জন্ম তারিখ: ১৩ অক্টোবর, ১৯৯৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা: ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : উত্তরা আজমপুর
“মেধাবী তানভীনের শাহাদাত বরণ বাংলাদেশের অপূরনীয় ক্ষতি” রাজধানীর উত্তরায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার পেটুয়া বাহিনী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী জাহিদুজ্জামান তানভীন (২৫)। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রথম শহীদ তানভীন। ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি ঝোঁক ছিল মেধাবী জাহিদুজ্জামান তানভীনের। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পড়ালেখাটাও তিনি মন দিয়ে করেছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক দুই বোর্ড পরীক্ষায় তিনি জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে তানভীন ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রডাকশন বিভাগে ভর্তি হন। উক্ত বিভাগের ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও শুরু থেকেই রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন বুয়েট আয়োজিত “মডেল শিপ প্রোপালশন কম্পিটিশন” ও “সকার বট কম্পিটিশন”-এ অংশ নিয়ে হাতে তুলেন পুরস্কার। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছিল তানভীনের পদচারণা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনস্টিটিউশন অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং আয়োজিত ইউএএস এয়ারক্রাফট সিস্টেম প্রতিযোগিতায় তিনি চ্যাম্পিয়ন হন। ওই প্রতিযোগিতার ছয়টি পুরস্কারের মধ্যে তিনটিই তানভীন ও তার দল জয় পেয়েছিলেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নাসা আয়োজিত ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় বিশ্বে দশম এবং এশিয়ার মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেন তানভীনের দল। যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তরে পড়তে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। জাহিদুজ্জামানের স্নাতক শেষ হয়েছিল ২০২২ সালে। তিন বন্ধুকে নিয়ে 'অ্যান্ট' নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তাঁরা ড্রোন দিয়ে জরিপের কাজ করতেন। পাশাপাশি অনলাইনে ড্রোন বিক্রি করতেন। একমাত্র বোন জেসিকা জামান আয়েশা যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তর করছেন। জাহিদুজ্জামান তানভীন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শুরু থেকেই সক্রিয় ভাবে অংশ নেন। পরিবারের প্রয়োজনে আজমপুর এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে জাহিদুজ্জামান ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে বাসা থেকে বের হন। দ্রুতই ফিরে আসবেন বলে তাঁর মাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু আধা ঘণ্টা পর এক শিক্ষার্থী ফোন করে জানান, তাঁর ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। ১৮ জুলাই সাধারণ ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে উত্তরায় ঘাতক যুবলীগের সন্ত্রাস বাহিনী বা স্বৈরাচারের পুলিশের নিক্ষিপ্ত বুলেট তার গলায় বিদ্ধ হয়। বুকে বিদ্ধ হয় ছররা গুলি। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিলে ডাক্তার মেধাবী এই তরুণকে মৃত ঘোষণা করেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে এখন তার মা বিলকিস জামান (৪০) পাগলপ্রায়। থেকে থেকেই তিনি মূর্ছা যাচ্ছেন, বিলাপ করছেন। তানভীনের লাশকে জড়িয়ে তার আহাজারীতে ভারী হয়ে ওঠেছিল পুরো হাসপাতাল। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার সন্তানের লাশের বিনিময়ে দেশে শান্তি চাই।’ বিলকিস জামান আরো বলেন, ‘আমার ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতে স্থান দেবেন।' এসময় শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ কামনা করে তিনি বলেছিলেন, 'আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।' জাহিদুজ্জামান তানভীন মা-বাবা আর এক বোনকে নিয়ে থাকতেন উত্তরা আজমপুর কাঁচাবাজার জামতলার ভাড়া বাড়িতে। ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি ইউনিভার্সিটিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্টের ছাত্র ছিলেন তিনি। মা বিলকিস জামান গৃহিণী। জাহিদুজ্জামান তানভীনের মামা সমকালের সাংবাদিক আবু সালেহ মুসা বলেন, “অত্যন্ত মেধাবী জাহিদুজ্জামান তানভীনের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের ডিটি ভিশারা গ্রামে। তার বাবা শামসুজ্জামানও একজন ইঞ্জিনিয়ার। ঢাকায় টোয়া করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তিনি আরো জানান, বৃহস্পতিবার সকালে আজমপুর ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য বের হয়েছিলেন তিনি। বারোটার দিকে সংবাদ পান ভাগ্নে গুলিবিদ্ধ হয়ে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে আছেন। এরপর হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন আদরের ভাগ্নে মারা গেছেন।“ শহীদ তানভীন সম্পর্কে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারই বিভাগের সহপাঠী মো. মুস্তাকীম আবতাহী বলেন, “সাউথ হল অব রেসিডেন্সের ১১৯ নম্বর রুমের সি বেডে থাকত জাহিদুজ্জামান তানভীন। যন্ত্রকৌশল '১৭-এর সেরা ছাত্র। আমাদের বন্ধু। এই রুমে থাকতাম আমি, মিতিন, নেহাল, শাতিল আর তানভীন। চারজনের রুমে আমরা পাঁচজন থাকতাম। আমরা অনেকেই অনেক কিছু করার স্বপ্ন দেখতাম, শেষ পর্যন্ত সেটা আর বাস্তবায়ন করা হয়ে উঠত না। কিন্তু তানভীন যেটা চিন্তা করত, তা করে দেখাত। আমরা হয়তো ভাবতাম, টিউশনি করে টাকা জমিয়ে একটা ভালো ফোন কিনব। তানভীনের ভাবনা আলাদা। একবার তানভীন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটা রোবোরেস কম্পিটিশন জিতে এল। আমরা সবাই বললাম, 'ট্রিট দে!' কিন্তু সে ওই টাকার সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে একটা রেডিও ওয়েভ কন্ট্রোলার কিনে ফেলল। কারণ, থেমে থাকা যাবে না। এরপর বোট বানানো, বিদেশ থেকে ডিফারেন্সিয়াল আনিয়ে রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি বানানো। জল-স্থল- আকাশ, সব দিকেই ছিল তানভীনের আগ্রহ। ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) প্রতিটি শিক্ষাবর্ষ শেষে দুই মাসের ছুটি থাকে। আমরা সবাই বছর শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম। কারণ, ছুটি কাটাতে বাসায় যাব। তানভীন ওই সময়ে হলে বসে থেকেই ড্রোন বানানোর কাজ করত। আমরা যখন মেকানিকসের পড়া পড়তাম, তানভীনের টেবিলে তখন ফ্লুয়িড মেকানিকসের বই। আগ্রহের বিষয়গুলোর পেছনে ও এত বেশি সময় দিত, খুব অবাক হতাম। তানভীনের গল্প আসলে বলে শেষ করার নয়। কোনো কিছুতেই ওর 'না' নেই। আইইউটিতে ক্রিকেটে লং অনের সেরা ফিল্ডার, ফুটবলে লেফট ব্যাকের ভরসা, ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন। মার্শাল আর্টে ব্রাউন বেল্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়ররা অনেকেই ক্লাস বাদ দিয়ে তানভীনের সঙ্গে কাজ করতে চলে আসত। কারণ, সবার চোখেই তানভীন সেরা। ছোট-বড় সবার মনেই দাগ কেটে যেত। বেলা দুইটা হোক, কিংবা রাত দুইটা; আর কাউকে না পাওয়া গেলেও প্রয়োজনে তানভীনকে পাওয়া যেত ঠিকই। অথচ সেই ছেলেটার জানাজায়ও আমরা কেউ থাকতে পারলাম না। ১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়। তানভীনের লাশ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে জানাজা শেষে নিজ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। জাহিদুজ্জামান তানভীনের ব্যাংকে জমানো টাকা বন্যার্তদের সহায়তায় দিয়েছেন তার মা। ২৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে গিয়ে তার মা বিলকিস জামান টাকাগুলো জমা দেন। বিলকিস জামান বলেন, তানভীন মাটির ব্যাংকে টাকা জমাতো। ঘর গোছানোর সময় ব্যাংকটি পাই। এরপর টিএসসিতে ত্রাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে শুনে চলে এসেছি। তানভীনের জমানো টাকা দিয়ে কিছু সামগ্রী ও নগদ সহায়তা দিয়েছি। ছেলেকে হারানোর কষ্ট থাকলেও দেশের জন্য প্রাণ দেয়াতে গর্বিত বলেও জানান তিনি। প্রস্তাবনা পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান হারানো পিতা-মাতাকে সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। শহীদ তানভীনের মাকে মাসিক অথবা বাৎসরিক সহযোগিতা প্রদান করা যেতে পারে। বাবার জন্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দিলে উপকার হবে। একনজরে ব্যক্তিগত প্রোফাইল পুরো নাম : জাহিদুজ্জামান তানভীন জন্মতারিখ : ১৩/১০/১৯৯৮ পিতার নাম : মো: সামসুজ্জামান (৫২) চাকুরীজীবী মায়ের নাম : বিলকিস জামান (৪০) পেশা: গৃহিণী বোন : জেসিকা জামান পারিবারিক সদস্য : ২ জন পরিবারের মাসিক আয় : ৫০ হাজার টাকা স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: ভিটি-বিশারা, ইউনিয়ন: রতনপুর, থানা: নবীনগর জেলা : ব্রাহ্মণবাড়িয়া বর্তমান ঠিকানা : বাসা: সাইদ মহল, এলাকা: আজমপুর কাঁচা বাজার ঘটনার স্থান : আজমপুর আঘাতকারীর : স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ বা যুব লীগের সন্ত্রাসীবাহিনীতে মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : ১৮ জুলাই ২০২৪, বিকাল ৫ টা, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে