Image of মো: শাহজাহান মিয়া

নাম: মো: শাহজাহান মিয়া

জন্ম তারিখ: ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: সিলেট

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : সিএনজি চালক শাহাদাতের স্থান : দক্ষিণ সুরমা থানার সংলগ্ন, সিলেট

শহীদের জীবনী

একজন সিএনজি চালক থেকে গণআন্দোলনের শহীদ শহীদ পরিচিতি মো: শাহজাহান মিয়া। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ সিএনজি চালক। কিন্তু তার মৃত্যু তাকে করে তুলেছে অসাধারণ। বেঁচে থাকাকালীন জীবনের প্রতিটি দিন তিনি কাটিয়েছেন পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে। আজ তিনি নেই। কিন্তু তার রক্তে ভেজা ভূমি গাইছে তার বীরত্বের গান। জন্ম ও শৈশব শাহজাহান মিয়ার জন্ম ১৯৯৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজার জেলার ছোট্ট গ্রাম সনকাঁপনে। তাঁর পিতা আরশ আলী মিয়া, মা রাবেয়া খাতুন। একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা। বয়স যখন কিশোর, তখন থেকেই সংসারের হাল ধরেন। স্বপ্ন ছিল, একদিন পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবেন, সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন, মা-বাবাকে আর কষ্ট করতে দেবেন না। কর্মজীবন দুঃখ-দারিদ্র তাকে কখনো দমাতে পারেনি। জীবনের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তিনি সিলেটে চলে যান রোজগারের জন্য। সেখানে সিএনজি চালিয়ে সামান্য আয় করতেন। বর্তমান ঠিকানা ছিল ধরাতেপুর, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট। সেই আয়েই চলত সংসার বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে। প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে বাড়ি ফিরতেন মাঝেমাঝে। পরিবারের মুখে হাসি দেখতেন আর নিজের ক্লান্তি ভুলে যেতেন। তাঁর আট বছরের ছেলে সম্রাট পড়ে কওমি মাদ্রাসার নার্সারিতে। তার মেয়ে সায়মা আর কোনদিন বাবার মুখ দেখতে পাবে না। অর্থনৈতিক বিবরণ নিজেদের কোনো জমি-জমা ছিল না। সিলেটে ভাড়া বাসায় থাকতেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন শাহজাহান। তাঁর ভাই, যিনি দুবাই প্রবাসী, মাঝেমধ্যে সাহায্য করতেন। দিন চলে যেত অনেক কষ্টে। তাঁর মৃত্যুতে পুরো পরিবার যেন ছিন্নমূল হয়ে গেছে। আন্দোলনে যোগদান ও প্রেক্ষাপট ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট। দেশজুড়ে শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। বিচারহীনতা, বৈষম্য, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে উঠেছিল তরুণদের গর্জন। এই আন্দোলন রূপ নেয় এক গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনের। ৫ আগস্ট দেশজুড়ে আনন্দ মিছিল হয়। নিরীহ মানুষ, শ্রমজীবী, ছাত্র, শিক্ষক সবাই আনন্দে ফেটে পড়ে। শাহজাহান মিয়াও এই আনন্দের শরিক হতে বেরিয়ে পড়েন। তিনি শুধু একজন সিএনজি চালক ছিলেন না, ছিলেন এই দেশের একজন জাগ্রত নাগরিক। যিনি বিশ্বাস করতেন এই পরিবর্তনের ঢেউ তার জীবনেও আলো আনবে। যেভাবে তিনি শহীদ হন দক্ষিণ সুরমা থানার সামনে আনন্দ মিছিল হয়। মিছিলের স্রোত যখন থানার ফটক ছুঁয়ে যায়, তখন পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে। বিনা উস্কানিতে, শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলির হুলস্থুল পড়ে যায়। শাহজাহান মিয়াও ছিলেন সেই মিছিলে। বিকাল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে, হঠাৎ গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সেখানেই বিনা চিকিৎসায় তার প্রাণ যায়। এমনকি লাশটুকুও তার পরিবার ফিরে পায়নি। পুলিশ তার মরদেহ গুম করে দেয়। শোকস্তব্ধ পরিবার আজও খুঁজে ফিরছে প্রিয় সন্তানের লাশ। তার মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ পর, ১২ আগস্ট, জন্ম নেয় তার মেয়ে সায়মা। বাবার মুখ দেখার আগেই সে হয়ে ওঠে পিতৃহীন। পরিবারের কান্না, প্রতিবেশীর কষ্ট শাহজাহান মিয়ার পিতা আরশ আলী মিয়া বলেন- “গত বছরের ঈদেও ছিল আমাদের পরিবারের আনন্দ। এবার শুধু কান্না। আমার ছেলে আর আসবে না। ঈদের আগের দিন আমরা তার জন্য অপেক্ষা করতাম। এবার সেই দিনটা এলো, কিন্তু ছেলে আসেনি। বুকটা ফেটে যায়। আমরা ভিডিওতে দেখেছি, কিভাবে আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই” প্রতিবেশী জাহানারা বেগম বলেন- “সিলেটে সিএনজি চালিয়ে কোনোমতে চলত ওর সংসার। প্রতি বছর ঈদের আগের দিন নতুন জামা নিয়ে বাড়ি আসত। এ বছর সে নেই। ওর স্ত্রী ও সন্তানদের দিকে তাকালে চোখ ভিজে আসে।” পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার বিস্তারিত বিবরণ নিজেদের কোনো জমি-জমা নেই। সিলেটে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। ভাইদের সহযোগিতায় তার পরিবার চলে। এক ভাই দুবাই থাকে। সে সহযোগীতা করে শহীদের পরিবারকে। পরিবারের সদস্যরা এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা পুরো পরিবার। ঘটনা সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা গণঅভ্যুত্থানে দেড় সহস্রাধিক প্রাণ বিসর্জন দেয়। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতনের পর ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিলে গিয়েও প্রাণ হারান অনেকে। তাদেরই একজন মৌলভীবাজারের শাহজাহান মিয়া। ০৫/০৮/২০২৪ তারিখে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে দুপুর বেলায় সরকার পতন হয়। পতনের খবরে আনন্দ মিছিল বের হয়। সিএনজি চালক শাহজাহান মিয়াও সেই মিছিলে যোগ দেয়। মিছিল দক্ষিণ সুরমা থানার ফটক ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করলে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করে। পুলিশের গুলিতে শাহজাহান মিয়া নিহত হন। মৃত্যুর সময় তার স্ত্রী ছিলেন সন্তানসম্ভবা। তার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর ১২ আগস্ট জন্ম নেয় তার কন্যাসন্তান, যে বাবার মুখ দেখার আগেই এতিম হয়ে যায়। পুলিশ তার লাশটাও গুম করে ফেলে। পরিবার আজও তার লাশ খুঁজে পায়নি। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়র অনুভূতি শহীদ শাহজাহান মিয়ার ছোট কুটিরে গেলে তার বাবা আরশ আলী মিয়া বলেন, ‘গত বছরের ঈদেও আমাদের পরিবারে ছিল আনন্দ আর আনন্দ। ছিল পরিপূর্ণ একটি পরিবার। কিন্তু আমাদের আনন্দ আর নেই। ছেলে হারানোর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে ফেলেছি বেঁচে থাকার প্রেরণাও। এবার ঈদের দিনে ছেলের জন্য শুধুই কেঁদেছি। আমার ছেলে সিলেটে থেকে সিএনজি চালাত। প্রতি সপ্তাহে বা পনের দিনে বাড়িতে এসে পরিবারের খরচ দিয়ে যেত। আর ঈদের আগের দিন আমরা সন্ধ্যা হলেই অপেক্ষায় থাকতাম কখন ছেলে বাড়িতে আসবে, একসাথে সবাই মিলে ঈদ করব। কিন্তু এ বছর ছেলে আমার নেই। বুকটা শুন্য করে দিয়ে গেছে। গত বছর ৫ আগস্টের সরকার পতনের পর সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় পুলিশের গুলিতে আমার ছেলে শহীদ হয়। এখনো আমরা আমাদের ছেলের লাশ পাইনি। আমরা ভিডিওতে দেখেছি কিভাবে তাকে গুলি করে মারা হয়েছে।’ শাহজাহান মিয়ার প্রতিবেশি জাহানারা বেগম জানান, ‘সিলেটে সিএনজি চালিয়ে কোনো রকম সংসার চালাতো সে। প্রতি বছর ঈদের আগের দিন তার মা ও বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন কাপড় কিনে আনতো শাহজাহান। এ বছর ঈদে সেতো এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। শাহজাহান এবারের ঈদে আর নেই। তার পরিবারে কিভাবে ঈদের আনন্দ করবে? তার পরিবারটা কষ্টে রয়েছে। তার ও তার পরিবারের জন্য আমাদের খুবই কষ্ট হচ্ছে।’ প্রস্তবনা প্রস্তাবনা-১: ছেলে-মেয়ের জন্য মাসিক খরচ বাবদ ১৫০০০ টাকার সহযোগীতা করা যেতে পারে। প্রস্তাবনা-২: থাকার জন্য একটি ঘর করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। একনজরে শহীদ প্রোফাইল নাম : মো: শাহজাহান মিয়া জন্ম তারিখ : ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ জন্মস্থান : মৌলভীবাজার পেশা : সিএনজি চালক স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: সনকাঁপন, ইউনিয়ন: ৯ নং আমতৈল, থানা: সদর, জেলা: মৌলভীবাজার বর্তমান ঠিকানা : মহল্লা: ধরাতেপুর, থানা: দক্ষিণ সুরমা, জেলা: সিলেট পিতার নাম : আরশ আলী (৭৫) মায়ের নাম : রাবেয়া খাতুন (৬৫) পেশা : গৃহিণী স্ত্রীর নাম : ঝর্ণা (২৬) পেশা : গৃহিণী পরিবারের সদস্য : ছেলে: ১, মেয়ে: ১ : ১. সম্রাট, বয়স: ৮, পেশা: ছাত্র, কওমী মাদ্রাসা, শ্রেণি: নার্সারী, সম্পর্ক: ছেলে : ২. সায়মা, বয়স: ১০ মাস, সম্পর্ক: মেয়ে ঘটনার স্থান : দক্ষিণ সুরমা থানার সামনে, সিলেট আক্রমণকারী : পুলিশ বাহিনী আহত হওয়ার তারিখ : ০৫/০৮/২৪ সময় : বিকাল ৩-৪ টার মধ্যে, থানার সামনে শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৫/০৮/২৪ সময় : বিকাল ৩-৪ টার মধ্যে, থানার সামনে শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : লাশ পাওয়া যায়নি শাহজাহান মিয়া ছিলেন একজন সৎ, পরিশ্রমী, নিরীহ মানুষ। তিনি চেয়েছিলেন শুধু পরিবারের ভালো রাখতে। কিন্তু সময় তাকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন ইতিহাসের পাতায়। তার রক্তে লিখে গেছে একটি গণজাগরণ, একটি পরিবর্তনের গল্প। শাহজাহান মিয়ার মতো মানুষেরা আমাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান যারা রক্ত দিয়ে কিনে এনেছেন মুক্তির ভোর। তার জন্য আমরা কেবল একটি ঘর চাই। তার সন্তানদের জন্য চাই শিক্ষার নিশ্চয়তা। তাহলেই শহীদ শাহজাহান মিয়ার আত্মত্যাগ পূর্ণতা পাবে।

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: শাহজাহান মিয়া
Image of মো: শাহজাহান মিয়া
Image of মো: শাহজাহান মিয়া
Image of মো: শাহজাহান মিয়া
Image of মো: শাহজাহান মিয়া

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: মোনায়েল আহমেদ

রিপন চন্দ্র শীল

মো: আনাছ মিয়া

পঙ্কজ কুমার কর

আজমত আলী

মোস্তাক আহমদ

তাজউদ্দিন

তারেক আহমেদ

মো:  কামরুল ইসলাম পাভেল

জয় আহমেদ হাসান

ময়নুল ইসলাম

মো: আয়াতুল্লাহ

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo