Image of মো: রায়হান

নাম: মো: রায়হান

জন্ম তারিখ: ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা_সিটি

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : দিনমজুর শাহাদাতের স্থান: মুগদা, ঢাকা

শহীদের জীবনী

একজন দিনমজুরের নিষ্পাপ স্বপ্ন থেকে শহীদের মাটি পর্যন্ত যাত্রা শহীদ পরিচিতি ঢাকার কলতা বাজারের এক সরু গলিতে, ভাঙাচোরা দালানের আড়ালে, কাঁচা সিমেন্টের দেওয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন এক নিরীহ, নিরালম্ব মানুষ। নাম তার মো: রায়হান। কেউ ডাকতো "রায়হান ভাই", কেউবা শুধুই “চাচা”, কিন্তু ক’জন জানতো তার ভেতরের বেদনা, তার নিঃসঙ্গ সংগ্রাম? সেই মানুষটা ছিলেন একজন দিনমজুর, যিনি জীবনের ভার টানতেন না কেবল নিজের কাঁধে, বরং এক অসুস্থ শরীর, প্রিয় স্ত্রী, একমাত্র ছেলে নাজমুল, আর পেছনে পড়ে থাকা বাবা-মায়ের ভালোবাসার দায় নিয়েই টেনেছিলেন। রায়হানের জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ সালে, ঢাকা শহরের গলির ভেতর এক দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারে। বাবা মোঃ সালাউদ্দিন এক কাঠমিস্ত্রি, যিনি ৭০ বছর বয়সেও ঘাম ঝরান ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। মা রহিমা বেগম একজন গৃহিণী, যিনি দোয়া করতেন, ছেলে যেন অন্তত একটু ভালো থাকে। রায়হান পড়াশোনায় খুব এগোতে পারেননি, জীবন তাকে সময় দেয়নি। ২৫ হাজার টাকার মাসিক আয়ে সংসার চালানো, ভাঙা বাসায় বৃষ্টির দিন টিনের ছাদ গোনা, আর একমাত্র ছেলের স্কুলের ফি সবই ছিল তার বাস্তবতা। কিন্তু সে ছিল একজন শান্ত মানুষ। একটু সহজ-সরলও। কে কী বললো, তাতেই বিশ্বাস করে নিতেন। তাই হয়তো শত্রু আর বন্ধুর ফারাক বুঝে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। জুলাইয়ের আগুনে জ্বলতে থাকা শহর ২০২৪ সালের জুলাই মাসে যখন ঢাকার বাতাস ছিল উত্তপ্ত, রাজপথে ছিল ছাত্রদের বিক্ষোভ, "জুলাই বিপ্লব" তখন শুধু রাজনীতি ছিল না, ছিল বেঁচে থাকার দাবি, ন্যায়ের জন্য গর্জন। গোটা ঢাকা যেন এক আতঙ্কে মোড়ানো বিস্ফোরক কুয়াশায় ঢেকে যায়। পেছনে দাঁড়ানো গরিব মানুষগুলো তখনও ভাবতো "এইটা ওদের জিনিস, আমরা তো শুধু কাজ করেই বাঁচি। রায়হানও রাজনীতি বোঝেননি। না কোনো দল চিনতেন, না কোনো মিছিলের রঙ বুঝতেন। বোঝেননি বলেই ভয়াবহ সেই পরিস্থিতির মাঝখানেও বেরিয়ে পড়েছিলেন শুধু একটু ফ্রি চিকিৎসার আশায়। ডান হাত ভেঙে গিয়েছিল কিছুদিন আগে। ফার্মেসির ওষুধে আর কোনো লাভ হচ্ছিল না। এক প্রতিবেশী বলেছিল, “মুগদা হাসপাতালে গরিবদের ফ্রি চিকিৎসা দেয়।” তার চোখ জ্বলে উঠেছিল সেই আশাতে। “বউ, আমি মুগদা যাই। হসপিটালেই তো ফ্রি ট্রিটমেন্ট দিবো বলতেছে।” স্ত্রী বলেছিলেন, “যেওনা, এখন রাস্তা ভালো না।” তিনি হেসে বলেছিলেন, “একটু গিয়েই দেখি, তেমন কিছু হইবো না। ঘটনার দিন: ৫ আগস্ট ২০২৪ বিকাল পাঁচটা। রায়হান মুগদা হাসপাতালের দিকে যাচ্ছেন। আর তখনই শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। পুলিশ আর ছাত্রদের মুখোমুখি সংঘর্ষের মাঝে পড়ে যান তিনি। শরীরটা তখনই দুর্বল ছিল, হাতের ব্যথা ছিল প্রবল। হঠাৎ পুলিশের লাঠিচার্জ শুরু হয়। ভয়ে দৌড়ান। এক জায়গায় পড়ে যান। তারপর অন্ধকার। সেই মুহূর্তে, নিজের মোবাইল থেকে স্ত্রীকে ফোন করে বলেন, “বড় গন্ডগোল হইছে, পুলিশ মারছে সবাইরে... আমি এইখানে আছি, দোয়া কইরো।” এটাই ছিল তার শেষ কথা। রাতে বারবার ফোন করেও বড় ভাই রায়হানকে পাননি। শেষমেশ রাত তিনটার দিকে এক অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে “এই লোক আপনার কি হয়?” ভাই বলেন, “আমার ছোট ভাই।” লোকটি বলে, “ওনার লাশ হাতিরঝিল ব্রিজের নিচে পড়ে আছে। পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন।” রায়হানের বড় ভাই, ছোট বোন স্বর্ণা আক্তার নুরজাহান আর বৃদ্ধ পিতা ছুটে যান সেখানে। দুইটি লাশ পড়ে ছিল। একটির শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন, পুরো শরীর রক্তে ভেজা। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল বিচ্ছিন্ন। তখন সেনাবাহিনীর এক অফিসার এসে বলেন, “চেনেন?” তারা চোখের জল ফেলে মাথা নাড়েন। “তাহলে নিয়ে যান। আরেকজনের লাশ আমরা নিচ্ছি।” তাদের গলায় তখন কোনো আওয়াজ ছিল না, শুধু বুকের ভেতরে চাপা কান্না। নিরব ভালোবাসা, অপূর্ণ চাওয়া তার ছোট বোন বলেছিলেন, “ভাইয়া একটু নরম মনের ছিল। রান্না ভালোবাসতো, আমার হাতে রান্না খেতে আসতো। ৩ আগস্ট ফোন দিয়ে টাকা চাইছিল। আমি বলছিলাম দু-একদিন পর আসবো। কিন্তু আমি যাইতে পারি নাই। এখন শুধু আফসোস হয় শেষ চাওয়াটাও পূরণ করতে পারি নাই।” শেষ আশ্রয়: জুরাইন গোরস্থান রায়হানের রক্তাক্ত দেহ এখন চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে জুরাইনের মাটিতে। পেছনে রয়ে গেছে একটি ছোট ছেলে, একটি কাঁদতে থাকা স্ত্রী, দুটি বৃদ্ধ চোখ আর এক অসমাপ্ত প্রহর যেখানে তার নাম নেই কোনো রাজনীতির পাতায়, কিন্তু তার রক্ত লেগে আছে সেই আন্দোলনের কালো মাটিতে। শেষ কথা: রায়হান কোনো নেতা ছিলেন না, ছিলেন না বক্তা, কিংবা কোনো পোস্টারের মুখও নন। তিনি ছিলেন একজন মানুষ যিনি বিশ্বাস করেছিলেন অন্য মানুষের কথায়, ভেবেছিলেন একটু চিকিৎসা পেলে বাঁচবেন। কিন্তু তিনি চিরদিনের মতো ঢলে পড়েছেন "জুলাই বিপ্লব"-এর এক নীরব শহীদ হয়ে। তিনি আমাদের চোখে অচেনা, কিন্তু সেই লাখো রায়হানের প্রতীক যারা শুধু বাঁচতে চেয়েছিল, কিন্তু যাদের প্রাণ দিয়েও কিছুই চাওয়ার ছিল না। শহীদ মোঃ রায়হান আপনার সহজ সরলতা আজ একটি জাতির বিবেককে প্রশ্ন করে: কেন একজন গরিব চিকিৎসা পেতে গিয়ে গুলিতে মারা যায়?" এক নজরে শহীদ পরিচিতি শহীদের পূর্ণ নাম : মো: রায়হান জন্ম তারিখ : ০১-০২-১৯৮৬, পেশা : দিনমজুর পিতার নাম : মো: সালাউদ্দিন, পেশা ও বয়স: কাঠমিস্ত্রি, ৭০ মায়ের নাম : রহিমা বেগম, পেশা ও বয়স: গৃহিনি: ৫৮ বর্তমান ঠিকানা : বাড়ি-৪০, কলতা বাজার, কোতয়ালী, ঢাকা স্থায়ী ঠিকানা : বাসা-৪২৮/এ, এলাকা-মীরহাজীরবাগ, আদর্শ স্কুলের পশ্চিম পাশে থানা-শ্যামপুর, জেলা: ঢাকা মাসিক আয় : ২৫,০০০ এক ছেলে : নাজমুল(১১), ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র ঘটনার স্থান : মুগদা আক্রমণকারী : পুলিশ আহত হওয়ার তারিখ : ৫/৮/২৪, সময়: বিকাল ৫টা মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : ৫/৮/২৪, বিকাল ৬টা (আনুমানিক) শহীদের কবরের অবস্থান : জুরাইন গোরস্থান প্রস্তাবনা শহীদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করা প্রয়োজন শহীদের সন্তানের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেওয়া যেতে পারে শহীদ পরিবারে স্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: রায়হান
Image of মো: রায়হান
Image of মো: রায়হান

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: লেবু শেখ

আবদুল রাকিব

মো: জাহিদ হোসান

মো: সুজন

মো: সাইফুল ইসলাম তন্ময়

হাসিব আহসান

মো: জাহাঙ্গীর

মো: জাহিদ-এ-রহিম

আব্দুর রহমান জিসান

মো: সাকিল

মো: আসাদুল্লাহ

শাহ আলম

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo