জন্ম তারিখ: ১০ মার্চ, ২০০৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : ব্যবসায়ী (অনলাইন), শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ী থানার সামনে, ঢাকা
সাইফ আরাফাত শরীফ। জন্ম ২০০৪ সালের ১০ মার্চ, নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার কদমির চর গ্রামে। জীবনের শুরু থেকে সংগ্রামই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। পরিবারে অভাব ছিল প্রতিদিনকার বাস্তবতা, আর অসুস্থ বাবার ভার কাঁধে নিয়ে ছোটবেলা থেকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল তাকে। শৈশব ও পরিবারের বিবরণ পিতা কবির হোসেন, শারীরিকভাবে দুর্বল ও কর্মক্ষমতাহীন। মাতা মরিয়ম বেগম গৃহিণী; সংসারের প্রতিটি দুঃসময়ে ছেলেকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। দুই বোনের একমাত্র ভরসা ছিল এই তরুণ। ছোটবোন বলেন "ভাই ছিল আমাদের পরিবারের সবার আদরের। সে না থাকায় আমাদের পুরো পরিবার এলোমেলো হয়ে গেছে। ভাইকে ছাড়া বেঁচে তো আছি ঠিকই, কিন্তু ভালো নেই আমরা।" কর্মজীবন ও জীবনের লড়াই জীবিকার তাগিদে সাইফ আরাফাত অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন। ‘ইভিকন’ নামে একটি অনলাইন প্রতিষ্ঠানেই কাজ করতেন। যাত্রাবাড়ীতে মদিনা মসজিদের গলিতে ভাড়া বাসায় থাকতেন মায়ের সাথে। সংসারের প্রতিটি খরচ তাকেই চালাতে হতো। এক অর্থে তিনিই ছিলেন পুরো পরিবারের প্রাণভোমরা। আন্দোলনের ময়দানে এক সাহসী যোদ্ধা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট। এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে দেশের শহর থেকে শহরতলি। বৈষম্যের বিরুদ্ধে তরুণদের এই জাগরণে সামনে এসে দাঁড়ায় কিছু সাহসী কিশোর-তরুণ, যাদের অন্যতম ছিলেন সাইফ আরাফাত। বিজয়ের পরদিনও বসে থাকেননি তিনি। বন্ধুদের নিয়ে সকালের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে, রাতের পাহারায় থানার বাইরে সর্বত্র ছুটে বেড়িয়েছেন সেবার দায়িত্বে। একটি রক্তাক্ত রাতের বর্ণনা ১৩ আগস্ট বিকালে, যাত্রাবাড়ী থানার পাশে ছাত্র ছদ্মবেশে ১৫-২০ জনের একটি ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী দল আসে। তারা নিজেদের থানা পাহারায় সাহায্যকারী হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু বাস্তব উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তারা টার্গেট করে সাইফ আরাফাত শরীফ ও শহীদ সাইদুল ইসলাম ইয়াসিনকে, কারণ তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছিল ছাত্রদের। রাত গভীর হলে অধিকাংশ ছাত্র বাড়ি ফিরলেও সাইফ ও অল্প কয়েকজন থেকে যান। ভোর ৩:৩০ টার দিকে শেষবার বাসায় ফোন করে বলেন, “ভোরে ফিরে আসব, চিন্তা কোরো না মা।” ভোর ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে, সাইফ ও ইয়াসিন এক দোকান থেকে পানি কিনে ফেরার পথে অতর্কিত হামলায় পড়ে। ছাত্রলীগের সেই দল নির্মমভাবে সাইফকে মারধর করে, শরীরের নানা স্থানে গুরুতর আঘাত করে থানার সামনে ফেলে রেখে যায়। শেষ নিঃশ্বাসের পথে সকালে একটি অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে। ছাত্রলীগের একজন সন্ত্রাসী-ই কল করে জানায়: “আপনার ছেলেকে কেউ মারধর করে থানার কাছে ফেলে রেখে গেছে।” মা মরিয়ম বেগম ছুটে যান থানায়। ছেলেকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। জিজ্ঞেস করলে ইশারায় কয়েকজন ছেলে দেখিয়ে দেন যারা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলের অবস্থা খারাপ দেখে প্রথমে স্থানীয় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যান, কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ১৪ আগস্ট ২০২৪, সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে সাইফ আরাফাত শরীফ শহীদ হন। ফ্লোরে পড়ে থাকা ছেলের নিঃশেষ দেহ যখন মা বুকে জড়িয়ে ধরেন, তখন চারপাশ নিস্তব্ধ। রক্তমাখা কিশোরটি চিরতরে নীরব হয়ে যায়। অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট: শোকের ঋণ ও বাস্তবতা এই তরুণ শহীদের মৃত্যু তার পরিবারকে এক গভীর অন্ধকারে ঠেলে দেয়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যের মৃত্যুতে তারা আজ দিশেহারা। মায়ের বুক খালি, দুই বোন আজ ভাইহারা। কোনো স্থায়ী বাসস্থান নেই, আয় নেই, তবু বুকভরা গর্ব নিয়ে মা বলেন “ছেলেটা দেশের জন্য মরে গেল, আমি গর্বিত কিন্তু আমার সংসার কীভাবে চলবে?” একনজরে শহীদ সম্পর্কিত তথ্যাবলি শহীদের পূর্ণ নাম : সাইফ আরাফাত শরীফ জন্ম তারিখ : ১০ মার্চ ২০০৪ জন্মস্থান : আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ পেশা : ব্যবসায়ী (অনলাইন) কর্মরত প্রতিষ্ঠান : ইভিকন স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: কদমির চর, ইউনিয়ন: কালাপাহাড়িয়া : থানা: আড়াইহাজার, জেলা: নারায়ণগঞ্জ বর্তমান ঠিকানা : মহল্লা: মদিনা মসজিদের গলি, এলাকা: যাত্রাবাড়ী: জেলা: ঢাকা, (দক্ষিণ সিটি) পিতার নাম : কবির হোসেন, বয়োবৃদ্ধ মায়ের নাম : মরিয়ম বেগম, পেশা: গৃহিণী পরিবারের সদস্য : বোন: ২ ঘটনার স্থান : যাত্রাবাড়ী থানার সামনে, ঢাকা আক্রমণকারী : ছাত্রলীগ আক্রমণের ধরণ : শরীরে জখম, মারাত্মক আঘাত আহত হওয়ার তারিখ : ১৪ আগস্ট ২০২৪, সময়: ভোর ৫:০০-৬:০০ টা শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৪ আগস্ট ২০২৪, সময়: সকাল ১০:১৫ মিনিট শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : নিজগ্রাম আন্দোলনে ভূমিকা : বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য, ট্রাফিক ও নিরাপত্তায় অংশগ্রহণ আক্রমণকারীর পরিচয় : ছাত্রলীগের ছদ্মবেশী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কবরস্থান : নিজ গ্রাম, কদমির চর অর্থনৈতক প্রস্তাবনা : পরিবারকে এককালানী ভাতা প্রদান ও মা-বাবার চিকিৎসা ব্যায় প্রদান । সাইফ আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার রক্তে রাঙানো পথ আজও বলছে “আমি মরিনি, আমি হয়ে গেছি পতাকার ছায়া।”