জন্ম তারিখ: ২ মে, ১৯৫৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : হোটেল ব্যবসায়ী শাহাদাতের স্থান: বাইপাইল চত্তর সংলগ্ন, ঢাকা
একটি হোটেল ব্যবসায়ী, একজন পিতা এক সাহসী শহীদের কথা শহীদ পরিচিতি তাঁর নাম ছিল মো: ইসমাইল মোল্লা। নিঃশব্দ জীবন যাপনকারী এক সাধারণ মানুষ, যিনি ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, একজন পরিবারের কর্তা, একজন আশাবাদী বাংলাদেশি। কিন্তু ২০২৪ সালের এক নির্মম আগষ্ট দুপুরে, তিনি হয়ে উঠলেন ইতিহাসের অংশ একজন শহীদ। ১৯৫৭ সালের ২ মে, টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার দপ্তিয়র ইউনিয়নের মাইঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ইসমাইল মোল্লা। পিতা মৃত জয়েন মোল্লা ও মাতা মৃত জহিরন বেগমের বড় আদরের সন্তান ছিলেন তিনি। দারিদ্র্য ঘেরা এক গ্রামীণ জীবনে তাঁর শৈশব কেটেছিল নিঃস্বভাবে, কিন্তু অসীম আত্মসম্মানবোধ নিয়ে। কর্মজীবন জীবিকার তাগিদে তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন রাজধানীর কাছাকাছি ঢাকা জেলার সাভারের নবীনগর এলাকায়। সেখানে পলাশবাড়ী মহল্লায় শুরু করেন ছোট একটি খাবারের হোটেল। তাঁর হোটেল ছিল শ্রমজীবী মানুষের আস্থার জায়গা। স্বচ্ছতা ও সৎভাবে ব্যবসা করাটাই ছিল তার অহংকার। স্ত্রী মোসা: সাজেদা গৃহিণী, সংসারের গোছালো নারী। চার সন্তানের মধ্যে দুই কন্যার বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলে সজিব প্রাইভেট গাড়ি চালায়, আর ছোট ছেলে সুমন অটো চালিয়ে পরিবারের খরচ চালাতে সহায়তা করে। অর্থনৈতিক বিবরণ ইসমাইল মোল্লার দাদার বাড়িতে মাত্র ৯ শতাংশ জমি, যার ওপর একটি ভাঙ্গা টিনের ঘর। অথচ পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে এখন তারা থাকে নবীনগরের পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়। সেখানে বাসা ভাড়া, বাজার খরচ আর ছেলেদের অসংগঠিত উপার্জন মিলিয়ে তাদের জীবন প্রতিনিয়তই টালমাটাল। ইসমাইল মোল্লা ছিলেন পরিবারের চালিকাশক্তি। তার মৃত্যু শুধু একজন মানুষের প্রস্থান নয় একটি পরিবারের স্বপ্নের পতন। আন্দোলন যোগদান ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাস এক অগ্নিঝরা সময়। গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন। "হাসিনার পদত্যাগ" দাবিতে রাস্তায় নামে ছাত্র-জনতা। ইসমাইল মোল্লা সরাসরি রাজনীতিতে না থাকলেও দেশের চলমান অবিচারের প্রতিবাদ করতেন নিজের মত করে। বাইপাইল চত্তরে তাঁর হোটেল ছিল ছাত্রদের অন্যতম ভরসাস্থল। তিনি নিজেও মনে-প্রাণে আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। যেভাবে তিনি শহীদ হলেন ৫ আগস্ট, ২০২৪। সকাল ১১টা বাজে। বাইপাইল চত্তরে তখন উত্তেজনা তুঙ্গে। চারপাশে প্রতিবাদ, স্লোগান, মানুষের ঢল। আর ঠিক তখনই শুরু হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। পুলিশ বাহিনী, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের উপর। হঠাৎ করেই শুরু হয় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ। ইসমাইল মোল্লা তখন নিজের হোটেলে অবস্থান করছিলেন। আন্দোলনের গর্জনে আশঙ্কা করছিলেন কিছু একটা হবে। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা তাঁর হোটেলে ঢুকে পড়ে, ভাংচুর চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে তাঁর পা পুড়ে যায়। তাঁর ছেলেরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাইপাইল থেকে সাভারের হাসপাতাল পর্যন্ত রাস্তা ছিল রণক্ষেত্র। গুলির শব্দে আকাশ ভারী, সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের চলাচলে বাধা দিচ্ছে। চরম কষ্টে, রক্তাক্ত শরীরে, বিকেল ৩টার সময় তাঁকে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নেওয়া হয় কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। ডাক্তার জানিয়ে দেন, মো: ইসমাইল মোল্লা আর নেই। নিকটাত্মীয়ের অনুভূতি তাঁর স্ত্রী মোসা: সাজেদা কাঁদতে কাঁদতে বলেন- “উনি তো কারো ক্ষতি করেননি। সারা জীবন কষ্ট করে সংসার চালাইছে। ওর অপরাধ কী ছিল? আমার বাচ্চাগুলার কি হবে এখন?” ছেলে সজিব বলেন “বাবারে হাসপাতালে নেওয়ার সময় পুলিশের গুলির শব্দ আর সেনাবাহিনীর ভয় দেখানো সব মিলায়া আমরা থেমে গেছিলাম। যদি একটু আগে পারতাম নিতে... এখন সারাজীবন আফসোস কইরা যাইতে হইব।” অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা এই পরিবার এখন দিশেহারা। প্রস্তাবনা-১ : শহীদের ছোট ছেলে সুমনের জন্য একটি অটো রিকশা কিনে দিলে তার রোজগার নিশ্চিত হবে। প্রস্তাবনা-২: শহীদ পরিবারের জন্য মাসিক ১০,০০০/- টাকা সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে। প্রস্তাবনা-৩: গ্রামের বাড়িতে একটি টিনের ঘর তৈরি করে দিলে তারা অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে। শেষ কথা মো: ইসমাইল মোল্লা শুধু একজন ব্যবসায়ী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি পরিবারের সাহস, নির্ভরতা আর নিরব প্রতিবাদ। রাষ্ট্রের নির্মম আক্রমণে তার জীবন কেড়ে নেওয়া হলেও, ইতিহাস তাকে ভুলবে না। তার মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এ দেশে প্রতিবাদ করাও অপরাধ। আর সেই অপরাধেই শহীদ হতে হয়। একনজরে শহীদ সম্পর্কিত তথ্যাবলি নাম : মো: ইসমাইল মোল্লা জন্ম : ০২ মে ১৯৫৭, মাইঝাইল, দপ্তিয়র, নাগরপুর, টাঙ্গাইল পেশা : হোটেল ব্যবসায়ী স্ত্রী : মোসা: সাজেদা সন্তান : ৪ জন (২ ছেলে, ২ মেয়ে) শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৫ আগস্ট ২০২৪ আক্রমণকারীরা : পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ মৃত্যুর কারণ : আগুনে পুড়ে আহত, চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু দাফনস্থান : পলাশবাড়ী, বাইপাইল, নবীনগর, ঢাকা