জন্ম তারিখ: ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা: অজ্ঞাত, শাহাদাতের স্থান: দরাটানা জাবির ইন্টারন্যাশনাল, যশোর
বাংলার ফেরাউন দস্যুরানী শেখ হাসিনার জোর করে দখলে রাখা সিংহাসন কাঁপিয়ে দিতে যেসকল দেশপ্রেমিক তরুণ নিজের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে শহীদ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ সালে যশোর জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবার নাম শহীদুল হক এবং মায়ের নাম রওশন আরা। আবদুল্লাহ ইবনে শহীদ মৃত্যুর আগে স্ত্রী মুমতারিন জান্নাতুলকে নিয়ে সংসারের ইনিংস শুরু করেছিলেন। তাদের সংসারে রাইয়ান নামে একটি সন্তান আছে। শাহাদাতের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের উপর চেপে বসেছিল এক ভয়ংকর হিংস্র ডাইনি। যিনি দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে জনতাকে একেক সময় একেক রান্নার রেসিপি উপহার দিতেন। অর্থ লুটপাট করে দেশের রিজার্ভ যেমন শেষ করে ফেলেছিলেন তেমনি অধিক পরিমাণে বিদেশী ঋণ গ্রহণ করে দেশকে ঋণগ্রস্থ করে তোলেন। প্রত্যেকের মাথা পিছু ঋণ ১ লাখ ডলার ছাড়িয়ে যায়। প্রতিবাদীদের জেল, গুম, খুন করে নির্মূল করতেন। তার পলায়নে আয়নাঘরে ভয়াবহতা জাতি প্রত্যক্ষ করে শিউরে উঠে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে হাসিনা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ছাত্র-জনতার উপরে গুলি চালাতে থাকেন। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেন। এসময় ইসলামী ছাত্রশিবির সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে অত্যন্ত কৌশলী ভূমিকা পালণ করে। সরকারী জুলুম-নির্যাতনের মধ্যেও তারা বিভিন্ন দফা দাবী তোলে আন্দোলনকে গতি প্রদান করে। একেক দিন একেক রকম আন্দোলনের শিরোনাম দেখে জাতি উজ্জ্বীবিত হচ্ছিল এবং দলে দলে অংশ নিচ্ছিল অন্যদিকে আওয়ামী প্রশাসন বিভ্রান্ত হচ্ছিল। ছাত্র শিবির ছাত্র নেতাদের সেইফ জোনে রেখে আন্দোলনকে বেগবান রেখে চলে। রাজপথে আন্দোলনের ভয়াবহতা নিয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র তাহমিদ হুজাইফা নামক এক গুরুতর আহত ছাত্র তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, "২ অগাস্ট ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ সফল করার জন্য আমরা উত্তরাতে জমায়েত হই। সেদিন আমরা ঘোষণা দেই জুমার নামাজের পর মিছিল বের করবো। জুমার নামাজ শেষ হলে খুব শান্তিপূর্নভাবে উত্তরা বি এন এস এর এখান থেকে মিছিল নিয়ে উত্তরা ১১ নাম্বার সেক্টরে যাই। উত্তরা ১১ নাম্বার সেক্টরে যাওয়ার পর আমরা দেখতে পারি সেখানে আগে থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসীরা ও পুলিশ বাহিনী মিলে ভারি অস্ত্র, শর্টগান,পিস্তল নিয়ে অবস্থান করছিল। আমরা সেখানে সংখ্যায় অনেক কম ছিলাম। মাত্র ২০০-২৫০ জনের মত হবে। সম্ভবত কি কারনে জানিনা হয়তো আমাদের সংখ্যা কম দেখে তারা আমাদেরকে রাস্তা করে দেয় মিছিল নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য। মিছিল নিয়ে তাদেরকে পাস করে আমরা যখন সামনে চলে গিয়ে কিছুক্ষণ অবস্থান করছিলাম তখনই তারা আমাদের ওপর হামলা করে। আমরা চিন্তাও করিনি এতো অল্প কিছু মানুষ যেখানে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি সেখানে তারা হামলা করবে। তারা অনবরত গুলি বর্ষন করে যাচ্ছিল। যেহেতু সেখানে মেয়েরা সংখ্যায় বেশি এবং ছেলেরা কম ছিল তাই আমাদের পক্ষে এতো বড় বাহিনীকে মোকাবেলা করা সহজ হচ্ছিলনা তারপরও আমরা আমাদের জায়গা থেকে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে তাদের মোকাবেলা করার চেষ্টা করছিলাম। এভাবে যখন ঘন্টাখানেক সংঘর্ষ চলছিল তখনি আমরা দেখতে পেলাম ৫-৬ জন অস্ত্রধারি পিস্তল,বন্দুক, শট গান নিয়ে আমাদের একদম সামনে চলে আসে এবং আমাদের লক্ষ্য করে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করতে থাকে। আমি সহ বেশ কয়েকজন তখন সামনে ছিলাম, আমরা তাদের গুলি উপেক্ষা করে খালি হাতে তাদের মোকাবেলা করার চেষ্টা করছিলাম। একসময় তারা আমাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ধাওয়া দিলে আমরা সবাই একটা গলির ভেতর ঢুকে পড়ি। আমরা তখন গলির মুখে দাঁড়িয়েই ছিলাম, তাদের থেকে মাত্র ১০-১২ ফিট দূরে হবে, তখন তারা আমাদের লক্ষ্য করে আরেক দফা গুলি বর্ষন করে। সেবারই আমার মুখে ও শরীরে ছড়রা গুলি লাগে, সেসময় আমার সাথে আরও একজন ছেলের গুলি লাগে। যখন গুলিটা আমার মুখে এসে লাগে তখন খুব কাছ থেকে চোখের সামনে দিয়ে দেখলাম যে গুলি টা এসে লাগল। এখানে মজার বিষয় হলো, যে আমাকে গুলিটা করে তাকে আমি চিনতে পারি যেহেতু আমি উত্তরার স্থানীয় এবং অনেক বছর ধরে এখানেই থাকি। সে ছিলো কাউন্সিলরের ছেলে। আমার মুখে-চোখে যখন গুলি লাগে তখন আমি ভাবছিলাম এখানেই হয়তো আমি মারা যাব। যেহেতু এর আগের দিনও আমি দেখেছি ছড়রা গুলি লাগার কারনে আমার পাশে একজন শহীদ হয়ে যায়। একথা মনে হওয়ার সাথে সাথেই আমি সেখানে বসে পড়লাম এবং আমার পাশের একজন ভাইকে বললাম আমি তো মনে হয় আর বাঁচবো না, এটা বলে আমি কালেমা পড়া শুরু করে দেই। সেখানের আমার পূর্ব পরিচিত বেশ কয়েকজন ভাই আমাকে পাশের ছোট একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। যদিও সেখানে তেমন কোনো চিকিৎসা দেয়া যায়না কারণ সেটা খুব ছোট একটি ক্লিনিক ছিল। সেখানেও ছাত্রলীগ এসে হামলা চালানোর চেষ্টা করে কিন্তু ক্লিনিকের দরজা লাগিয়ে দেয়ার কারণে তারা উপরে আসতে পারে নাই। তখন আমরা সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। ব্লাড মুছে আমাকে সেখানে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়। ক্লিনিক থেকে বলা হয়, "আপনার চোখে যেহেতু গুলি লেগেছে তাই আপনি এখানে থাকতে পারবেননা, আপনি ভালো কোনো হসপিটালে যান।" সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামার কারণে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সেখান থেকে সরে গেলে আমি তখন ক্লিনিক থেকে বের হতে সক্ষম হই। আমাকে নেওয়ার জন্য এম্বুলেন্স আসলে সেই এম্বুলেন্স ভাংচুর করা হয়। যেহেতু আন্দোলনে যাওয়ার আগে আমি বাটন ফোন কিনি তাই ফোনে নতুন সিম লাগানো ছিল। এজন্য বাসার কারও সাথেও কানেক্ট হতে পারছিলাম না। কিন্তু যখন আমার গুলি লাগে সেটা কেউ একজন ভিডিও করে অনলাইন এ পোস্ট করে এবং ভিডিওটি বেশ ভাইরাল হয়ে যায়। সেই ভিডিও দেখে আমার বাসার লোকজন প্রথমে দেখতে পায় যে আমার গুলি লাগে। তখন আমার ছোট বোন আমার টেবিল থেকে নতুন সিমের নাম্বারটা খুঁজে বের করে কল দেয়। তো এভাবেই বাসা থেকে আমার সাথে রিচ করা হয়। সন্ধ্যার সময় বাসা থেকে গাড়ি পাঠানো হলে আমাকে ক্লিনিক থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্লিনিক থেকে তাৎক্ষণিক আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় আগারগাঁও চক্ষু বিজ্ঞান হসপিটালে। সেখানে যাওয়ার পর আমাকে বলা হল, আপনার চোখের এক্সরে করাতে হবে। এক্সরের জন্য বের হয়ে দেখি সেখানেও পুলিশ উপস্থিত। হয়তো কোনোভাবে ইনফরমেশন গিয়েছে। উত্তরাতেও বিভিন্ন হসপিটালে তখন পুলিশ আমাকে খুঁজতে থাকে। আমি কোনোভাবে তখন এক্স-রে করাই কিন্তু হসপিটালে আর ফেরত যেতে পারিনি। এর মধ্যে আমার ইউনিভার্সিটি থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করা হয় এবং ট্রিটমেন্ট নেওয়ার ব্যাপারে সেখান থেকে আমাকে সাহায্য করা হয়। ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে যোগাযোগ করে সেখানে আমার চিকিৎসার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ভার্সিটি থেকে বলা হয়, আমার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ তারা বহন করবে। এভাবে পরের দিনই আমি ইসলামিয়া হসপিটালে চিকিৎসা পাই, সেখানে আমার অপারেশন হয় এবং আমার চোখ থেকে বুলেট অপসারণ করা হয়। সে অবস্থায় আমরা আমাদের পরিচয় সেখানে কোনভাবেই বলতে পারিনি। হাসপাতালে আমার ইনজুরির কারণ এক্সিডেন্ট হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। এছাড়া আমার ঠিকানাও চেঞ্জ করে দিয়ে আসতে হয়। হাসপাতালে গিয়ে আমি দেখতে পাই আমারই মতন অনেকে আহত হয়ে মুখোমুখি বসে আছে কিন্তু কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি কিভাবে কী হলো। বুলেটে আমার চোখের বেশ বড় একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রায় ত্রিশটার মতন শেলাই দেয়া লাগে। চোখের রেটিনা এবং ব্রেইন এর সাথে যে নার্ভটা চোখের সাথে কানেক্টেড সেটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায়। যার কারনে এখনও আমার দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি ফিরে আসেনাই। চোখে নরমাল এর মতন দেখিনা যাস্ট আলোটা দেখি আরকি। ডাক্তার বলেছেন যেহেতু রেটিনা একদম ডিসফাংশন হয়ে যায় নাই তাই হয়তো আমি সামনে কিছুটা দেখতে পারি। ২ তারিখে গুলি লাগার কারনে পরবর্তী ৩ ও ৪ তারিখ আমি হসপাতালে ভর্তি থাকি। ৫ তারিখের বিজয় মিছিলেও সামিল হতে পারিনি। ৫ তারিখ খবর পাই যে হাসিনা পালিয়ে গেছে। গত ডিসেম্বরে আবারও আমার সার্জারী হয়। ডাক্তার বলেছে আরও ৫-৬ মাস চোখ এভাবেই থাকবে। আমার চোখে সেলাই দিয় এক ধরনের সিলিকন জেল দিয়ে দেওয়া হয় যেনো চোখের শেপটা ঠিক থাকে। এখনও আমার চোখে জেল দেয়া আছে। ৫-৬ মাস পর জেলটা রিমুভ করা হলে বোঝা যাবে যে, ডান চোখে আদৌ দেখতে পাব কিনা। আপাতত শুধু ঝাপসাভাবে আলোর উপস্থিত বুঝতে পারি, আর তেমন কিছুই দেখতে পারিনা। ৪ আগস্ট প্রতিবাদী ছাত্র নেতারা ৬ আগস্ট ‘মার্চ ফর ঢাকা’ কর্মসূচী দেয়। কিন্তু ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতারা অনুভব করেন সরকারকে বেশি সময় দেয়া হলে তারা গণহত্যা চালাবে। তাই ৬ তারিখের স্থলে ৫ তারিখ কর্মসূচী প্রদান করা হয়। জনতা ৫ আগস্ট ভোর থেকে রাজপথে সাহসীকতার সাথে জমায়েত হতে থাকে। সারাদেশ তখন উত্তাল। সকল জেলা শহর এই কর্মসূচীর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে শহরের মূল কেন্দ্রে এসে জড়ো হতে থাকে। আব্দুল্লাহ ইবনে শহীদ ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে দরাটানা পৌঁছান। খুনি হাসিনার আগে থেকে নির্দেশ ছিল গণহত্যা পরিচালনা করার। যশোরের মিছিলে ফ্যাসিস্ট বাহিনীর দোসর ও ঘাতক পুলিশ আক্রমণ করলে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় মিছিলকারীর একাংশ দরাটানা জাবির ইন্টারন্যাশনালে আশ্রয় নেয়। আবদুল্লাহ ইবনে শহীদও নিজেকে হেফাজত করতে সেখানে অবস্থান নেন। মুহুর্তেই হিংস্র হয়ে উঠা ঘাতক বাহিনী সে ভবনে অগ্নিসংযোগ করলে সেখানে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন তিনি। অর্থনৈতিক অবস্থা আব্দুল্লাহ ইবনে শহীদের বাবা কৃষিকাজ করেন। সন্তানের মৃত্যুতে তাদের পরিবারে দারিদ্র অবস্থা তৈরী হয়েছে। একনজরে শহীদ সম্পর্কিত তথ্যাবলি নাম : মো: আব্দুল্লাহ ইবনে শহীদ জন্ম : ০৬-০২-১৯৯৭ পিতা : শহীদুল হক মাতা : রওশন আরা স্ত্রী : মুমতারিন জান্নাতুল সন্তান : ১. রাইয়ান (৫) নার্সারী ভাই : সাদমান, সরকারী সিটি কলেজ, যশোর স্থায়ী ঠিকানা : ঘোপ, নোয়াপাড়া, ওয়ার্ড-০৩, যশোর বর্তমান ঠিকানা : পাঁচাইখা, ভূলতা, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ঘটনার স্থান : দরাটানা জাবির ইন্টারন্যাশনাল, যশোর আক্রমণকারী : যুবলীগের বাহিনীর অগ্নিসংযোগ আহত হওয়ার সময় : আনুমানিক বিকাল ৪ টা, ৫-০৮-২০২৪ আঘাতের ধরন : আগুনে পুড়ে যাওয়া মৃত্যুর তারিখ, সময় ও স্থান : ৫-০৮-২০২৪ শহীদের কবরের অবস্থান : ঘোপ সেন্ট্রাল রোড, যশোর প্রস্তাবনা ১. মাসিক ও এককালীন ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা ২. শহীদ স্ত্রীর জন্য একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা