Image of রমজান মিয়া জীবন

নাম: রমজান মিয়া জীবন

জন্ম তারিখ: ১০ অক্টোবর, ১৯৯৮

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৯ অক্টোবর, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা :জুতা কারখানার শ্রমিক শাহাদাতের স্থান :মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-ঢামেক।

শহীদের জীবনী

আলোকিত এক নাম রমজান মিয়া জীবন। তার নামের মধ্যেই যেন ছিল ভবিষ্যতের এক পূর্বাভাস। ‘রমজান’ সংযম, ত্যাগ আর ধৈর্যের প্রতীক; আর ‘জীবন’ একটি সাদামাটা, অথচ সংগ্রামে ভরা পথচলার প্রতিচ্ছবি। নিজের নামের মতোই তিনি যেন নিজের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ধারণ করেছেন সেই অর্থ ও দায়। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯৮ সালের ১০ অক্টোবর, কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার অন্তর্গত দিলালপুর ইউনিয়নের পাঠানহাটি গ্রামে। রমজান বেড়ে উঠেছেন এক নিঃস্ব, কিন্তু আত্মসম্মানে অটল পরিবারের কোলে। তার পিতা মো: জামাল মিয়া ছিলেন পেশায় দিনমজুর। এক সময় নিজ হাতে জমি চাষ করতেন, অন্যের খেতেও কাজ করতেন অক্লান্ত পরিশ্রমে। কিন্তু সময়ের ভারে নুয়ে পড়া শরীর আর দীর্ঘদিনের অসুস্থতা তাকে কর্মক্ষমতা থেকে ছিটকে দেয়। এখন শুধু চোখে বিস্ময় আর কপালে দুশ্চিন্তা। মাতা আমেনা বেগম নামটি যতই মায়াময় হোক, তার জীবন ছিল কঠোর বাস্তবতায় মোড়া। গৃহিণী হলেও সংসারের প্রতিটি দায়-দায়িত্ব তার মায়া ও মমতার পরিধির মধ্যেই চলত। টিনের চালার নিচে, কুঁকড়ে যাওয়া সেই কুটিরে তিনিই ছিলেন এই দরিদ্র সংসারের প্রধান আশ্রয়। রমজান মিয়ার পড়াশোনার পথ বেশি দূর এগোয়নি। অন্ন-বস্ত্রের চাহিদাই যেখানে প্রধান, সেখানে শিক্ষা ছিল বিলাসিতা। দিলালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাজীবন ছিল তার। অথচ সেই স্কুলজীবনই ছিল তার জন্য এক স্বপ্নের জানালা যেখান থেকে সে পৃথিবীকে একটু ভিন্ন চোখে দেখতে শিখেছিল। কিন্তু ভাগ্য তাকে বেশি সময় দেয়নি। বইয়ের ব্যাগ নামিয়ে, হাতে তুলে নিতে হয় হাল ধরার ভার। দারিদ্র‍্য ছিল তার প্রতিদিনের সঙ্গী। তবে সে দারিদ্র‍্যরে কাছে মাথা নত করেনি। ছোট থেকেই মায়ের আঁচল ধরে বাজারে যাওয়া, বাবার হাত ধরে জমিতে যাওয়া সবই তাকে বাস্তবতা চিনিয়ে দিয়েছিল। খুব কম বয়সেই বুঝে গিয়েছিল, এই পরিবারকে কেউ ভরসা দেবে না, তাকেই হতে হবে আশ্রয়ের প্রতীক। তাই তো হয়তো তার নামের শেষে যুক্ত হয়েছিল 'জীবন' একটি পরিবারের জীবনরেখা হয়ে ওঠার দায়ভারে। কর্মজীবন ও সংসার কৈশোরেই জীবনের নির্মম বাস্তবতা বুঝে নিতে হয়েছিল রমজান মিয়া জিবনকে। যখন অন্য কিশোরেরা বইয়ের পাতায় স্বপ্ন আঁকে, তখন তিনি পিঠে গাঁঠরি নিয়ে পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকার দিকে একটি কাজ, একটি আশ্রয়, একটি বেঁচে থাকার সুযোগের খোঁজে। ঢাকা শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে শুরু হয় তার কঠিন এক সংগ্রাম। এক জুতা কারখানায় শ্রমিক হিসেবে পান অস্থায়ী একটি চাকরি। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে শ্রম দিতে হতো, তীব্র গরমে মেশিনের পাশে কাজ করতে হতো ঘামে ভিজে যাওয়া শরীরে। তবু কোনো অভিযোগ ছিল না তার মুখে, ছিল না কোনো বিরক্তি ছিল শুধু একটা দৃঢ় সংকল্প: পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো। মাত্র ৫০০০ টাকা মাসিক আয়, এই সামান্য অর্থ দিয়েই চলতে হতো তার চারজনের সংসার। বৃদ্ধ পিতা মো: জামাল মিয়া, অসুস্থতার কারণে কর্মহীন; মাতা আমেনা বেগম, যিনি শুধু মমতার ছায়া দিতে পারেন, কিন্তু অর্থ উপার্জনে অপারগ; স্ত্রী সাহেরা খাতুন, যার চোখে ছিল স্বপ্ন, কিন্তু হাতে ছিল শুধু সংসারের দায়; আর নবজাতক শিশু মো: আয়ান যার দুধ, ওষুধ, আর এক চিলতে নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল শুধু রমজানের কাঁধে। নিজস্ব কোনো বাড়ি ছিল না। তারা আশ্রয় নিয়েছিল অন্যের টিনের চালা ঘরে অস্থায়ী, অনিশ্চিত, কিন্তু তাতেও ছিল এক ধরনের শান্তি। কারণ সেই ঘরের চৌকাঠের দায়িত্বে ছিল একজন পরিশ্রান্ত তৃপ্ত মানুষ রমজান মিয়া, যার মুখে ছিল ক্লান্তির ছায়া, কিন্তু হৃদয়ে ছিল অটুট ভালোবাসা। স্ত্রী সাহেরা খাতুন ছিলেন মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষিতা, কিন্তু জীবনযুদ্ধে তিনিও গৃহিণীর ভূমিকা নিয়েছিলেন। সংসারের প্রতিটি কোণে তার পরিচর্যা ছিল রমজানের শক্তির জোগান। আর তাদের দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ ছিল মো: আয়ান। মাত্র পাঁচ মাস বয়সী এক কোমল শিশু, যার মুখের দিকে চেয়ে রমজান বুঝতেন, কেন তাকে এত কষ্ট করতে হয়। সন্তানের হাসিমাখা মুখ তার ক্লান্তি ভোলাতো, ব্যথা ভুলাতো, অনিশ্চয়তা ঢেকে দিতো এক চিলতে ভবিষ্যতের আলোয়। রমজান মিয়ার জীবন ছিল শিকড়ের মতো নিচে নেমে অন্ধকারে আটকে থেকেও পুরো বৃক্ষটিকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা। তার শ্রমের বিনিময়ে টিকেছিল একটি পরিবার, টিকেছিল এক শিশুর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। তার ঘামেই ভেজা ছিল সংসারের চালচিত্র, আর তার নিরব আত্মত্যাগেই ফুটে উঠেছিল ভালোবাসার গভীরতা। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও যেভাবে তিনি শহীদ হলেন ২০২৪ সাল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর অধ্যায়ের নাম। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, ন্যায্য মজুরির অভাব, শ্রমজীবী মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের প্রতিবাদে যখন সারাদেশের শ্রমিক, ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে আসে, তখন রমজান মিয়াও বসে থাকতে পারেননি। তিনি ছিলেন এক জুতা কারখানার সাধারণ শ্রমিক, কিন্তু বুকের ভেতর পুঞ্জীভূত ছিল হাজারো কষ্টের অনুবাদ, অনুচ্চারিত প্রশ্ন আর অধিকারবঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস। এই আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি ছিল না; এটি ছিল ক্ষুধার্ত পেটের, ন্যায্য মজুরির, নিরাপদ জীবনের জন্য এক আহাজারি। ৫ আগস্ট ২০২৪। তীব্র রোদ, শহরের বাতাসে তখন উত্তেজনার গন্ধ। গুলিস্তানের আলু বাজার মোড়ে শ্রমিকেরা সমবেত হয়েছিলেন শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের দাবি তুলে ধরতে। ব্যানার হাতে, মুখে স্লোগান, হৃদয়ে আশা এই ছিল আন্দোলনের চেহারা। কিন্তু হঠাৎই সেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নেমে আসে আগুনের ছায়া। দুপুর ৩টা ৩০ মিনিটে হঠাৎ করেই খুনি হাসিনার আওয়ামী মদদপুষ্ট পুলিশ দল এসে কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। চিৎকার, দৌড়াদৌড়ি, রক্ত, কান্না আর আতঙ্কে মুহূর্তেই পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। রমজান মিয়া তখন সবার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে কারও গায়ে হাত তোলে না, মুখে কঠিন কথা বলে না। তবু সে ছিল এক প্রতিবাদী আত্মা, এক সাহসী শ্রমিক, যে জানতো ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোই বড় দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্র তার এই নীরব সাহসকে ক্ষমা করেনি। গুলির শব্দে আকাশ কেঁপে ওঠে, আর সেই শব্দের মধ্যেই রমজান মিয়া পড়ে যান মাটিতে। গুলি বিদ্ধ হয় তার শরীরে, ছিন্নভিন্ন করে দেয় ভবিষ্যতের সমস্ত স্বপ্ন। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে দীর্ঘ ৬৪ দিনের চিকিৎসা। রক্ত, ওষুধ, অক্সিজেন, চোখে জল সব কিছুর পরেও ৯ অক্টোবর ২০২৪, সন্ধ্যা ৭টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যু কোনো সাধারণ মৃত্যু ছিল না। এটি ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক নীরব আত্মবলিদান। একটি পরিবারের ভরসা, একটি শিশুর বাবার হাত, এক স্ত্রীর স্বপ্ন সব কিছুকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে শহীদ হন রমজান মিয়া জীবন। তার নিথর দেহ যখন নিজগ্রাম দিলালপুরের কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়, তখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল তাঁর চাচা রুমান মিয়ার কণ্ঠে এক আর্তনাদ “সে ছিল আমার ছেলের মতো। সব সময় হাসত, কখনো ওর মুখে ক্লান্তি দেখিনি। ও ছিল আমাদের আশার আলো। আমাদের জীবনটা এখন অন্ধকার।” এই অন্ধকার কেবল এক পরিবারের নয়, এটি এক সমাজব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি যেখানে শ্রমিকেরা রাস্তায় পড়ে থাকে রক্তাক্ত হয়ে, আর রাষ্ট্র মুখ ফিরিয়ে নেয়। শহীদ রমজান মিয়া জীবন আমাদের স্মৃতিতে থাকবেন না শুধু একজন শ্রমিক হিসেবে, বরং তিনি হয়ে উঠবেন প্রতিবাদের প্রতীক, ন্যায়ের জন্য লড়াই করা এক সাধারণ মানুষের অনন্ত প্রেরণা। নিকটাত্বীয়র বক্তব্য শহীদ সম্পর্কে চাচার মন্তব্য: আমি মো: রুমান মিয়া, বয়স: ৪১, পিতা: মৃত শাহেদ আলী মিয়া, মাতা: মোছা: মালেকা বেগম। শহীদ রমজান আমার ছেলের মত। সম্পর্কে সে আমার ভাতিজা, সে খুব ভালো ছেলে ছিল, সব সময় হাসি খুশি থাকতো, কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো। কখনও ওর হাসিমুখ ছাড়া দেখিনি। সে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিল। এক নজরে অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা ১. জরুরি ভিত্তিতে এককালীন অনুদান (খাবার, চিকিৎসা, ভরণপোষণ) দেওয়া যেতে পারে ২. শহীদের পরিবারের জন্য মাসিক ভাতা দেওয়া প্রয়োজন ৩. স্থায়ী বসতঘর নির্মাণে সহায়তা করা যেতে পারে ৪. স্ত্রী সাহেরা খাতুনের জন্য ঘরে বসে উপার্জনের সুযোগ (সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণ) দেওয়া যেতে পারে ৫. শহীদের সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে আজীবন শিক্ষা সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে একনজরে শহীদের প্রোফাইল নাম : রমজান মিয়া জীবন বয়স : ২৬ জন্ম তারিখ : ১০/১০/১৯৯৮ পেশা : জুতা কারখানার শ্রমিক শিক্ষাগত যোগ্যতা : ৫ম শ্রেণি, দিলালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পিতা : মো: জামাল মিয়া, বয়স: ৬২, পেশা: দিনমজুর, অসুস্থ মাতা : আমেনা বেগম, বয়স : ৫৫, গৃহিণী বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: পাঠান হাটি, দিলালপুর, ইউনিয়ন: দিলালপুর, থানা: বাজিতপুর, জেলা: কিশোরগঞ্জ মাসিক আয় : ৫০০০টাকা আয়ের উৎস : কৃষি কাজ স্ত্রীর নাম : সাহেরা খাতুন, বয়স: ২২, পেশা: গৃহিণী, শিক্ষ্যাগত যোগ্যতা: মাধ্যমিক ছেলে : ১ জন, নাম: মো: আয়ান, বয়স: ৫ মাস পরিবার এর অর্থনৈতিক অবস্থা: রমজান মিয়া পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন, নিজস্ব সম্পদ নাই, পরিবারটি অন্যের বাড়িতে আশ্রিত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে আহত হওয়ার তারিখ : ৫ আগস্ট ২০২৪, সময়: বিকাল ৩.৩০ মিনিট, স্থান: আলু বাজার, গুলিস্তান, ঢাকা শহীদ হওয়ার তারিখ ও স্থান : ৯ অক্টোবর ২০২৪, সন্ধ্যা ৭.০০টা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-ঢামেক আক্রমণকারী : পুলিশ কবর : নিজগ্রাম, দিলালপুর কেন্দ্রীয় কবরস্থান, বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ চোখে স্বপ্ন বুকে গুলি, এটাই কি আমাদের ইতিহাস? শহীদ আশিকুর রহমান হৃদয়

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of রমজান মিয়া জীবন
Image of রমজান মিয়া জীবন

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

রুমান বেপারী

মো: রশীদ

আরাফাত মুন্সি

হাফেজ মো: শরিফুল ইসলাম

মো: রফিকুল ইসলাম চঞ্চল

মো: মনির হোসেন

মো: রুখতন মিয়া

ডা: সজিব সরকার

মোঃ বাবুল মিয়া

ইসমাইল হোসেন রাব্বি

নাজমুল মিয়া

মো: আলামিন

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo