জন্ম তারিখ: ১৫ জুলাই, ২০০৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা : সিএনজি চালক , শাহাদাতের স্থান : মোহাম্মদপুর বসিলা রোড ময়ুর ভিলা এলাকায়
স্বৈরাচারী সরকার শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে যে সকল বীরেরা জীবন দিয়েছে তাদের মধ্যে শহীদ মো: সবুজ অন্যতম। জনাব মোহাম্মদ সবুজ দরিদ্র পরিবারের আদরের সন্তান। তিনি ভোলা জেলার লালমোহন গ্রামে ১৫ জুলাই ২০০৩ ইং জন্মগ্রহণ করেন। শহীদের পিতা জনাব কাউসার আহমেদ পেশায় একজন কৃষক। তার মাতা বিবি হাজেরা পেশায় গৃহিণী। মোট ছয় ভাই বোনের ছোট ছেলে তিনি। তার অমায়িক ব্যবহার যে কাউকেই আকৃষ্ট করতে বাধ্য। শহীদ সবুজ সিএনজি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ছেলে সবুজের জীবিকা নির্বাহের জন্য যখন কোন কর্ম ছিল না তখন পিতা ঋণ করে সিএনজি কিনে দেন। তিনি এই সিএনজি থেকে উপার্জনের টাকা দিয়েই সংসার চালাতেন এবং পিতা-মাতার সংসারের খরচও বহন করতেন। ঘটনা সংক্রান্ত বর্ণনা হাইকোর্ট ২০১৮ সালে চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে। ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট বেঞ্চ এ পরিপত্র বাতিল করে রায় দেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১ জুলাই ২০২৪ থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের ব্যানারে আন্দোলনের সূচনা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে এবং বিভিন্ন ছুটি থাকার কারণে ৬ জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রায় বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করে। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে লাগাতার আন্দোলন করতে থাকে। ১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে এবং ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম প্রদান করে। এরপরেও কোন সমাধান হয় না। ১৫ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ও ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসী বাহিনী, ভাড়া করা টোকাই লীগ শিক্ষার্থীদের উপরে নির্বিচারে হামলা চালায়। নারী শিক্ষার্থীদের উপরেও চালানো হয় নির্যাতন। এদিকে শহীদ আবু সাঈদকে ১৬ তারিখে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। যা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরে। যার ফলে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে সারাদেশেই শিক্ষার্থীদের উপরে চরম নির্যাতন করা হয়। তাদের উপরে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, বুলেট নিক্ষেপ করা হয়। শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ফলে নিজেদের স্থান দখল করে রাখে। পরবর্তীতে পুলিশ ও ছাত্র লীগের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের ক্যাম্পাস ও হল সমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধে সারা দেশ অচল হয়ে যায়। সরকার মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার, নির্যাতন, গুম এবং সরাসরি গুলি চালাতে থাকে। কারফিউ এর মধ্যেই চলতে থাকে সারাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন। দিনের পর দিন আহত এবং নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলতে থাকে। চার তারিখ পর্যন্ত প্রায় ৮ শত শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। কয়েক হাজার শিক্ষার্থীকে পঙ্গু বানিয়ে দেয়। স্বৈরাচারী সরকারের পেটুয়া পুলিশ বাহিনী, জঙ্গি ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং অন্যান্য পালিত বাহিনী ছাত্রদের উপরে সরাসরি এবং আকাশ থেকে হেলিকপ্টার এর মাধ্যমে গুলি বর্ষণ করে। শিক্ষার্থীরা অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি প্রদান করে। ৪ আগস্ট ‘মার্চ ঢাকা কর্মসূচি’ দেওয়া হয়। যার একমাত্র দফা হল অবৈধ স্বৈরাচারী হাসিনার পদত্যাগ। সারা দেশ থেকে দেশের কঠিন পরিস্থিতিতেও ছাত্রজনতা ছুটে আসে ঢাকায়। ৫ আগস্ট রাজপথে নেমে পড়ে লক্ষ কোটি ছাত্র-জনতা। ছাত্র জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। শহীদ সবুজ আগস্টের ৪ তারিখে অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে মোহাম্মদপুর ছাত্রদের রাস্তায় নামতে দেখে তিনিও রাজপথে নেমে আসে। বিকেল চারটার দিকে বিজিবি কর্তৃক একটি গুলি এসে সবুজের চোখে বিদ্ধ হয়। সাথে সাথে সবুজ দৌড়ে বাড়ির পাশে আসেন। এক পরিচিত সিএনজি চালক তাকে রিকশায় করে সিকদার মেডিকেলে নিয়ে যান। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়। ঢাকা মেডিকেলের এসডিও বিভাগে ভর্তি করা হয় তাকে। ঢাকা মেডিকেলে তিন ঘন্টা লাইভ সাপোর্টে থাকার পর হঠাৎ নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। এ অবস্থায় এক পর্যায়ে তার মৃত্যু ঘটে। জনাব কাউসার আহমেদের প্রিয় সন্তান সবুজ এভাবেই শাহাদাত বরণ করেন। তার পরিবারে নেমে আসে শোকের বন্যা। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয় ও বন্ধুর বক্তব্য/অনুভূতি ‘আমরা ৫ ভাই, সবুজ সবার ছোট ছিল। সবার আদরের ছিল। করো সাথে বেয়াদবি করত না সে অনেক ভালো ছিলো’-বড় ভাই মুনির হোসেন (৩৪) ‘আমার ৫ ছেলে, সে সবার ছোট। আমি তাকে ১৭ মাস আগে বিয়ে করাইছি। একটা গরু বিক্রি করে বিয়ে করাইছি। ছেলে কামাই রুজি কিছুই ছিলো না। কোস্ট সমিতি থেকে ৭০ হাজার টাকার কিস্তি ও জমি কট লইয়া ২,০০,০০০ টাকা দিয়ে সিএনজি কিনে নেয়। পুতে আর পুতের বউ মোহাম্মদপুরে ভালো করে থাকতো। আল্লাহর কি মহিমা আমার পুতে সব কিছু রেখে এই আন্দোলনে শরিক হইলে বিজিবির গুলিতে আমার পুত শহিদ হইলো। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করুন। দেশ সম্মানিত হইছে। আল্লাহ আমার এক পুত নিছে, বাংলাদেশের শত মায়ের বুক খালি হইছে আমার কোনো দুঃখ নাই’ -বাবা কাউসার আহমেদ (৬৫) ‘আমার ছোট ছেলে সবচেয়ে বেশি আদরের ছিলো। বড়গুলো অভাব দেখেছে, ছোট ছেলে কোন অভাব দেখে নাই। আমি ওরে সব হাজু দিয়ে বড় করেছি। আগে মারা যাওয়ার কথা বড় ছেলের। কিন্তু ছোট ছেলে আগে মারা গেছে। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করুন’ -মা বিবি হাজেরা (৫৫) শহীদ পরিবারের আর্থিক অবস্থা ও কিছু করনীয় শহীদের পিতা জনাব কাওসার আহমেদ একজন কৃষক। বয়সের ভারে সংসার চালানো তার পক্ষে সম্ভব হয় না। ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন মাত্র ১৭ মাস পূর্বে। সবুজের বাবা তাকে কর্ম করার জন্য কিনেও দিয়েছিলেন একটি সিএনজি। যা দিয়ে তার পরিবার কষ্ট হলেও ভালোভাবেই দিন পার হচ্ছিল। তিনি তার সিএনজি থেকে প্রাপ্ত আয় পরিবারের ভরণপোষণ এবং পিতা-মাতাকে মাসিক কিছু হাত খরচ দিতেন। শহীদের পিতা-মাতা যে টিনের ঘরে থাকেন সেখানে কোন ভাবে বাস করাটাও কঠিন। জীর্ণশীর্ণ বাড়িতে পরিবারের সবাই একত্রে বসবাস করে। শহীদের কোন সন্তান না থাকলেও রয়েছেন তার স্ত্রী। জনাব সবুজ শহীদ হওয়ার পরে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তার পরিবার, পিতা-মাতা ও স্ত্রী। ব্যক্তিগত প্রোফাইলপুরো নাম : শহীদ মো: সবুজ জন্মতারিখ : ১৫/০৭/২০০৩ পিতার নাম, বয়স, অবস্থা : কাউসার আহমেদ, ৬৫ বছর, কৃষক মায়ের নাম, পেশা : বিবি হাজেরা, ৫৫ বছর, গৃহিণী পারিবারিক সদস্য : ৮ জন ছেলে মেয়ে : নাই ভাই বোন সংখ্যা : ৬ ১. মোহাম্মদ হাফেজ মুন্সী, বয়স: ৪০, পেশা: সিএনজি ড্রাইভার ২. মো: মনির হোসেন মুন্সী, বয়স: ৩৪, পেশা: পাইভেট কার ড্রাইভার ৩. নূর হোসেন, বয়স : ৩০, পেশা: কাঁচামালের ব্যবসায়ী ৪. শহীদ মুহাম্মদ সবুজ ৫. সীমা, বয়স : ২৪, বিবাহিতা ৬. আমেনা, বয়স : ২২, বিবাহিতা স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: কচুয়াখালী, ইউনিয়ন: চর উমেদ, থানা: লালমোহন, জেলা: ভোলা বর্তমান ঠিকানা : মোহাম্মদপুর, ঢাকা ঘটনার স্থান : মোহাম্মদপুর বসিলা রোড ময়ুর ভিলা এলাকায় আঘাতকারী : বিজিবি আহত হওয়ার সময় কাল : ৪ আগস্ট ২০২৪, বিকাল ৪:০০ টা নিহত হওয়ার সময়কাল, স্থান : ৪ আগস্ট ২০২৪ রাত ১১:০০টা শহীদের কবরের অবস্থান : ভোলা জেলার নিজ গ্রামে।