জন্ম তারিখ: ২৮ আগস্ট, ১৯৯৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা: অফিস সহকারী, উইলিয়াম কেরি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, রাজাবাজার, ঢাকা শাহাদাতের স্থান: স্থান : নিউরোসাইন্স হাসপাতাল, ঢাকা
শহীদ পরিচিতি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার শুয়াগ্রাম ইউনিয়নের শান্ত এক গ্রাম সুয়াগ্রাম। সেই শান্ত গ্রামে জন্ম নিয়েছিল এক দুর্বার সাহসী প্রাণ রথিন বিশ্বাস। ১৯৯৯ সালের ২৮ আগস্ট, এই সাহসী সূর্যসন্তানের আবির্ভাব ঘটে দানিয়েল বিশ্বাস ও শেফালী বিশ্বাস দম্পতির ঘরে। ছোটবেলা থেকেই রথিন ছিলেন আত্মনির্ভরশীল, দায়িত্ববান ও পরিবারের প্রতি অতল শ্রদ্ধাশীল। জীবনের কঠোর বাস্তবতা তাকে অল্প বয়সেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। পিতার মৃত্যু, ভাই বোনের প্রতিবন্ধী জীবন, ও পরিবারের দুরবস্থার এই চাপ অপরিণত বয়সেই তার কাঁধে এনে দেয় পাহাড়সম দায়িত্ব। তিনি ঘর ছাড়েন, কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসা ছাড়েননি। চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়। সেখানেই পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার উইলিয়াম কেরি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে অফিস সহকারী পদে যোগ দেন। পরিবার চালানো, ভাই ও বোনের চিকিৎসার খরচ জোগানো সব দায়ভার একাই কাঁধে তুলে নেন এই তরুণ। অফিসের কাজ, ছোট্ট এক ভাড়া বাসা আর পরিবারের প্রতি টান এটাই ছিল রথিনের জগৎ। কিন্তু এই সাধারণ জীবনের আড়ালেই লুকিয়ে ছিল এক বিপ্লবী সত্তা। যে অন্যায় মেনে নিতে পারত না। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে জানত। ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট, ইতিহাসের রচিত একটি দিন। সেদিন খুনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের মিছিলে ঢাকার রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠে। একপর্যায়ে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। ছাত্র-জনতা বিজয় মিছিল নিয়ে রাজপথ ও সংসদ ভবন সহ সারাদেশে বিজয় মিছিলের আয়োজন করে। রথিন বিশ্বাসও সেই মিছিলে অংশ নেন, নির্ভীক চিত্তে, অবিচল সংকল্পে। মিছিলটি যখন সংসদ ভবন এলাকার নিকটে পৌঁছায়, তখন আকস্মিকভাবে একটি কাঁচের টুকরো ভেঙে পড়ে তার মাথায়। রক্ত ঝরতে থাকে। ব্যথা ছিল, রক্ত ছিল, কিন্তু তবুও ছিল না ভয়ের ছায়া। তাকে দ্রুত নিউরোসাইন্স হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু মৃত্যুকে ঠেকানো গেল না। আন্দোলনের রাজপথে শহীদ হলেন এক তরুণ, যে শুধু নিজের পরিবারের নয় দেশেরও ভবিষ্যৎ ছিল। পরদিন, নিথর দেহটি ফিরে আসে নিজের মাটিতে। যেখানে একদিন খেলাধুলা করেছিলেন, স্বপ্ন বুনেছিলেন, সেই উঠানে তাকে শায়িত করা হয়। তার বাবার কবরের পাশেই। খ্রিস্টান ধর্মীয় রীতিতে সম্পন্ন হয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। আকাশ যেন সেদিন কিছুটা বেশি ভারী ছিল, বাতাস যেন কাঁদছিল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শহীদ রথিন বিশ্বাসের ভাবী মাধবী বাড়ৈ বলেন- "আমার স্বামী শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ও একজন সরল প্রকৃতির মানুষ। একজন ননদ, সে-ও প্রতিবন্ধী। দেবর রথিন বিশ্বাসের সহযোগিতায় আমাদের সংসার চলত। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রথিন শহীদ হয়। এর পর থেকে আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি। আমাদের যেকোনো বিপদে-আপদে রথিনই ছিল একমাত্র ভরসা। রথিনকে আমরা সন্তানের মতো জানতাম। আমরা এখন কীভাবে বাঁচব?’ এই কান্না শুধু এক পরিবারের নয়, এক জাতির কান্না। এক তরুণের অকালপ্রয়াণ শুধু তার স্বজনদের জন্য নয়, আমাদের সমাজের জন্যও অপূরণীয় ক্ষতি। গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, আমরা শহীদ রথিন বিশ্বাসের বাড়ি ঘুরে এসেছি। তাঁর পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন সব সময় থাকবে।’ রথিন বিশ্বাসের ভাই ও বোনের জন্য দ্রুত প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করাসহ চিকিৎসার উদ্যোগ নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রথিন বিশ্বাস ছিলেন না শুধু একজন চাকরিজীবী তরুণ। তিনি ছিলেন এক অজেয় বীর। যিনি বিশ্বাস, ন্যায়বোধ, আর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন। অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা রথিন বিশ্বাস ছিলেন একটি পরিবারের মূল অবলম্বন। তার মৃত্যুতে পরিবারটি মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। নিচের প্রস্তাবনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি: ১. প্রতিবন্ধী ভাতা: শহীদের ভাই ও বোনের জন্য আজীবন প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ২. মাসিক ভাতা: পরিবারটির জন্য অন্তত ১৫,০০০ টাকা মাসিক সরকারি সহায়তা চালু করা উচিত। ৩. আবাসন সহায়তা: শহীদ পরিবারের জন্য একটি স্থায়ী আবাসন নির্মাণ অথবা গৃহ নির্মাণ সহায়তা প্রদান। ৫. এককালীন আর্থিক অনুদান: পরিবারটির পুনর্বাসনের জন্য কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা এককালীন অনুদান প্রদান করা প্রয়োজন। ৬. চাকরি সংস্থান: শহীদের পরিবারের একজন সদস্যকে সরকারি বা উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এক নজরে শহীদ রথিন বিশ্বাসের প্রোফাইল নাম : রথিন বিশ্বাস পিতা : দানিয়েল বিশ্বাস (প্রয়াত) মাতা : শেফালী বিশ্বাস জন্ম : ২৮ আগস্ট ১৯৯৯ ঠিকানা : গ্রাম: সুয়াগ্রাম, ইউনিয়ন: শুয়াগ্রাম, উপজেলা: কোটালীপাড়া, জেলা: গোপালগঞ্জ আহত হওয়ার তারিখ : ৫ আগস্ট ২০২৫ আহতের স্থান : সংসদ ভবন এলাকা, ঢাকা মৃত্যুর সময় ও স্থান : ৫ আগস্ট ২০২৫, নিউরোসাইন্স হাসপাতাল, ঢাকা দাফনের স্থান : নিজ বাড়ির উঠানে, বাবা-মায়ের কবরের পাশে (খ্রিস্টান ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী)