৭-২০২৪ সবখানেই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব ছিল। ২৪ এর আন্দোলনের শহীদ ও গাজী শিক্ষার্থীদের প্রথমবারের যাত্রা শুরু হয় ২০১৫ সালে। তৎকালীন স্বৈরশাসক খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন থেকে তাদের যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখে এ-অনুজরা। ২০২৪ এর কোটা সংস্কার আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ১৫’র শিক্ষার্থীদের। ২ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে আন্দোলনের দামামা বেজে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। (২ জুলাই - ৫ আগস্ট) দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষনা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংগঠন। কর্মসূচী ভেস্তে দিতে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট, ছড়রা গুলি, গুম, খুন, নির্যাতন, মামলা করে ছাত্র-জনতাকে হয়রানি করে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পালিত গুণ্ডা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দেশীয় অস্ত্র ও রাইফেল নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে আওয়ামীর দাগী সন্ত্রাসীরা। দীর্ঘদিন আন্দোলন চলার ফলে ভীতি সঞ্চারিত হয়ে ৫ আগস্ট ২০২৪ কারফিউ ঘোষণা করে তৎকালীন খুনি শাসক শেখ হাসিনা। সেই কারফিউ ভেঙে রাজধানীর অলিগলিতে অবস্থান নেয় আপামর ছাত্র-জনতা। এরপর বেলা দুইটায় গণমাধ্যমে খবর আসে, পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন রক্তখেকো হাসিনা। খবর পেয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে ছাত্র-জনতা বিজয় উল্লাস, মিষ্টি বিতরণ করে। পরিবারের অনুভূতি শহীদ ইসমাইলের মা তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘সেদিন মেডিকেলে পুলিশের ভয়ে কান্না করতে পারি নাই। নিজের সন্তানের লাশ দেখে চুপ করে থাকতে বাধ্য করেছিল পুলিশ। ছেলেটার গলায় ওরা গুলি করেছে। যে কারণে আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।অন্তরটা ভেঙ্গে যাচ্ছিল। ছেলেডারে নিয়ে আমার তো অনেক আশা ছিল। ছেলে কাজ করে সংসার চালাবে। আমাদের অভাব-অনটন দূর করবে। সে ইচ্ছা যে, এভাবে শেষ হয়ে যাবে, তা কে জানত। এখন আমি কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব? আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচবো? মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। আমার ছেলে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিল। সংসারের অভাবের কারণে আর পড়ালেখা করতে পারেনি। পরে ইসলামপুরে জুতার কারখানায় কাজ শুরু করে। ওর বাবা সংসারের প্রতি উদাসিন ছিল। সে সংসারের কোন খরচ দিত না। সন্তানটা নিহত হওয়ার পরে হাসপাতালে পর্যন্ত যায়নি। এরপর থেকে আমাদের সাথে তার কোন যোগাযোগও নেই। ইসমাইলের নানী ঝর্ণা জানান, ইসমাইল অনেক ভালো ছেলে ছিল। সে যে এভাবে পুলিশের গুলিতে মারা যাবে আমরা মেনেই নিতে পারছি না। যখন ওর মৃত্যুর খবর শুনেছি আমি খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। ইসমাইল ছাড়া আমার মেয়ের পরিবারটিকে দেখার মতো কেউ নাই। ওর ছোট একটা বোন লেখাপড়া করছে। কে দেখবে এখন ওদেরকে? দেখার তো আর কেউ রইলো না। নাতিটা মারা যাবার পর মেয়ে ও নাতনীকে এই এলাকায় নিয়ে এসেছি। এক রুমের একটি বাসা ভাড়া করে দিয়েছি। আমার সংসারই চলে না, ওদের দুইজনকে কিভাবে খাওয়াব, পরাব? আমার দুইটা ছোট ছেলে। তারাই কাজ করে সংসার চালায়। আমরাই ঠিক মত খেতে পারি না। আবার এখন ওরা দুইজন এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতি শহীদের পরিবার বর্তমানে রাজধানীর নবীনগর এলাকায় বসবাস করছেন। নিচ তলায় একটি একরুমের বাসায় ভাড়া আছেন পরিবারটি। রুমের মধ্যেই রান্না ঘর। ছোট এই রুমের ভাড়া সাড়ে ৩ হাজার টাকা। তেমন কোন আলো বাতাস প্রবেশের জায়গাও নেই। স্যাঁতসেঁতে একটা পরিবেশ। নেই কোন উল্লেখযোগ্য আসবাবপত্র। বাসার অবস্থা দেখলেই বোঝা যাবে কি নিদারুণ কষ্টে চলছে শহীদ পরিবারটি। শহীদ ইসমাইলের মা তাসলিমা আক্তার বলেন, আমার ছেলে কারখানায় কাজ করে সব টাকাই আমারে দিত। আর আমি বাসা বাড়িতে কাজ করে যা টাকা পাইতাম তা দিয়েই আমাদের সংসার চলত। সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে মেয়েকে নিয়ে একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারব। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই। আমার ছেলে তো দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। তাকে যেন শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। আমার ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মোহাম্মদপুর থানায় ১৫ জনের নামে মামলা করেছি। কত জনের নামে এবং কার কার নামে মামলা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর বাইরে আমার কিছু মনে নেই। আমি ওই ফাইলগুলো বের করতে চাই না। ওগুলো দেখলে আমার বুকের মধ্যে অনেক কষ্ট বেড়ে যায়। এ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাসলিমা আক্তার। রশ্নি গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেন। প্রস্তাবনা ১. শহীদের পরিবারকে মাসিক সহযোগিতা করা যেতে পারে ২. শহীদের একমাত্র বোনকে লেখাপড়ায় সহযোগিতা করা প্রয়োজন ৩. শহীদের মায়ের কর্মসংস্থান করে দেওয়া যেতে পারে ৪. মাসিক বা এককালীন সহযোগিতা করা যেতে পারে একনজরে শহীদ সম্পর্কিত তথ্যাবলি নাম : মো: ইসমাইল জন্ম : ২০০৮ সাল, বয়স: ১৭ বছর পেশা : জুতার কারখানার শ্রমিক স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: জগন্নাথপুর, উপজেলা: ভৌরব, জেলা: কিশোরগঞ্জ বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: নবীনগর, ঢাকা পিতা : মো: জসিম, পেশা: ভবঘুরে, বয়স: ৪০ বছর মাতা : তাসলিমা আক্তার , বয়স: ৩২ বছর, পেশা: গৃহকর্মী বোন : মোসা: রশ্নি আক্তার, বয়স: ০৭ বছর, পেশা: ছাত্রী, শ্রেণি: প্রথম সম্পদের পরিমাণ : পৈতৃক কোন জায়গা-জমি নেই আহত হওয়ার সময় : ১৯ জুলাই ২০২৪, আনুমানিক দুপুর ৩:০০টা ঘটনার স্থান : মোহাম্মদপুর আল্লাহ করিম মসজিদ সংলগ্ন, ঢাকা আক্রমণকারী : আওয়ামী মদদপুষ্ট পুলিশ বাহিনী চিকিৎসা সেবা নেওয়া হাসপাতাল : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-ঢামেক শাহাদাতের তারিখ ও স্থান : ১৯ জুলাই ২০২৪, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-ঢামেক লাশ হস্তান্তর; ১৯ জুলাই ২০২৪ ( লাশ আটকে রাখতে চেয়েছিল পুলিশ বাহিনী ) শহীদের কবরের অবস্থান : আজিমপুর কবরস্থান, ঢাকা