জন্ম তারিখ: ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা : দিনমজুর (শাটার মিস্ত্রি), শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেলের করিডোরে
জুলাই মাসের মধ্যভাগ। বাংলাদেশ তখন আগুন হয়ে জ্বলছে। রাজধানীর বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ, রাস্তায় মানুষের আহাজারি। আন্দোলন ও সরকার পতনের দাবিতে তরুণ-যুবা-শ্রমিক-ছাত্র সবাই একাট্টা। ঢাকা শহরের অলিগলিতে তখন বারুদের ঘ্রাণ। এই উত্তাল ঢাকার বুকে, এক মানুষ পাড়ি জমাচ্ছিল ফার্মেসির খোঁজে। তার হাতে ছিলো ছেলের জন্য ওষুধ কেনার ব্যাগ, চোখে ছিলো উদ্বেগের ছায়া, রাজনৈতিক নয়, নিছক পিতৃত্বের দায়। সে মানুষটির নাম ছিলো হৃদয়। কুমিল্লার রাফেরদিয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া এ তরুণ জীবন যুদ্ধ করেছিলো ছোটবেলা থেকেই। বাবার মৃত্যু, সংসারের হাল ধরা, দিনমজুরি করে মাকে আর স্ত্রী-সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখা সবই ছিলো তার প্রতিদিনের বাস্তবতা। বস্তির ঘরে ঘাম ঝরিয়ে, ঢাকার রোদে-ধুলায় ইস্পাতের শাটারে হাত চালিয়ে সে গড়ত নিজের ভাগ্য নয়, বরং স্ত্রী মুক্তা বেগম আর দুই ছেলেকে একটু ভালো রাখার স্বপ্ন। তাঁর মা মরিয়ম বেগম, একজন কারখানার শ্রমিক, বার্ধক্য আর ব্যথা নিয়ে প্রতিদিন সকালে যখন কাজে বের হতেন, হৃদয় তখন বলতো,"মা, তুমি একদিনও কাজ কইরো না। আমি আছি না?" ২০২৪ সালের জুলাই: বাংলাদেশের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত অধ্যায় জুলাই মাসটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ ও রক্তাক্ত সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই মাসে সংঘটিত "জুলাই গণহত্যা" এবং "জুলাই বিপ্লব" দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। আন্দোলনের সূচনা জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে, সরকার কর্তৃক বিতর্কিত কোটা পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ শুরু করেন। এই আন্দোলন দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণ, রাজনৈতিক কর্মী এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলন দমন করতে তৎকালীন আওয়ামী সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো আন্দোলনকারীদের উপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালায়। খুনি হাসিনার নির্দেশে সারা বাংলাদেশে গণহত্যা চালায় স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার ও তার পেটুয়া বাহিনী। খুনি শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও অন্তর্বর্তী সরকার আন্দোলনের চাপে পড়ে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং ভারতে পালিয়ে যান। এরপর নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যা দেশের পুনর্গঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ঘোষণা আন্দোলন দমনে ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দলটির নিবন্ধন স্থগিত করা হয় এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। ২০২৪ সালের জুলাই মাস বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর ক্ষতচিহ্ন হয়ে থাকবে। এই সময়ের ঘটনাবলি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন এবং গণআন্দোলনের এই অধ্যায় থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সহনশীল সমাজ গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সংক্ষেপে: আন্দোলনের সূচনা: কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সরকারী দমন-পীড়ন: নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত চানখারপুল হত্যাকাণ্ড: ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত শেখ হাসিনার পদত্যাগ: আন্দোলনের চাপে পড়ে পদত্যাগ ও ভারতে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ঘোষণা: সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় দলটি নিষিদ্ধ। ঘটনার বিবরণ ১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার। বিকেল সাড়ে পাঁচটা। ছেলেকে জ্বর এসেছে, কিন্তু আশেপাশে কোনো ওষুধের দোকান খোলা নেই। চারপাশে গুঞ্জন "আন্দোলনকারীরা রাস্তায়", "পুলিশ গুলি ছুঁড়ছে" তবু হৃদয় তো আন্দোলনকারী নয়। সে তো একজন পিতা, যার একটাই উদ্দেশ্য: ওষুধ এনে ছেলের জ্বর নামানো। কিন্তু রাষ্ট্রের চোখে সে এক ‘দেখা গেলেই সন্দেহজনক’। সে হাঁটছিলো ওভারব্রিজের নিচে, রায়েরবাগ বাজারের দিকে। তখনই গর্জে উঠলো গুলি। একটি ছুটে আসা বুলেট বিদীর্ণ করলো তার পিঠ, ছিঁড়ে গেলো কলিজা, বুক দিয়ে বেরিয়ে গেল রক্তের গলাপ্রপাত। মুহূর্তেই শহীদ মোহাম্মদ হৃদয় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পথচারীরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ঠিক রাত ৮টা, ঢাকা মেডিকেলের করিডোরে নিঃশব্দে থেমে গেলো এক জীবন। হৃদয় যুদ্ধ করেছিল পরিবার বাঁচাতে, রাষ্ট্র পাল্টাতে নয়। তার স্ত্রী এখন অনেক রাতে বিছানার কোণে বসে বলেন,"সে তো শুধু ওষুধ আনতে গেছিলো, এই কি ছিল তার অপরাধ?" তাঁর মা বয়সের ভারে নুয়ে যাওয়া এক মানুষ। কারখানার কাজ আর করতে পারেন না, কোমরের ব্যথায় কাতর। চোখে শুধু ছেলের মুখ, শেষ দেখার মুহূর্তের সেই রক্তাক্ত বুক। মৃত্যুকালে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন হৃদয়। মা বর্তমানে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। স্ত্রী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। পরিবার এখন চরম আর্থিক সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছে শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয় এর বক্তব্য শহীদ হৃদয়ের বড় বোন মোছাম্মৎ সুরমা আক্তার বলেন, আমার ভাইয়ের মত মানুষই হয় না।আমার ভাই একজন অত্যন্ত সৎ মানুষ ছিল। সে সব সময় সত্য কথা বলতো এবং অন্যায় থেকে দূরে থাকতো। একজন মানবিক এবং পরোপকারী মনের মানুষ ছিল। আমার ভাই অত্যন্ত বিনয়ী এবং অহংকারহীন ছিলেন। সে সদা সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল থাকা পছন্দ করত এবং ছোটদের স্নেহ করতো। সে বড়দেরকে যথেষ্ট সম্মান করতো এবং দেখলেই সালাম দিত। পরিবারের প্রতিটি মানুষের প্রতি ছিল তার দায়িত্বশীল আচরণ। আমরা কখনো রাগ করলেও সে রাগ করত না। অভাবের সংসারে যখন আমরা ধৈর্য হারা হয়ে যাই তখন সে কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজের ধৈর্য ধরে রাখত। এবং আমাদেরকে সান্ত্বনা দিত। বাবার মৃত্যুর পর পুরো পরিবারের দায়িত্ব যখন তার কাঁধে আসে, তারপরেও সে দায়িত্ব পালনে কোনদিনও অবহেলা করেনি। সুরমা আক্তার বলেন, আমার ভাইয়ের মত আর ভাইয়ে হয় না। সে পরিবারের জন্য হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যাইত, কিন্তু অভাবের সংসার বলে নিজের জন্য কিছুই করতো না। সে ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট করে বড় হইছে, এর জন্য সে পরিবারের কাউকে কষ্ট দিতে চাইত না। শহীদ মোহাম্মদ হৃদয়: একনজরে প্রোফাইল নাম : মো: হৃদয় জন্ম তারিখ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ জন্মস্থান : রাফের দিয়া, দৌলতপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্লা পেশা : দিনমজুর (শাটার মিস্ত্রি) পিতা : মো: মুকুল (মৃত, বয়স ৫৭) মাতা : মরিয়ম বেগম (কারখানা শ্রমিক, বয়স ৫৪) স্ত্রী : মুক্তা বেগম (গৃহিণী, বয়স ২৫) সন্তান : মোহাম্মদ রাজিব আহমেদ আফরান (বয়স ৫) ও মোহাম্মদ আব্দুর রহমান (বয়স ১) স্থায়ী ঠিকানা : কাজিমুদ্দিন প্রধানিয়া বাড়ি, রাফেরদিয়া, দৌলতপুর ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ৫, দাউদকান্দি, কুমিল্লা বর্তমান ঠিকানা : গফুর মিয়ার বাড়ি, ২৫/১, রইসনগর (বায়তুল মামুর মসজিদের উত্তর পাশে), : কদমতলী, ঢাকা সিটি দক্ষিণ, ওয়ার্ড ৬০ আহত হওয়ার তারিখ ও সময় : ১৯ জুলাই ২০২৪, বিকাল ৫:৩০ মিনিট মৃত্যুর তারিখ ও সময় : ১৯ জুলাই ২০২৪, রাত ৮:০০ মিনিট ঘটনার স্থান : রায়েরবাগ, কদমতলী থানার সামনে হত্যাকারী : বাংলাদেশ পুলিশ কবরস্থান : মাতুয়াইল কবরস্থান, ঢাকা প্রস্তাবনা শহীদ মো: হৃদয়ের দুই সন্তান এবং পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ও ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করা হোক। রাষ্ট্র যেন এক পিতার মৃত্যুতে আরেক সন্তানকে অনাথ করে না তোলে। যিনি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অন্যায়কে না বলেছিলেন