Image of সাজিদুর রহমান ওমর

নাম: সাজিদুর রহমান ওমর

জন্ম তারিখ: ২ মার্চ, ২০০৩

শহীদ হওয়ার তারিখ: ২৪ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা_সিটি

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা: ম্যানেজার, শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ী

শহীদের জীবনী

দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করব” সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বিজয়নগরের তেতৈয়া গ্রাম। যার নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য দেখে যে কেউ মুগ্ধ হয়। সবুজের চাদরে মুড়ানো অপরুপ গ্রামটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অবস্থিত। শহীদ মো: সাজিদুর রহমান ওমর ২০০৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি প্রত্যন্ত এই গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর জনয়িতা জনাব শাহজাহান আলী পেশায় একজন পত্রিকা ব্যবসায়ী এবং মমতাময়ী মা পারভিন আক্তার গৃহকর্ত্রী। ছেলেবেলা থেকে পরিবারের অভাব-অনটন দেখে বড় হয় সাজিদ। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্য তিনি ছিলেন সবার ছোট। তখন থেকে পণ করেন বড় হলে পরিবারের আর্থিক সহায়ক হিসেবে মুখ্য ভুমিকা রাখবেন।একপর্যায়ে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য নিজের বসত ভিটা ছেড়ে রাজধানী শহরে আসেন শহীদের বাবা-মা। সাজিদকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ভর্তি করা হয় ডেমরা, জামেয়া আরাবিয়া আনোয়ারুর রহমানিয়া হাফেজি মাদরাসায়। অতঃপর কৃতিত্বের সাথে পবিত্র কোরআন মুখস্ত সম্পন্ন করেন তিনি। পরবর্তীতে মাদরাসা প্রাঙ্গণে হাজার-হাজার মানুষের উপস্থিতিতে শহীদ সাজিদুর রহমান ওমরকে পাগড়ী প্রদান করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। লেখাপড়ায় যিনি ছিলেন অদম্য তাঁকে থামানোর সাধ্য কার। যে কারনে আবারও নব উদ্যমে ডেমরা, সুন্না টেংরা দাখিল মাদরাসায় ভর্তি হন সাজিদ। লেখাপড়ায় ভাল থাকায় দ্রুত গুরুজনদের নজরে আসেন তিনি। একে একে দুই বোন মাহবুবা (২৭) ও মাহফুজা (২৫) আক্তারের বিয়ে সম্পন্ন হয়। দুটো মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠান করতে ঋণে জর্জারিত হয়ে পড়েন জনাব শাহজাহান ওরফে সাজিদের পিতা। পরিবারে আর্থিক সংকুলান করতে না পেরে দুই ছেলে সাজিদ ও সিরাজের একসঙ্গে লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাঁকে। যেন দুশ্চিন্তায় ফেটে পড়েন তিনি। -আব্বু তুমি টেনশন করো না, ভাইয়ার লেখাপড়ার টাকা আমি দেব।’’ কর্মজীবন সাজিদ তখন অষ্টম শ্রেণীর সামান্য একজন ছাত্র। পরিবারের অভাব আঁচ করতে পেরে অপার সম্ভাবনা দূরে ঠেলে সিন্ধান্ত নেন ফ্রিল্যান্সিং শিখবেন। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখার পর জানতে পারলেন এই মুহূর্তে কোর্স ফি দেয়া পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আগ্রহ এবং প্রচেষ্টা অবিচল থাকায় পুরনো বই কিনে পড়া শুরু করেন তিনি। বই পড়ে জানতে পারেন যে অনলাইন মিডিয়ায় ফ্রিল্যান্সিং কোর্সের ক্লাসসমূহ ফ্রি পাওয়া যায়। তবে ক্লাস করতে মেগাবাইটের প্রয়োজন হবে। সর্বপ্রথম বাবার মোবাইল নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ওয়াই-ফাই সংযোগ করেন। এরপর ইউটিউব দেখে নিজের প্রচেষ্টায় ফ্রিল্যান্সিং কোর্সের আদ্যপান্ত সম্পন্ন করে ফেলেন তিনি। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সাজিদের। ধীরে ধীরে আইটি বিষয়ে পারদর্শি হয়ে ওঠেন তিনি। ফাইবার, আপওয়ার্কে অ্যাকাউন্ট খুলে নিয়মিত বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানের সাথে মিটিং করে অর্ডার পেতে থাকেন। ধীরে ধীরে বাবার সকল ঋণ পরিশোধ করেন। বড় ভাইয়ের কলেজের অ্যাডমিশন ফি দিয়ে বাবাকে বলেন-আব্বু তুমি টেনশন করো না, ভাইয়ার লেখাপড়ার টাকা আমি দেব’’। জনাব শাহজাহান আলীর দুঃখ ঘুচতে থাকে। কিছুদিন পর পরিবারে আরও সুসংবাদ আসে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরির সুযোগ আসে সাজিদুর রহমান ওমরের। -সবার আগে আম্মু খাবে।’’ নতুন চাকরি ২০২১ সাল। সারাদেশে মহামারির কারণে এ সময় প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ হারিয়েছিল বহু মানুষ। উৎপাদন কমেছিল কৃষি ও শিল্প খাতে, সেবা খাতে বহু প্রতিষ্ঠান আয় হারিয়ে দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল। এই শোচনীয় পরিস্থিতিতে সাজিদুর রহমান ওমরের যোগ্যতা দেখে চাকরিতে যোগদান করতে অনুরোধ জানায় ‘নিঊ ড্রিম অনলাইন’ নামের একটি ব্রডব্যান্ড কোম্পানি। প্রথম মাসের বেতন হাতে পেয়ে মিষ্টি কিনে আনে সাজিদ। তাঁর বড় ভাই সিরাজ সবার আগে মিষ্টি খেতে প্যাকেট হাতে নেয়। কিন্তু সাজিদ জানায়- ভাইয়া, সবার আগে আম্মু খাবে। অতঃপর তাঁর উপার্জনে পরিবারের আর্থিক চাহিদা পূরণ হতে শুরু করে। মাত্র অল্প কয়েকদিনে ম্যানেজার পদে পদন্নতি লাভ করে শহীদ সাজিদুর রহমান ওমর। -নিয়মিত চলে তাঁদের যাতায়াত।’’ আন্দোলনে যোগদান ২০২৪ এর জুলাই-আগস্ট মাসে সারাদেশে গনহত্যা চালায় খুনি হাসিনা সরকার। ছাত্ররা বিভিন্ন চাকরীর বৈষম্য কোটা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। পরবর্তীতে তাঁরা দফায় দফায় কয়েকবার সোচ্চার সভা ও মানব বন্ধন করে। তৎকালিন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী একটানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে কোটা বৃদ্ধি করে। যার প্রেক্ষিতে অনলাইন মিডিয়ায় নেটিজনদের কাছে চরম নিন্দিত শেখ হাসিনার সরকার। এমতাবস্থায় দলমত নির্বিশেষে সাধারণ ছাত্ররা বিক্ষিপ্ত হয়ে সারাদেশে কোটা বিরোধী আন্দোলনের ডাক দেয়। সে আন্দোলন প্রতিহত করতে খুনি হাসিনা তাঁর দলীয় ক্যাডার ও পালিত ঘাতক পুলিশ বাহিনী দিয়ে সারাদেশে অসংখ্য ছাত্রদেরকে হত্যা, গুম, গ্রেফতার, মামলা করে নির্যাতন চালায়। আন্দোলন সমন্বয়কদেরকে ডিবি প্রধান হারুনের নেতৃত্বে একদল সাদা পোশাক পরিহিত সন্ত্রাসী বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। কয়েকশ ছাত্রকে গুম, হত্যা, নির্যাতন করার পরও আন্দোলন প্রতিহত করতে পারে না হাসিনা সরকার। ছাত্র জনতা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আন্দোলন ধীরেধীরে দীর্ঘায়িত হয়। সাজিদুর রহমান ওমর সে আন্দোলনে বন্ধুদেরকে নিয়ে শামিল হন। এভাবে কয়েকদিন নিয়মিত চলে তাঁদের যাতায়ত। “বন্ধু সামনে না যাওয়া ভাল।” যেভাবে তিনি শহীদ হন সেদিন ছিল ২১ জলাই, ২০২৪। যোহরের নামাজ শেষ করে যাত্রাবাড়ির সাইনবোর্ড এলাকায় আন্দোলনে শামিল হন সাজিদ। চারিদিকে পুলিশের গুলি উপেক্ষা করে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন তিনি। সাজিদের বাল্যবন্ধু হিমেল তাঁকে সামনে যেতে নিষেধ করে। কিন্তু সাজিদ বারবার বলতে থাকে “আমি শহীদ হয়ে যাব।“ দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করব। একথা বলতে বলতে ঘাতক পুলিশের একটি গুলি সাজিদের মাথায় এসে আঘাত হানে। মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। দ্রুত তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায় তাঁর বন্ধুরা। অবস্থার অবনতি ঘটলে তিন দিন আইসিইউতে ভর্তি থাকে সাজিদ। এবং সেখানেই গত ২৪ জুলাই, বুধবার দুপুর ১২:৪০-এ মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নেয় শহীদ সাজিদুর রহমান ওমর। “শহীদের স্বপ্নে যে বিভোর, তাঁর আবার কিসের দুঃখ।“ অতঃপর শহীদ সাজিদের লাশ তাঁর নিজ গ্রাম তেতৈয়া, বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছায়। চারিদিকে উৎসুক জনতা এই মহাবীরের লাশ দেখতে ভিড় জমায়। একনজর দেখতে দূরদূরান্ত থেকে লোক ছুটে আসে। জানাজায় যেন মানুষের ঢল নামে। গ্রাম জুড়ে চলে শোকের মাতম। সর্বশেষ পত্তন গ্রাম কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হয় শহীদ সাজিদুর রহমান ওমর। “আজ সবকিছু যেন থেমে গিয়েছে” পরিবারের আর্থিক দীনতা সাজিদের বাবার পৈত্রিক কোন আবাদি জমি নেই। তবে স্বল্প পরিমাণে বসতী জমি রয়েছে। যেখান থেকে কোন ভাড়া আসে না। তাঁর চাচারা বর্তমানে সেখানে বসবাস করেন। তাই এখনই ভাগাভাগি করা সম্ভব নয়। সাজিদের বিদায়ে পরিবারটির অর্থনৈতিক অবস্থা যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। সাজিদ মারা যাওয়ায় পরিবারে অবস্থা চরম শোচনীয় হয়ে পড়েছে। তাঁর বড় ভাই এখনো ছাত্র। তিনি বোরহান উদ্দিন কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষে অধ্যায়ন করছেন। তাঁর লেখাপড়ার খরচও সাজিদ চালাতেন। আজ সবকিছু যেন থেমে গিয়েছে। শহীদের মা বাত ও কোমর ব্যথায় জর্জারিত, বাবার হার্টে ব্লক। আর্থিক সংকটে তাঁরা চিকিৎসা করতে পারছেন না। কারণ- একমাত্র শহীদ সাজিদের উপার্জনে তাঁদের চিকিৎসা খরচ চলত। “দেখা হলে সবার আগে সালাম দিয়ে কথা বলত” প্রতিবেশীর অভিমত আলহাজ্ব সৈয়দ রোকনউদ্দীন জানায় আমি তাঁর প্রতিবেশী। শহীদ সাজিদুর রহমান ওমর অত্যন্ত ভাল ছেলে ছিল। দেখা হলে সবার আগে সালাম দিয়ে কথা বলত। কিছুদিন আগে আমি বাড়ি করেছি। আমার অবর্তমানে বাড়ির দেখাশোনা ও প্রয়োজনীয় মালামাল কিনতে সাহায্য করেছে সে।নিয়মিত তাঁকে ফজরের নামাজ মসজিদে গিয়ে আদায় করতে দেখেছি। তাঁর আখলাক ছিল চমৎকার। চলাফেরায় কখনও দুর্ব্যবহার করতে দেখিনি। মহান আল্লাহ তাঁর জন্য যেন জান্নাতের সর্বোত্তম স্থান ফয়সালা করেন। (আমিন) “সাজিদের মা প্রতিনিয়ত বাতাসে সন্তানের গন্ধ অনুভব করেন। যেন একটু পর কলিংবেল বাজবে, অপেক্ষা করেন। রোজ কল্পনা করেন তাঁর সাজিদ বাইরে থেকে আসবে, আর চিৎকার করে মা বলে ডাকবে। চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ে। এভাবেই কাটতে থাকে দিনের পর দিন।” ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : সাজিদুর রহমান ওমর পেশা : আইটি ম্যানেজার, কোম্পানি: নিউ ড্রিম অনলাইন (বেসরকারি) জন্ম তারিখ ও বয়স : ০২ মার্চ, ২০০৩, ২১ বছর আহত হওয়ার তারিখ : ২১ জুলাই, ২০২৪, বিকাল: ২.৩০ মিনিট শাহাদাতের তারিখ : ২৪ জুলাই ২০২৪, দুপুর ১২.৪০ স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দাফনের স্থান : পত্তন গ্রাম কবরস্থান, তেতৈয়া, বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: তেতৈয়া, বিজয়নগর, উপজেলা: বিজয়নগর থানা: বিজয় নগর, জেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া পিতা : মো: শাহজাহান (পত্রিকা ব্যবসায়ী) মাতা : মোসা: পারভীন আক্তার (গৃহিণী) বাড়ী ঘর ও সম্পদের অবস্থা : পৈত্রিক কোনো আবাদি জমি নেই, তবে স্বল্প পরিমাণে বসতী জমি রয়েছে ভাই-বোনের বিবরণ ১. সিরাজুল ইসলাম, বয়স: ২৩, পেশা: ছাত্র, প্রতিষ্ঠান: বোরহান উদ্দীন কলেজ, শ্রেণী: ৩য় বর্ষ, সম্পর্ক: ভাই ২. মোসা: মাহাবুবা আক্তার, বয়স: ২৭, (বিবাহিতা) সম্পর্ক: বোন ৩) মাহফুজা আক্তার, বয়স: ২৭, (বিবাহিতা) সম্পর্ক: বোন তথ্য সংগ্রহের তারিখ : ১৮-০৮-২০২৪

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of সাজিদুর রহমান ওমর
Image of সাজিদুর রহমান ওমর
Image of সাজিদুর রহমান ওমর
Image of সাজিদুর রহমান ওমর
Image of সাজিদুর রহমান ওমর

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: রমজান আলী

গঙ্গা চরন রাজবংশী

মো: আহমাদ আব্দুল্লাহ

হাফিজুল শিকদার

মো: লেবু শেখ

সাজিদ হাওলাদার

মো: সাব্বির হাওলাদার

মো: জাহিদ-এ-রহিম

মো: জাহাঙ্গীর

হাফেজ মোহাম্মদ জুবায়ের আহমাদ

মো: আরিফ

রমিজ উদ্দিন আহমেদ

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo