Image of মো: ফরিদ আহম্মদ ছৈয়াল

নাম: মো: ফরিদ আহম্মদ ছৈয়াল

জন্ম তারিখ: ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৬ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: চট্টগ্রাম

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : গার্মেন্টস শ্রমিক, কর্মরত প্রতিষ্ঠান: আবির ফ্যাশন শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ী থানা সংলগ্ন, ঢাকা

শহীদের জীবনী

এক শ্রমিকের অসমাপ্ত গল্প জন্ম ও বেড়ে ওঠা অভাবের অন্ধকারে জন্ম নেওয়া এক আশার প্রদীপ ১৬ অক্টোবর ২০০৪, চাঁদপুর জেলার ব্রাহ্মণ সাখুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মোঃ ফরিদ আহম্মদ ছৈয়াল। পিতার নাম মোঃ শাহআলম ছৈয়াল ও মাতার নাম হাওয়া বেগম। পৈতৃক সম্পত্তি কিংবা স্থায়ী কোনো সহায়-সম্পদ ছিল না। কয়েক দফা নদীভাঙনে বাড়িঘর হারিয়ে পরিবারটি একসময় দারিদ্র‍্যর ভয়াবহতম সীমায় এসে দাঁড়ায়। বাঁচার লড়াইয়ে মা-বাবা দুজনেই চলে আসেন ঢাকা শহরে, শুরু হয় কঠিন শ্রমজীবন। ফরিদ ছোট থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও দায়িত্বশীল। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষে আর সামনে এগোতে পারেননি শুধুমাত্র অভাবের কারণে। স্কুলের খাতা-কলমের বদলে তাঁর হাতে উঠেছিল সংসারের হাল। কিশোর বয়সেই বাবার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। নিজের চাওয়া-পাওয়া নয়, ফরিদ চাইতেন তাঁর বাবা-মা ভালো থাকুক, ঘরে একটি ফ্রিজ হোক, ছোট একটা জমি হোক যেখানে তারা মাথা গুঁজতে পারবে। মা'কে বলতেন, “আর কদিন কষ্ট করো মা, আমি তোমার দায়িত্ব নেবো।” এই স্বপ্ন পূরণের আশায় নিরলস পরিশ্রম করে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি পান আবির ফ্যাশনে, মাসিক ২৫ হাজার টাকা বেতনে। তিনি বলেছিলেন, প্রথম বেতন দিয়ে বাবা-মায়ের জন্য ভালো পোশাক কিনবেন। কিন্তু নির্মম নিয়তি তাঁর সেই স্বপ্নকে পূরণ হতে দিল না। তাঁর বেতনের টাকায় কিনতে হলো মৃত্যুর কাপড় একটি সাদা কাফনের জামা। আন্দোলনের দিনে; গুলিতে ঝরে গেল ভবিষ্যতের একটি স্বপ্ন ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। সকালটা ছিল অন্য সব দিনের মতোই, কিন্তু হাওয়া ছিল অন্যরকম। আগের রাতে ফরিদ আহম্মদ ছৈয়াল বন্ধুদের সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন “কাল গার্মেন্টস বন্ধ, আন্দোলনে যাই। এখন আর চুপ করে বসে থাকলে চলবে না।” এই কথার মধ্যে ছিল তার ভেতরের স্পষ্ট রাজনৈতিক সচেতনতা, ছিল সাহস আর সমাজ বদলের তাগিদ। যদিও সে নিয়মিত আন্দোলনে যেতে পারতেন না, কারণ কাজের চাপ ছিল, অভাবের সংসার ছিল। তবু যেদিন কারখানা ছুটি থাকত, সেদিন কোনো কিছু না ভেবেই ছুটে যেতেন রাজপথে, অন্য ভাইদের পাশে দাঁড়াতে। ৫ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে খেয়ে-দেয়ে তৈরি হন। এক বন্ধুর ফোন আসে “চল, আজ বড় মিছিল হবে, যাত্রাবাড়ী মোড়ে।” তিনি আর দেরি করেননি, বুকে সাহস আর হৃদয়ে বিপ্লবের আশা নিয়ে বের হয়ে যান নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ভাড়া বাসা থেকে। কিছুক্ষণ পর তিনি ছিলেন ঢাকার সাইনবোর্ড এলাকা থেকে শুরু হওয়া এক বিশাল মিছিলের অংশ, যার গন্তব্য ছিল গণভবন। বেলা সাড়ে ১১টা। মিছিলটি যাত্রাবাড়ী থানার সামনে পৌঁছালে, হঠাৎই আকাশ কেঁপে ওঠে গুলির শব্দে। পুলিশ কোনও পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আন্দোলনরত জনতার ওপর সরাসরি গুলি ছোঁড়ে। মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মানুষ। হঠাৎ ফরিদ আহম্মদ ছৈয়াল নিজের গলায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করেন। এক রাউন্ড গুলি তাঁর গলায় ঢুকে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এক হাতে গলা চেপে ধরেছেন, মুখে রক্ত, চোখে ভয় আর বিস্ময় এভাবে কেউ মারা যায়! আশেপাশে থাকা সহযোদ্ধারা দৌঁড়ে গিয়ে তাঁকে ধরে ফেলেন। একজন তরুণ কাঁদতে কাঁদতে বলেন “ভাই লাগছে? ভাই লাগছে?” ফরিদের ঠোঁট নড়ে, কিন্তু শব্দ বের হয় না। তাকে দ্রুত রিকশা, তারপর অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জরুরি বিভাগে নেওয়ার পর তার চারপাশে ছিল শুধু রক্ত, কান্না আর ব্যথা। ২৪ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার পর, ৬ আগস্ট রাত ৮টা ৫০ মিনিটে ফরিদ আহম্মদ ছৈয়াল এই পৃথিবীকে বিদায় জানান। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তেই। নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর, আন্দোলনের ভাইদের মুখে, পরিবারের কান্নায়, সহকর্মীদের স্তব্ধতায় একটাই নাম “ফরিদ ভাই আর নাই!” একজন গার্মেন্টস শ্রমিক, যিনি হয়তো রাজনীতির ভাষা জানতেন না, কিন্তু হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন মানুষের কষ্ট, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন নিজের সীমিত অবস্থান থেকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হলো। শহীদ হলেন তিনি তাঁর রক্তে রঞ্জিত হলো ২য় স্বাধীনতার লাল-সবুজ সংগ্রামপথ। ফরিদের মা পরে বলেছিলেন “ছেলেটা না থাকলে বুঝতাম না অভাব কত বড় হইছে। এখন তো ছেলেটাও নাই, কবর ছাড়া আর কিছু নাই।” মায়ের স্বপ্নের বটবৃক্ষ ভেঙে পড়ল, একটি পরিবারের আলো নিভে গেল। অথচ ফরিদের স্বপ্ন ছিল খুবই সাধারণ একটা ছোট ঘর, মা-বাবার জন্য আরাম, নতুন জামা আর একটু নিরাপদ জীবন। শুধু তাঁর পরিবার নয়, গোটা আন্দোলন হারালো এক নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধাকে যিনি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন ন্যায়ের পক্ষে। পরিবারের দুরবস্থা ও নিঃস্বতা; তিলে তিলে গড়া স্বপ্ন ভেঙে চুরমার একটি পরিবারের শেকড় উপড়ে ফেলা কতটা নির্মম হতে পারে, ফরিদ আহম্মদ ছৈয়ালের পরিবার তার জ্বলন্ত উদাহরণ। একসময় তাদেরও ছিল ঘর, উঠান, বাঁশের কঞ্চির বেড়া, কাঁচা মেঝে আর মাটির চুলা। কিন্তু সবকিছু একে একে গিলে নেয় নদী। কয়েক দফা নদীভাঙনের শিকার হয়ে হারিয়ে যায় তাদের ভিটেমাটি। নদী ভেঙেছে শুধু মাটি নয়, ভেঙেছে তাদের জীবনের ভিত, স্বপ্নের কাঠামো। এই দারিদ্র‍্য আর নিঃস্বতার ভারে যখন পরিবারটা নুয়ে পড়ে, তখন মা-বাবা বাধ্য হন শহরমুখী হতে। ঢাকার রাস্তায় এসে দাঁড়ান তারা, যেখানে মাথার উপর ছাদ নেই, কাঁধে আছে শুধুই ঋণ আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। কোনোরকমে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় এক ভাড়া বাসায় উঠেন। গলায় জীবিকার দড়ি বেঁধে দুজনেই ঢুকে পড়েন পোশাক কারখানার শ্রমিকজীবনে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি সেলাই মেশিনে ঝুঁকে বসে থাকতেন মা হাওয়া বেগম, আর বাবা শাহআলম ছৈয়াল প্যাকিং ইউনিটে হাড়ভাঙা খাটুনি দিতেন। তাদের জীবনে কোনো ছুটি নেই, ঈদ নেই, উৎসব নেই, শুধু টিকে থাকার লড়াই। একসময় সেই দুর্ভোগের মাঝে একটু আলো হয়ে আসে ফরিদ। ছোট থেকেই বুঝতে শিখেছিলেন, সংসার কী ভয়ংকর বাস্তবতা। নিজের স্বপ্নগুলোকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে পরিবারটাকে বাঁচিয়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। লেখাপড়া ছেড়ে কাজে ঢুকে পড়েন। দীর্ঘ পরিশ্রমের পরে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে আবির ফ্যাশনে চাকরি পান মাসিক ২৫ হাজার টাকায়। এই নিয়োগ যেন পরিবারটির কাছে ছিল জীবনের এক নতুন মোড়। মা প্রথমবারের মতো বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন “এইবার বুঝি কিছুটা বাঁচা যাবে।” ফরিদও আশ্বস্ত করে বলেছিলেন “মা, কিস্তিতে ফ্রিজ এনেছি। আর তোমার কষ্ট করতে হবে না। আমি আছি, সব ঠিক হয়ে যাবে।” এ এক অভাবের মধ্যে জন্ম নেওয়া সম্ভাবনার গল্প। কিন্তু সেই সম্ভাবনা হঠাৎ থেমে যায় এক গুলিতে। সেই ছেলে, যে কিনা প্রথমবারের মতো মায়ের হাতে শান্তির প্রতিশ্রুতি তুলে দিতে যাচ্ছিল, সে-ই রক্তাক্ত হয়ে ফিরলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাফনে মোড়া হয়ে। ফরিদ এখন আর নেই। নেই তাঁর কণ্ঠে স্বপ্নের কথা, নেই মায়ের জন্য ফ্রিজ কেনার হাসি। কিস্তির টাকা এখনো শোধ হয়নি, অথচ ব্যবহার করার কেউ নেই। ফ্রিজটা এখন পড়ে আছে কোণায় নিরব, ঠান্ডা, ফরিদের স্মৃতিতে ভরপুর। বড় ভাই আছেন একজন, কিন্তু তাঁর কোনো কাজ নেই। তিনিও আজ হতাশার ভিতরে দিন গুণছেন। পরিবারের অন্য কারও হাতে নেই স্থায়ী উপার্জনের উৎস। ফরিদের অনুপস্থিতিতে সংসার যেন আবারও সেই পুরনো অন্ধকারে ফিরে গেছে যেখানে প্রতিদিনের ভাতের যোগানই একটি চ্যালেঞ্জ। এখন তারা বেঁচে আছেন শুধু আশ্রয়প্রার্থীর মতো কখনও আত্মীয়, কখনও প্রতিবেশীর সহানুভূতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে। এই পরিবারটি শুধু নিঃস্ব নয়, তারা ভেঙে পড়েছে ভেতর থেকে। একমাত্র যে সন্তান তাদের ‘ঘর’ দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেই সন্তানকে কবর দিতে হয়েছে বিনা অপরাধে, বিনা বিচারে। শুধু চোখে ভাসে ফরিদের একটি কথা “আমাদের একটা ঘর হবেই, মা।” সেই ঘর এখন শুধু স্মৃতির ঘর। শহীদের প্রতি পরিবারের অনুভূতি “এই ছেলেটাই ছিল আমাদের আশার আলো” ফরিদের মা হাওয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন “এই ছেলেটা সবার চেয়ে আলাদা ছিল। কাজে-রান্নায়, বুদ্ধিতে সবার আগে। বলতো, মা আর বেশি দিন অভাব থাকবে না। কিস্তিতে ফ্রিজ কিনে দিছিল, কয়টা দিন আগে বলল ‘মা ঈদের আগে একটা জামা কিনে দিবো’। সেই জামাটা আর কেনা হলো না। উল্টো কাফনের কাপড় কিনতে হলো।” এই কথাগুলো শুধু একজন মায়ের নয়, একটি স্বপ্নবিহীন সমাজের আক্ষেপ। ফরিদ ছিলেন ভবিষ্যতের একজন সম্ভাবনা। গার্মেন্টসের চাকরি দিয়ে পরিবার চালানোর দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সহিংসতায় সেই স্বপ্ন নিভে গেলো। শহীদের প্রতি প্রস্তাবনা ১. বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হোক। শহীদ ফরিদ আহম্মদ ছৈয়ালের পরিবারের নিজস্ব কোনো বসতভিটা নেই। নদীভাঙনে ঘরহীন পরিবারটিকে স্বপ্নপূরণের একটিমাত্র পথ হতে পারে একটি স্থায়ী ঘর। ২. বড় ভাইয়ের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হোক। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম সদস্য ফরিদের মৃত্যুর পর এখন বড় ভাইকেই পরিবারের হাল ধরতে হবে। তার জন্য একটি টেকসই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে পরিবারটি পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। একনজরে শহীদের প্রোফাইল শহীদের পূর্ণ নাম : ফরিদ আহম্মদ ছৈয়াল জন্ম তারিখ : ১৬-১০-২০০৪ জন্মস্থান : চাঁদপুর পেশা : গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মরত প্রতিষ্ঠান : আবির ফ্যাশন স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: ব্রাহ্মন সাখুয়া, ইউনিয়ন: বাগাদি, থানা: চাঁদপুর সদর, জেলা: চাঁদপুর বর্তমান ঠিকানা : ব্লক- সি, লেন নং ৪, ফতুল্লা স্টেডিয়াম রোড, ইউনিয়ন: কুতুবপুর, থানা: ফতুল্লা, জেলা: নারায়ণগঞ্জ। পিতার নাম : শাহআলম ছৈয়াল মায়ের নাম : হাওয়া বেগম পরিবারের সদস্য : ৩, বাবা, মা, ভাই ঘটনার স্থান : যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আক্রমণকারী : পুলিশ আক্রমণের ধরণ : গলায় গুলি আহত হওয়ার তারিখ : ০৫/৮/২৪ সকাল ১১:৩০ শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৬/৮/২৪ রাত ০৮:৫০ মিনিট

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: ফরিদ আহম্মদ ছৈয়াল
Image of মো: ফরিদ আহম্মদ ছৈয়াল
Image of মো: ফরিদ আহম্মদ ছৈয়াল

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

আলমগীর হোসেন

 মো: শহীদুল ইসলাম

মো: রায়হান

নাঈমা সুলতানা

মোহাম্মদ সজিব

মো: রিপন

মো: বেলাল হোসেন

মো: ফয়সাল সরকার

মো: জাকির হোসেন (শাকিব)

মোহাম্মদ ইসমামুল হক

শামছুল ইসলাম

মো: মাহিন

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo