জন্ম তারিখ: ২১ জানুয়ারি, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা : ছাত্র, কুতুবখালী মাহমুদুল হাসান কওমী মাদ্রাসা ঘটনার স্থান : ধোলাইপাড়, ঢাকা
শহীদের পরিচিতি ঢাকার পুরান শহরের কোলাহল আর ধূলিঝড়ের মাঝে, ব্রাহ্মণ চিরন, যাত্রাবাড়ীর ছোট্ট এক ঘরে জন্ম নিয়েছিল এক শান্ত স্বভাবের শিশু সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি, একটি ছিমছাম সকালে মা শিল্পী আক্তারের কোলজুড়ে আলোর মত এসেছিল সে। মুদির দোকান চালানো বাবার মুখে হাসির রেখা, যদিও সংসারের আয় ছিল মাত্র পনেরো হাজার, কিন্তু তবু সন্তানদের নিয়ে তার মনে ছিল না কোনো আক্ষেপ। এ ছিল এমন এক পরিবার, যেখানে চাহিদা কম, কিন্তু ভালোবাসা ছিল আকাশসম। সাইদুল পড়তো কুতুবখালী মাহমুদুল হাসান কওমী মাদ্রাসায়। মিশকাত জামাতের ছাত্র হলেও সে কেবল বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল প্রতিবাদী, চোখে ছিল দীপ্ত স্বপ্ন একদিন দেওবন্দে যাবে, হবে আলেমে দ্বীন। বন্ধুদের সাথে সে খেলত, হাসত, কিন্তু তার আত্মা ছিল গভীর দারিদ্র্য, অন্যায়, নারী-নিগ্রহ, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এসব স্পর্শ করত তাকে। ২০২৪ সালের জুলাই মাস ঢাকার রাজপথ যেন জেগে উঠেছিল। একে একে রাস্তায় নামে হাজারো ছাত্র, কিশোর-কিশোরী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নিরাপত্তাহীন জীবনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ছাত্রসমাজ। ইয়াসিন ছিল এই আন্দোলনের অন্যতম সাহসী কণ্ঠস্বর। মাদ্রাসার ছাত্র হয়েও সে বুঝে গিয়েছিল, কেবল দীনি জ্ঞান নয়, এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলাও ফরজ। ৪ আগস্ট সেদিন বিকেল ৫টায় ধোলাইপাড়ে ঘটে সেই বিভীষিকাময় ঘটনা। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হকিস্টিক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। ব্যথায় কুঁকড়ে গেলেও তার চোখে ছিল না পরাজয়ের ছাপ। বন্ধুরা যখন তাকে ধরে মেডিকেলে নেয়, তখনও সে বলেছিল “আমি কাল আবার যাবো, ইনশাআল্লাহ।” পাঁচ তারিখেও সে আবার রাজপথে নেমে পড়ে। বিজয়ের দিনগুলোতে সে সহযোদ্ধা ছাত্রদের ট্রাফিক সহায়তা দিতে উদ্বুদ্ধ করে, রাতের পাহারায় নেতৃত্ব দেয়। সবার প্রিয় ইয়াসিন হয়ে ওঠে অদৃশ্য এক অনুপ্রেরণা। আর এই অনুপ্রেরণাই হয়ে ওঠে তার মৃত্যুদণ্ডের কারণ। ১৩ আগস্ট রাতে, ছাত্র ছদ্মবেশে আসা সন্ত্রাসীরা থানা পাহারায় যুক্ত হয়। তারা লক্ষ্য করে এই ছেলেটিই নেতৃত্ব দিচ্ছে, বাকিদের উদ্বুদ্ধ করছে। পরিকল্পনা পাকাপোক্ত হয়। রাত গভীর হলে অধিকাংশ ছাত্র চলে যায়, থেকে যায় ইয়াসিন ও কিছু বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা। ভোররাত সাড়ে তিনটায় মা ফোনে বলেন “বাবা, আর কতো দেরি?” সে উত্তর দেয় “মা, সকালেই ফিরবো।” এই ছিল শেষ কথা। সকালের আলোয় চোখ মেলে যখন দেখে সামনে দাঁড়িয়ে মা, তখন সে ফিসফিস করে বলে, “মা... ওরা...” বাকিটা আর উচ্চারণ করতে পারে না। ঘটনার বিবরণ শহীদ সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন। ৪ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে সে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের দ্বারা মারাত্মকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাকে হকিস্টিক দিয়ে বেধড়ক মারপিট করে। এতে সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে, পরবর্তীতে তাকে স্থানীয় মেডিকেলে নিয়ে গিয়ে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় এবং তার বাম পায়ে ব্যান্ডেজ করা হয়। এরপরেও সে ৫ তারিখে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। বিজয়ের পরবর্তী দিনগুলোতে সকলের সাথে মিলেমিশে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতেন। সর্বশেষ ১৩ আগস্ট সকালে বন্ধুদের সাথে ট্রাফিকের কাজে সহায়তার জন্য বাসা থেকে বের হন। থানায় পুলিশ না থাকায় চারিদিকে ডাকাতি বেড়ে যাওয়ায় শহীদ সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন তার সকল বন্ধুদেরকে দিনে ট্রাফিক কাজে অংশগ্রহণ এবং রাতে থানা পাহারা দেয়ার ব্যাপারে অনুপ্রেরণা যোগাত। বিকালের দিকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ১৫ থেকে ২০ জনের একটি টিম ছাত্র ছদ্মবেশে এসে তাদের সাথে থানা পাহারায় সহায়তা করার কথা বলে। তারা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পায় সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন ছাত্রদেরকে নেতৃত্ব দেয়। যার কারণে সে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের টার্গেটে পরিণত হয় এবং হামলার পরিকল্পনা করে। রাত গভীর হলে অধিকাংশ ছাত্ররা বাসায় চলে যায়। ছাত্র ছদ্মবেশে আসা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এবং সাইদুল ইসলাম ইয়াসিনসহ অল্প কিছু ছাত্ররা থেকে যায়। সারারাত বাসায় না ফেরায় তার মা শিল্পি বেগম একাধিকবার ছেলের সাথে কথা বলেন। সর্বশেষ ভোর ৩:৫০ মিনিটের দিকে ফোন করলে সকালে বাসায় ফিরবে বলে জানায়। এর কিছুক্ষণ পরে (১৪ আগস্ট ভোর রাতে) যাত্রাবাড়ী থানার অদূরেই একটি দোকানে পানি কিনতে গেলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এটাকে সুযোগ হিসেবে নেয়। দোকান থেকে ফেরার পথে ১৫ থেকে ২০ জন সন্ত্রাসী তাকে নির্মমভাবে আঘাত করে আহত অবস্থায় থানার পাশে রেখে দেয়। সকাল হলে বাকি ছাত্ররা চলে গেলেও ছাত্র ছদ্মবেশে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা থেকে যায়। সবাই চলে গেলে তাকে থানার মধ্যে একটি রুমে নিয়ে এসে আবার মারধর করে ফ্লোরে ফেলে রাখে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের মধ্য থেকে একজন ৯টার দিকে তার সাথে থাকা ফোন থেকে তার মায়ের কাছে কল করে তাকে কেউ আহত করে থানায় ফেলে রাখার কথা জানিয়ে ফোনটি ভেঙ্গে ফেলে। সংবাদ পেয়ে একাই ছুটে যান থানায়। সেখানে মুমূর্ষ অবস্থায় ছেলেকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এই অবস্থা কে করেছে জানতে চাইলে থানার বাইরে দাড়িয়ে থাকা কিছু ছেলেদের দেখিয়ে দেন এবং উপরোক্ত ঘটনা জানান। মা শিল্পি বেগম লক্ষ করেন ছেলের কথা ধীর ও কমে যাচ্ছে এবং শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত পার্শ্ববর্তী প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত ডাক্তার প্রাথমিক পরীক্ষা শেষে অবস্থা আশঙ্কাজনক বুঝতে পেরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলেন। সেখানে জরুরি বিভাগেই চিকিৎসারত অবস্থায় ১৪ আগস্ট ২০২৪ সকাল ১০:৫৫ মিনিটে শহীদ হন। প্রথমে নেওয়া হয় এক বেসরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে। সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে, ডাক্তাররা মাথা নাড়িয়ে বলেন “তিনি আর নেই।” একজন শহীদের মা, একটি ভাঙা সংসার ছেলেকে হারিয়ে শিল্পী আক্তারের মুখ যেন মোমের মতো নিস্তব্ধ। “আমার ছেলে বাইরে থেকে ঘরে এলেই তিনবার ডাকত মা, ও মা, মাগো কই তুমি?” আমি বলতাম “তিনবার মা ডাক কেন?” ইয়াসিন হেসে বলত “মা তুমি যে তিনজনের ভালবাসা একসাথে দাও!” আজ সেই ডাক নেই। সেই মুখ নেই। যেটা আছে, তা হলো অভাব, ঋণের বোঝা, বাবার শরীরে টিউমার, মেয়ের পড়াশোনার অনিশ্চয়তা। একমাত্র ছোট বোন সাদিয়া ইসলাম সুরাইয়া বলে “আমার ভাই স্কুলে পৌঁছে দিত। এখন কে দেবে? আমার খেলনা লুকিয়ে রেখে বিরক্ত করত, এখন কে করবে?” তার কণ্ঠে কেবল কান্নার শব্দ, “আমার তো ভাই বলে ডাকবো এমন কেউ আর থাকলো না!” স্মৃতি ও শোকের ছায়া সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন, এক মাদ্রাসা ছাত্র নম্র, ভদ্র, হাসিখুশি, একজন অনন্য দৃষ্টান্ত। এই রাষ্ট্র, এই সমাজ যে কিভাবে একজন নিষ্পাপ কিশোরকে গলাটিপে হত্যা করতে পারে তা দেখেছে এই আগস্টের আকাশ। তার স্বপ্ন ছিল আলেম হওয়া, মানুষের কল্যাণে কাজ করা, মাকে আর কখনো এনজিওতে কিস্তি তুলতে না পাঠানো। অথচ এখন তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এক অসহায় মা শুধু বলেন “আমার ছেলের জায়গা কেউ কখনও পূরণ করতে পারবে না।” যেখানে ঘুমায় শহীদ নিঃশব্দ লোকেশনে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন শহীদ সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন। ঠিকানা বদলে গেছে, কিন্তু হৃদয়ের ঠিকানায় সে থেকে যাবে চিরকাল। স্মৃতি, স্বপ্ন আর রক্তের বিনিময়ে লেখা হয়েছে এই কিশোরের নাম যে তার সময়কে অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে এক প্রতীকের নাম, প্রতিবাদের নাম, শহীদের নাম। শেষ কথা সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন শহীদ হয়েছেন, কিন্তু তার রক্ত বৃথা যাবে না। ইতিহাস জানবে, একটি দরিদ্র ঘরের সন্তান কীভাবে এক রাষ্ট্রের জুলুমের বিরুদ্ধে মিছিলের সর্বাগ্রে দাঁড়িয়েছিল। জানবে, কোথাও এক মা প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে ছেলের শেষ “মা” ডাক শুনে ঘুম ভাঙে। এক নজরে শহীদ পরিচিতি শহীদের পূর্ণ নাম : মো: সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন জন্ম তারিখ : ২১ -০১ -২০০৫ জন্মস্থান : ঢাকা পেশা : ছাত্র বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা : ব্রাহ্মণ চিরন, সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী,ঢাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম : কুতুবখালী মাহমুদুল হাসান কওমী মাদ্রাসা পিতার নাম : মো: সাখওয়াত হোসেন পিতার পেশা : মুদী দোকানদার মায়ের নাম : শিল্পী আক্তার মায়ের পেশা : গৃহিনি মাসিক আয় : ১৫,০০০ ঘটনার স্থান : ধোলাইপাড়, ঢাকা আক্রমণকারী : ছাত্রলীগ ১ম বার আহত হওয়ার তারিখ : ৪/৮/২৫ ২য় বার আহত হওয়ার তারিখ সময় : ১৪/৮/২৫, ভোর রাত মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : ১৪/৮/২৫, সকাল ১০:৫৫ মিনিটে প্রস্তাবনা শহীদের পিতার ব্যবসার মূলধন বাড়াতে সহযোগিতা করা যেতে পারে শহীদের বোনকে শিক্ষা বৃত্তি দেওয়া যেতে পারে শহীদের পরিবারকে স্থায়ী বাসস্থান দেওয়া দরকার