জন্ম তারিখ: ৫ জানুয়ারি, ২০০৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : চাকুরিজীবি, ছাত্র শাহাদাতের স্থান: আল-হেরা মেডিকেল সেন্টার, গাজীপুর
রক্তজাগানো সাহসের নাম : শহীদ মো: বিপ্লব একটি আলো জ্বালানোর প্রয়াস শহীদ পরিচিতি মো: বিপ্লব, নামের মধ্যেই যেন প্রতিবাদের এক অগ্নিশিখা লুকিয়ে ছিল। জন্মেছিলেন ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি, টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী থানার কদমতলী গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। পিতা আ: খালেক জীবনের কঠিন সংগ্রামে অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালাতেন। মা বিলকিস বেগম ছিলেন একজন গৃহিণী। সংসারে ছিল আরেকটি ছোট মুখ ভাই বিজয়, বয়স মাত্র ৮ বছর, পড়ছে নার্সারিতে প্রত্যাশা মডেল স্কুলে। জন্ম ও কর্ম বিপ্লব ছোটবেলা থেকেই জীবনকে দেখেছিলেন অভাবের আয়নায়। বাবার ঘামে ভেজা পরিশ্রম, মায়ের ক্লান্ত চোখ, আর ছোট ভাইয়ের অসহায় চাহনিই তাকে জীবনসংগ্রামে জয়ের দৃপ্ত সংকল্প দিয়েছিল। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করতেন গাজীপুরের মাওনা এলাকায় কোথাও কোনো কারখানায়, কখনো দোকানে একমাত্র উদ্দেশ্য, বাবাকে আর দিনমজুরির জীবন থেকে মুক্ত করা, মাকে ভালো একটা চিকিৎসা ও স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়া, আর ছোট ভাইকে মানুষ করে গড়া। এই শিশু-কিশোরটি জীবনের দায়িত্ব বুঝেছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক বয়সেই। অর্থনৈতিক বিবরণ পরিবারটি ছিল দারিদ্র নিঃসন্দেহে সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। আ: খালেকের কাজের উপরই ছিল পুরো পরিবারের ভরণপোষণ। বিপ্লব মাওনায় গিয়ে কাজ করে যতটুকু আয় করতেন, তা মায়ের হাতে পাঠিয়ে দিতেন। ফোনে বলতেন, “মা, বিজয়রে মানুষ করবা। আমি তুমারে আর আব্বারে কষ্ট করতে দিব না।” এই কথাগুলিই এখন মা’র কানে ঘোরে, চোখে অশ্রুর নদী বয়ে যায়। আন্দোলনে যোগদান ও জুলাই-আগস্টের প্রেক্ষাপট ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট সময়টা ছিল এক রক্তক্ষরা অধ্যায়ের সূচনা। দেশের মানুষ বঞ্চনা, শোষণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। ছাত্ররা পথে নেমেছিল, গরিব শ্রমিকরা তাদের কণ্ঠে সুর মিলিয়েছিল। ৫ আগস্ট ছিল গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত দিন। গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তা ছিল ছাত্র-জনতার দখলে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়ক। সেদিন কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। বিপ্লবও সহকর্মীদের সঙ্গে বিজয় মিছিলে যোগ দেন। হৃদয়ে তার স্বপ্ন, চোখে আগামীর পথ। কিন্ত সেই পথ রক্তাক্ত হলো হঠাৎই। যেভাবে তিনি শহীদ হলেন বিকেল সাড়ে তিনটা। বিজয় মিছিল পৌঁছায় পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে। এমন সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের লোকজনের উসকানিতে পুলিশ বাহিনী মিছিলে গুলি চালায়। একের পর এক গুলি ছুটে আসে যেন বজ্রপাতের মতো। একটি গুলি বিপ্লবের চোখের সামনে ঢুকে মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। বন্ধুরা দৌড়ে নিয়ে যায় মাওনা আল-হেরা মেডিকেল সেন্টারে। সেখানেই চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঠিক বিকাল সাড়ে তিনটায় একই সময়ে যখন গুলি লেগেছিল হারিয়ে যায় একটি তরতাজা প্রাণ, একটি স্বপ্ন, একটি প্রতিজ্ঞা। প্রিয়জনের অনুভূতি বাবা আ: খালেক কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “সংসারের হাল ধরা ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে গেছি। সে সবসময় আমাদের খবর নিত। ছেলের শোকে ওর মা কাতর। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, আমাদের সহযোগিতা করা হোক। ছেলের হত্যার বিচার চাই।” প্রতিবেশী ইকবাল হোসেন বলেন “ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, অনিয়ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিজয় মিছিলে গুলিতে শহীদ হয়েছে সে। তার পরিবার মামলা করার চেষ্টাও করতে পারেনি, কারণ তারা খুবই দরিদ্র।” বিপ্লবের মৃত্যু একটি সংখ্যা নয়, এটি একটি সময়ের প্রতীক। তার রক্ত শুধু একটি তরুণ প্রাণের অবসান নয় বরং তা জাতিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “আর কত প্রাণ গেলে আমরা ন্যায়ের পথে ফিরব?” তার সাহসিকতা, আত্মত্যাগ এবং আদর্শ একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে, যেটি আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দোলন-সংগ্রামে আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলতে থাকবে। আল্লাহ যেন তাঁকে শহীদের মর্যাদা দান করেন। আমিন। প্রস্তাবনা ১. শহীদ বিপ্লবের বাবার জন্য একটি ছোট ব্যবসার ব্যবস্থা করা হোক, যেন তিনি পরিবার নিয়ে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারেন। ২. শহীদের পরিবারের জন্য সরকার বা সমাজের পক্ষ থেকে মাসিক ১৫,০০০ টাকা সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ৩. শহীদের ছোট ভাই বিজয়ের জন্য শিক্ষা বৃত্তি চালু করা হোক, যেন বিপ্লবের অসম্পূর্ণ স্বপ্ন কিছুটা হলেও পূর্ণ হয়। একনজরে শহীদ প্রোফাইল নাম : মো: বিপ্লব জন্ম তারিখ : ০৫/০১/২০০৯ জন্মস্থান : টাঙ্গাইল পেশা : চাকুরিজীবি, ছাত্র স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: কদমতলী, ইউনিয়ন: বীরতলা: থানা: ধনবাড়ী: জেলা: টাঙ্গাইল পিতার নাম : আ: খালেক পেশা : কৃষক মায়ের নাম : বিলকিস বেগম পেশা : গৃহিণী পরিবারের সদস্য : ভাই: ১, মোঃ বিজয়, বয়স: ০৮, প্রত্যাশা মডেল স্কুল, নার্সারী ঘটনার স্থান : মাওনা, গাজীপুর আক্রমণকারী : পুলিশ বাহিনী আহত হওয়ার তারিখ : তারিখ: ০৫/০৮/২৪ সময় : বিকাল ৩.৩০ মিনিট শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৫/০৮/২০২৪, আল-হেরা মেডিকেল সেন্টার সময় : বিকাল ৩.৩০ মিনিট শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : ০৬/০৮/২০২৪ নিজ গ্রামে কদমতলীতে দাফন করা হয়