জন্ম তারিখ: ৩১ ডিসেম্বর, ২০০০
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : রিকশাচালক শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
“ছেলের লাশ আনতে গেলে আমাদেরকে মানুষ মনে করেনি যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মাহবুব। বারবার দূরদূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। এমন দুর্ব্যবহার করেছে আমাদের সাথে- মনে হচ্ছিল যে আমরা মানুষ নয়, আমরা যেন কুকুর।” শহীদ পরিচিতি বুকাবুনিয়া বাংলাদেশের বরগুনা জেলার অন্তর্গত বামনা উপজেলার একটি ইউনিয়ন। অত্র ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুরা গ্রামটি যেন প্রাকৃতিক নৈসর্গিক ভুমি। সৌন্দর্য বর্ধিত এই গ্রামের হাজিবাড়ি মহল্লা যেন ২৪-এর বিপ্লবী এক অভ্যুত্থানের অনন্য সাক্ষী। স্বৈরাচার পতনের এক জাগরণী ইতিহাস রচনা করেছেন গ্রামটির সাধারণ এক রিকশাচালক। যা আজ দেশ ও দেশের বাইরে তাঁকে প্রশংসনীয় করে তুলেছে। মহাবীরের যাপিত জীবন ছিল খুবই সাধারণ। পিতা-মাতা আদর করে তাঁর নাম রেখেছিলেন শাকিল। ৩১ ডিসেম্বর ২০০০ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত কুমিল্লার প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে মৃত দুলাল ও হেলেনা দম্পতির ঘর আলোকিত করে জন্ম নিয়েছিলেন এই তরুণ তুর্কী। জন্ম পরবর্তী দিনগুলো দিনমজুর দম্পতির ঘরে একে একে জন্ম নেয় শারমিন(২৫), সাকিল(২৪), তানিয়া(১৮) ও জীবন (১৩)। দারিদ্রতা ঘুচাতে জনাব দুলাল স্ত্রী ও সন্তানদেরকে নিয়ে পাড়ি জমান রাজধানী শহরে। নিরলশ প্রচেষ্টা আর পরিশ্রম তাঁকে নিতিবান করে গড়ে তোলে। নতুন করে সংসার গড়তে পরিবারকে নিয়ে ওঠেন যাত্রাবাড়ী এলাকায়। সেখানেই রচিত হয় নতুন জীবনের পটভূমি। গ্যারেজ থেকে ভাড়ায় চালিত রিক্সা নিয়ে শুরু করেন জীবন যাত্রা। সংসারের উন্নতি সাধনে শহীদ জননীও যেন কম নয়। গৃহকর্মীর কাজে নিজেকে শপে দিয়ে চার সন্তানের খরচাদি যোগানে তিনিও ছিলেন সমানে সমান। হঠাৎ জীবনে ছন্দপতন আসে। সাকিলের পিতা প্রিয়জনদেরকে ছেড়ে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পাড়ি দেন। ফলে সন্তানদের ভবিষ্যতের পথ বাধাগ্রস্থ হয়। জননীর একক উপার্জনে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া চালান সম্ভব না হলে একেএকে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে শারমিন, সাকিল ও তানিয়া। জীবনের বয়স তখন কয়েক মাস। অভাব অনটনে তার আর স্কুলেই যাওয়া হয়নি। বর্তমানে জীবন ১৩ বছরের এক ফুটফুটে শিশু। আর্থিক সংকুলান না থাকায় সে এখন বেলচা কারখানার শিশু শ্রমিক। সাকিলের বড় বোনের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। মেঝো বোনের বিবাহ হলেও স্বামীর সাথে বনাবনি না হওয়ায় বিচ্ছেদ হয়েছে। বর্তমানে তিনি মায়ের সাথেই রয়েছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর নদী ভাঙ্গনে ঘর-বাড়ি সর্বস্ব হারিয়েছেন হেলেনা বেগম। মাথা গোঁজার ঠাই ও দু-মুঠো ভাতের অভাবে বাল্যকালেই সাকিলের হাতে রিক্সা তুলে দেন তার জন্মদাত্রী মা। শাহাদাত বরণের পূর্বে সেই ভাঁড়ায় চালিত রিক্সাই ছিল তাঁর একমাত্র উপার্জনের সম্বল। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদেরকে নিয়ে স্থায়ি ভাবে ভাইয়ের বাসা বরগুনায় উঠেছিলেন শহীদ জননী। ফলে সেই ঠিকানাই ছিল সাকিল ও তার পরিবারের একমাত্র স্থায়ি ঠিকানা। বর্তমানে শহীদ পরিবারটি সেখানেই অবস্থান করছে। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মূল প্রেক্ষাপট হলো শিক্ষার্থীদের ওপর চলমান বঞ্চনা এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ন্যায্য সুযোগের অভাব। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থার অপ্রতুলতা, উচ্চশিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ না পাওয়া ইত্যাদি সবই এ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। হাজারো শিক্ষার্থী বৈষম্যের শিকার হয়ে নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে হতাশায় ভুগছিল এবং তাদের এই হতাশা থেকে শুরু হয় এক বিশাল এক অভ্যুথান। যা অল্প সময়ে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সমান অধিকার। বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের জন্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দৃঢ়ভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করে। এর ফলে সরকার ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়। একদিকে সরকারের প্রতিশ্রুতি ও অব্যবস্থাপনা আর অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের বঞ্চনা ও হতাশা। এ দুটি বিষয়ই এ আন্দোলনকে উস্কে দেয়। এই আন্দোলনের অন্যতম ট্র্যাজেডি হলো শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের আহত ও নিহত হওয়া। আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানালেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিপীড়ন ছিল অত্যন্ত নির্মম। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং পুরো জাতির মনে আন্দোলনের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ২৪ এর বিপ্লবে এক মহা জাগরণ তৈরি করেছিল দেশের আপামর জনতা। নানা বর্ণ-পেশার মানুষেরা দলেদলে এই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। তেমনি এই আন্দোলনের সম্মুখ যোদ্ধা ছিলেন রিক্সা চালক সাকিল। আন্দোলনকে বেগবান করতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার নানামুখী কর্মসূচীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন জাতীর দুর্দিনের এই রাহাবার। ১৮ জুলাই ২০২৪। মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খেয়ে বের হন শাকিল। গ্যারেজ থেকে রিক্সা নিয়ে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালি ও তার আশেপাশে ঘাম ঝরিয়ে ১৭০ টাকা উপার্জন করেন। এরপর বাড়িতে মায়ের কাছে টাকা দিয়ে আবারও বের হন। পথমধ্যে আন্দোলন দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না সাকিল। দুপুর দুইটায় গ্যারেজে রিক্সা রেখে ছাত্র-জনতার উপচে পড়া আন্দোলনে যোগদান করেন তিনি। কুতুবখালি বড় মাদরাসা সংলগ্ন এলাকা তখন লোকে লোকারণ্য। হঠাৎ চারিদিক থেকে আওয়ামী বাহিনীর আগমন ঘটে। ঘাতক পুলিশের সাথে মিশে এলোপাথাড়ি গুলি, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, নিক্ষেপ করে তারা। মুহূর্তে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে ছাত্র-জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘাতক পুলিশের একটি গুলি তাঁকে এফোঁড়ওফোঁড় করে। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। গুরতর জখম অবস্থায় সাকিলকে উদ্ধার করে তাঁর এক প্রতিবেশী। প্রাথমিক ভাবে আজগর আলী মেডিকেল হাসপাতলে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হতে থাকে সাকিলের। হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেলে ফেরত পাঠান হয়। ঢামেকের চিকিৎসকেরা পুলিশি কেস জানিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে ফেলে রাখে। চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতালের বারান্দায় শাহাদতবরণ করেন জাতীর এই পথ প্রদর্শক। রাত নয়টায় মুঠোফোনে ছবি তুলে সাকিলের বাড়িতে আসেন উদ্ধারকারী প্রতিবেশী। ছেলের এই অবস্থা দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তাঁর মা। এরপর ঢামেক প্রাঙ্গণে বড় মেয়ের জামাই ও প্রতিবেশীকে নিয়ে ছেলের লাশ আনতে যান হেলেনা বেগম। পুলিশ হুমকি ধামকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। এবং জানায় আন্দোলন থেমে গেলে লাশ ফেরত দেওয়া হবে। এরপর ১৮ জুলাই গভীর রাত পর্যন্ত ওসি মাহবুবের কাছে অনুনয় বিনয় করে শহীদ জননী। তবুও তার মন গলে না। পরদিন আবারও থানায় যান দুঃখিনী এই মা। আঁচল পেতে সন্তানের লাশ ভিক্ষা চান তিনি। তবুও পাষণ্ডের মন যেন নরম হয়না। এভাবে জুলাই ১৯, ২০, ২১ তারিখ পার হয়। শহীদের মহীয়সী মা বলেন- “ছেলের লাশ আনতে গেলে আমাদেরকে মানুষ মনে করেনি যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মাহবুব। বারবার দূরদূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। এমন দুর্ব্যবহার করেছে আমাদের সাথে-মনে হচ্ছিল যে আমরা মানুষ নয়, আমরা যেন কুকুর।” এরপর ২২ তারিখ সকালে আবারও বড় মেয়ের জামাইকে সাথে নিয়ে থানায় যান। থানার প্রধান ফটকের দায়িত্বরত পুলিশের হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেও দেশের জন্য শহীদ সাকিলের লাশের ছাড়পত্র মেলে না। বাধ্য হয়ে বাড়ির দিকে রওনা করেন সন্তান হারানো মৃতপ্রায় হেলেনা। পথমধ্যে শাকিলের এক বন্ধু জানায়- ঢাকা মেডিকেলের হিমঘরের রেফ্রিজেটর নষ্ট হওয়ায় আজকে লাশ হস্তান্তর করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এই কথা জানার সাথে সাথে তিনি আবারও ঢাকা মেডিকেলে যান। ওসি মাহবুব তবুও লাশ দিতে অস্বীকার করে। এরপর ১৮০০ টাকার বিনিময়ে বিকাল ৫.৩০ মিনিটে দেশের এই রত্নের লাশ পরিবারের মাঝে ফেরত দেয় আওয়ামি মদদপুষ্ট ঘাতক ওসি মাহবুব ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপর শহীদ শাকিলের মা জননী ভগ্ন হৃদয়ে সন্তানের লাশ বাড়িতে নিয়ে যান। গোসল শেষে রাত ১২.৩০ মিনিটে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় দেশের এই বীর যোদ্ধাকে। পরিবারের আর্থিক বিবৃতি শহীদ শাকিলের পৈতৃক কোন সম্পদ নেই। বার বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর রিক্সা চালিয়ে সংসারের হাল ধরেছিলেন তিনি। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলের মৃত্যুতে ভাইয়ের বাসায় অসহায় জীবন যাপন করছেন হেলেনা বেগম। শহীদের ছোট ভাই বাধ্য হয়ে শ্রমিক পেশায় নিয়োজিত হয়েছে। এই মুহূর্তে সংসারের হাল ধরার কেউ নেই। পিতার মৃত্যুর পর কুমিল্লা শহর থেকে বিতারিত হন সাকিল ও তার মা। ফলে বর্তমানে মামার বাড়ি ছাড়া এই দুনিয়ায় আপন বলতে কেউ নেই পরিবারটির। প্রস্তাবনা ১. শহীদের মা’কে মাসিক বা এককালীন সহযোগিতা করা যেতে পারে ২. স্থায়ি বাসস্থানের ব্যবস্থা করলে পরিবারটির অনেক উপকার হবে ৩. শহীদের তালাকপ্রাপ্তা বোনকে কর্মসংস্থান করে দেওয়া যেতে পারে একনজরে শহীদ সম্পর্কিত তথ্যাবলি নাম : মো: শাকিল জন্ম : ৩১-১২-২০০০, বয়স: ২৪ বছর পেশা : রিকশাচালক বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: লক্ষীপুরা, হাজিবাড়ি, ইউনিয়ন: বুকাবুনিয়া, জেলা: বরগুনা পিতা : মৃত মো: দুলাল মাতা : হেলেনা, বয়স: ৩৫ বছর, পেশা: গৃহিণী বোন : মোসা: শারমিন আক্তার, বয়স: ২৫ বছর, পেশা: গৃহিণী বোন : মোসা: তানিয়া আক্তার, বয়স: ১৮ বছর, বেকার ভাই : মো: জীবন, বয়স: ১৩ বছর, পেশা: বেলচা কারখানার শ্রমিক সম্পদের পরিমাণ : পৈতৃক কোন জায়গা-জমি নেই আহত হওয়ার সময় : ১৮ জুলাই ২০২৪, আনুমানিক দুপুর ৩ টা ঘটনার স্থান : যাত্রাবাড়ী, কুতুবখালি বড় মাদরাসা সংলগ্ন, ঢাকা আক্রমণকারী : আওয়ামী নরপশু পুলিশ বাহিনী চিকিৎসা সেবা নেওয়া হাসপাতাল : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাহাদাতের তারিখ ও স্থান : ১৮ জুলাই ২০২৪, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল লাশ হস্তান্তর, ২২ জুলাই ২০২৪ (৫ দিন লাশ আটকে রাখে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মাহবুব) শহীদের কবরের অবস্থান : জুরাইন কবরস্থান