জন্ম তারিখ: ৭ আগস্ট, ১৯৭৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : কৃষক শাহাদাতের স্থান: মেহেরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন, নরসিংদী
রক্তাক্ত শ্রাবণের কৃষক শহীদ শহীদ পরিচিতি নরসিংদীর রায়পুরার প্রত্যন্ত এক গ্রাম, বীরগাঁও নিলক্ষা পশ্চিম পাড়া। এই জনপদেরই একজন নিঃস্ব কৃষক ছিলেন মো: হাছান মিয়া। যিনি জীবনের পরতে পরতে সংগ্রাম বুনেছেন, আর মৃত্যুর মুহূর্তে দেশের সঙ্গে আত্মিক বন্ধনে অটুট থেকে জীবন উৎসর্গ করেছেন। ১৯৭৮ সালের ৭ আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন চুন্নু মিয়া ও আলেছা খাতুনের ঘরে। পিতামাতা বহু আগেই মারা যান। নিজের মতো করে জীবনকে গড়ে তুলেছিলেন হাছান মিয়া। ছিলেন সরল, সৎ, নিরহংকার। জীবনযুদ্ধে হার না মানা এই কৃষক শেষ পর্যন্ত জয়ী হলেন শহীদের গৌরবময় মৃত্যুতে। জন্ম ও কর্ম গ্রামের জমিনে কাজ করেই জীবন চলত হাছান মিয়ার। নিজের কোনো জমিজমা ছিল না, তবে অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সারা দিন রোদের মধ্যে ধান কাটতেন, কলা বহন করতেন, কখনো ক্ষেতের আল ঠিক করতেন। দিনে এক মুঠো ভাত, রাতে আধপেটা ঘুম এই ছিল তাঁর জীবন। তাঁর প্রথম স্ত্রী পপির সঙ্গে ২০০৮ সালে বিচ্ছেদ ঘটে। দ্বিতীয় স্ত্রী ফুলমালার সঙ্গেও দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয়নি। দুই সংসারে তিন সন্তান রেখে চলে গিয়েছেন একাকীত্বের পথে। অর্থনৈতিক বিবরণ হাছান মিয়ার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যথা ছিল তাঁরসন্তানদের ভবিষ্যৎ। বড় ছেলে রহমত উল্লাহ বর্তমানে বড় চাচার কাছে থেকে টেকনিক্যাল স্কুলে পড়ে। রাকিব মিয়া, দ্বিতীয় ঘরের সন্তান, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে, কিন্তু সংসার ভাঙনের পর মা বাবা কারো ছায়াই সে পায়নি। আর মেয়ে আফসানার কপালে পড়াশোনা নয়, বিবাহই তার একমাত্র গন্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারটির নিজস্ব কোনো জমি নেই। ছোট একটি টিনের চালা, তাও ভাঙাচোরা। আন্দোলনে যোগদান ২০২৪ সালের জুলাই মাস। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় সাধারণ মানুষও। হাছান মিয়ার মতো খেটে খাওয়া কৃষকরা বুঝে গিয়েছিল এই আন্দোলন তাদেরই অধিকারের জন্য। ২০ জুলাই, সকাল ১০টার দিকে মেহেরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে যখন মিছিল শুরু হয়, তখন হাছান মিয়া নিজ হাতে তৈরি করা একটি পতাকা হাতে নিয়ে সেই মিছিলে যোগ দেন। তাঁর চোখে ছিল আশার ঝিলিক, কণ্ঠে ছিল স্লোগানের আগুন। জুলাই-আগস্টের প্রেক্ষাপট ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন জাগরণের সময়। বৈষম্যের বিরুদ্ধে, অধিকার আদায়ের জন্য, অন্যায়ের প্রতিবাদে দেশের আনাচে-কানাচে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে এসেছিল। বিজিবি এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই আন্দোলন দমন করতে মাঠে নামে। শান্তিপূর্ণ মিছিলে বারবার হামলা হয়। কিন্তু জনগণের দৃঢ়তা ভাঙতে পারেনি কেউ। যেভাবে তিনি শহীদ হলেন ২০ জুলাই, সকাল ১২টা। হাছান মিয়া তখন ইউনিয়ন পরিষদের সামনে ছাত্রদের মিছিলে স্লোগান দিচ্ছিলেন। হঠাৎই আকাশ ফাঁটানো শব্দ গুলির শব্দ। বিজিবি বাহিনী মিছিল লক্ষ্য করে গুলি চালায়। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার চিৎকার, ছোটাছুটি, কান্নার শব্দে ভরে ওঠে বাতাস। সেই মুহূর্তে একটি গুলি এসে হাছান মিয়ার বুকে বিদ্ধ হয়। তিনি লুটিয়ে পড়েন। কেউ ডাকতে পারেনি, কেউ ছুঁতে পারেনি হাছান মিয়া আর ওঠেননি। দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে তাঁর নিথর দেহটিকে গ্রামের কিছু যুবক কাঁধে করে নিয়ে যান। সেইদিনই নিজের জন্মভূমিতে, নিজ গ্রামে চিরবিদায় নেন শহীদ হাছান মিয়া। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের অনুভূতি শহীদ হাছান মিয়ার ভাই, চোখে জল আর গলায় দমচাপা কান্না নিয়ে বলেছিলেন, “সে কোনো নেতা ছিল না, বক্তা ছিল না। কিন্তু নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত দেশপ্রীতি দেখিয়ে গেছে।” ছেলে রহমত উল্লাহ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল বাবার কবরের পাশে। বলল না কিছুই, শুধু একবার মাটিতে বসে কবরের মাটি ছুঁয়ে বলল, “বাবা, আমি পড়ালেখা শেষ করে তোমার মতোই অন্যায়ের প্রতিবাদ করব। তুমি দেখো” অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা প্রস্তাবনা-১: শহীদ হাছান মিয়ার পরিবার বিশেষ করে বড় ছেলে রহমত উল্লাহর পড়াশোনা ও জীবনের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে প্রতি মাসে কমপক্ষে ১৫,০০০/- টাকা সহায়তা প্রদানের অনুরোধ রইল। প্রস্তাবনা-২: বীরগাঁও গ্রামে শহীদ হাছান মিয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখতে ও তাঁর সন্তানদের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করতে একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করা হোক। শেষ কথা শুধুমাত্র একজন শহীদের নয়, বরং হাজারো নামহীন প্রতিবাদীর কণ্ঠস্বর। শহীদ হাছান মিয়া ছিলেন সেই সব মানুষের প্রতিনিধি, যারা চায় না ক্ষমতা চায় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। তার রক্তে রাঙানো মাটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলাদেশ এখনও প্রতিবাদে বেঁচে আছে। একনজরে শহীদ সম্পর্কিত তথ্যাবলি নাম : মো: হাছান মিয়া জন্ম তারিখ : ০৭ আগস্ট ১৯৭৮ জন্মস্থান : রায়পুরা, নরসিংদী, পেশা: দিনমজুর পিতার নাম : চুন্নু মিয়া (মৃত) মাতার নাম : আলেছা খাতুন (মৃত) পেশা : কৃষক বিয়ে : ১ম - পপি (ডিভোর্স), ২য় - ফুলমালা (ডিভোর্স) সন্তান : ১. রহমত উল্লাহ ২. রাকিব মিয়া ৩. আফসানা আহত ও মৃত্যু : ২০/০৭/২৪, মেহেরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে, বিজিবির গুলিতে শহীদ কবরস্থান : নিজ গ্রামে অর্থনৈতিক অবস্থা : জমিজমা নেই, সন্তানদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত