জন্ম তারিখ: ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা: ছাত্র , শাহাদাতের স্থান : শ্যামলী লিঙ্ক রোড
নাসিব হাসান রিয়ানসহ বাংলাদেশের সকল শহীদরা দেশপ্রেম, দান ও গৌরবের এক অক্ষয় উৎস এবং অগ্রগতি, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনের জ্বালানী এবং তাদের সুগন্ধিময় জীবন আমাদের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, আমাদের সাহস যোগাবে এবং আমাদের ঠেলে দেবে স্বপ্নপূরণের দিকে। মহামান্য শহীদদের পরিবার, পিতা ও মাতা যারা তাদের সন্তানদের মধ্যে দেশপ্রেম ও আনুগত্যের অর্থ জাগিয়েছেন এবং যারা সাহসের সাথে তাদের বিচ্ছেদের সাথে ধৈর্য ধরেছিলেন, ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে তাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা। প্রাথমিক পরিচিত নাসিব হাসান রিয়ান ঢাকার স্থানীয় এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ঢাকার শেরে বাংলা নগরের বিসমিল্লাহ ইউনিয়নের কৃষি মন্ত্রণালয়ের চাকরিজীবী গোলাম রাজ্জাক ও গৃহিণী সামী আক্তার দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন নাসিব হাসান রিয়ান। ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জন্ম নিয়ে আবার ২০২৪ সালে ৫ আগস্ট নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মৃত্যুবরণ করেন। মাঝখানে দীর্ঘ ১৭ বছর স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায় অবিশ্বাস আর দুর্নীতির দুর্গন্ধযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশে সময় কাটিয়ে গেলেন। স্বপ্ন ছিল দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বড় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে দেশের সুনাম অর্জন করবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা উন্নত করবেন। এজন্য খুব মনোযোগ সহকারে তিনি লেখাপড়া করতেন। রাজধানীর স্বনামধন্য 'কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) কলেজের একাদশ শ্রেণির মেধাবী ছাত্র ছিলেন শহীদ রিয়ান। এর আগে ধানমন্ডি বয়েজ স্কুল থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসিতে পাস করেন। তিন ভাইয়ের মধ্য রিয়ান ছিল সকলের মধ্যে মনি। তিনি তার সুন্দর ব্যবহার দিয়ে সকলের মন জয় করেছিলেন। সুন্দর পবিত্র আত্মা বেশি দিন এই পৃথিবীতে থাকতে পারলো না। কারণ সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগের কোটায় চাকরি পাওয়া পেটোয়া পুলিশ বাহিনী রিয়ানকে সহ্য করতে পারল না। স্বাধীনতার স্বাদ রিয়ান যেন গ্রহণ করতে না পারে এইজন্য তাকে তিনটি বুলেটের আঘাতে দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়। শাহাদাতের ঘটনা আজ সোমবার। বাঙালি জাতির স্মরণীয় একটি দিন। টানা ১৫ বছর পর পরাজয় হলো ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। কোটা আন্দোলনের জেরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী ও দুর্নীতিতে ভয়াবহ ইতিহাস সৃষ্টিকারী আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। এ আনন্দে সারাদেশের মিষ্টির দোকান গুলো ফাঁকা হয়ে গেল। রাস্তায় নামতে শুরু করলো মানুষ বিজয় উল্লাস উদযাপনের জন্য। নাসিব হোসেন রিয়ান ঘরে বসে থাকতে পারলেন না। যেহেতু কিছুদিন আগে তার বন্ধু স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যেয়ে শহীদ হয়েছে, সেহেতু স্বৈরাচারের পতন তার জন্য বড় একটি আনন্দের বিষয়। রিয়ান বাবা-মায়ের নিষেধ সত্বেও ছাত্র-জনতার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিত। ১৮ জুলাই তার বন্ধু ফারহান ফাইয়াজ আন্দোলনে নিহত হলে সে জানায়, ন্যায্য দাবী চাইতে গিয়ে আমার ভাইয়েরা মরে যাচ্ছে, আমি কিছুতেই ঘরে বসে থাকতে পারিনা। ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতনের খবর পেয়ে ছাত্র-জনতার সাথে নাসিব হাসান রিয়ান বিজয় মিছিল সহকারে শ্যমলীর খিলজি রোড হয়ে রিং রোডে ঢুকছিল। এসময় সেখানে স্বৈরাচারী সরকারের একদল ঘাতক পুলিশকে দেখে নাসিব হাসান বুঝতে পারে এরা তো এখনো আত্মসমর্পণ করেনি। এই পুলিশগুলো তো প্রকৃতপক্ষে পুলিশ না এরা পুলিশ নামে সরকারি সন্ত্রাসী। অবাক হয় এখনো কেন এরা ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে! নাসিব হাসান রিয়ান সবসময়ই শহীদ আবু সাঈদের কথা স্মরণ করত, যে কিভাবে এতো সাহসিকতার সাথে পুলিশের সামনে আবু সাঈদ ভাই বুক পেতে দিলেন। নাসিব হাসান রিয়ান জীবনের সমস্ত ভয়ভীতি দূর করে বাতিলের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে, তার দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশকে বলেছিল, গুলি করবি? কর! আমি বাতিলকে ভয় করিনা। আমি তোমাদের বুলেটকে কেন ভয় করব ? আমি তো ভয় করি একমাত্র আল্লাহকে। তোমরা গুলি কর! দেখি তোমাদের বন্দুকের মধ্যে কতগুলি আছে। ঘাতক পুলিশও বুঝি এরই অপেক্ষায় ছিল। রিয়ানের কথা শোনামাত্রই তারা ৩টি গুলি করে। প্রথম বুলেট বুকে লেগে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। দ্বিতীয় বুলেট কানের নিচে দিয়ে ঢুকে গলা দিয়ে বেরিয়ে যায়। তৃতীয় বুলেট বুকে-কাধে লেগে মাংস ছিড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে। সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা দেন। এভাবেই দেশের দুশমন, পুলিশ নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী মেতে উঠে এক হিংস্র খুনের নেশায়। মানুষ যে হিংস্র পশুর থেকেও ভয়ংকর হতে পারে তা প্রমাণ করলো এই পুলিশ বাহিনী। আচ্ছা ওদের কি বিবেক নেই? সত্য মিথ্যা পার্থক্য করার কোন জ্ঞান কি সৃষ্টিকর্তা তাদের দেয়নি? তাদের ঘরেও তো রিয়ানের মত সন্তান আছে। বিন্দু পরিমান দয়াময় থাকলেও তো গুলি চালানো সম্ভব না। তাহলে ওরা কারা? ওদের পরিচয় কি? মানুষ নাকি অন্য কিছু? ১৯৮৯ সালের তিয়ানানমেন স্কোয়ার বিক্ষোভ ও গণহত্যাকেও হার মানায়। বাংলাদেশের এই শিক্ষার্থী গণহত্যা। আমেরিকার ইসরাইলের মতো নিষ্ঠুর আর কারো তো এ ধরনের গণহত্যা কখনো চালায় নি। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা এটাতেই প্রমাণ করলো যে সে ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত শিক্ষার্থী গণহত্যাকারী। বড় ভাইয়ের অনুভূতি রিয়ান নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী, একই সাথে সাহসী এবং স্নেহশীল ছিল । তার কথায় গুরুতর এবং ভারসাম্যপূর্ণ প্রকাশ পেতো তার যা বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করে। সেই প্রফুল্ল মুখ কেউ ভুলতে পারবেনা যা তাকে পরিচিত এবং সকলের মধ্যে প্রিয় করে তুলেছে। সে তার ভাইদের সাথে তার বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলো। তাকে কোন কাজ দিলে সেই কাজের জন্য বরাদ্দকৃত সময়ের সঠিকভাবে ব্যবহার করার প্রতি সে আগ্রহী ছিলো এবং কাজের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতো । রিয়ানের শখ ছিল সে ভালো একজন ক্রিকেটার হবে এদেশে কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সকল মানুষের দুঃখ কষ্ট দূর করতে হবে। তার এক বন্ধুর অনুভূতি আমাদের মাঝে নাসিব হাসান রিয়ান ছিল সবার প্রিয়। তার অমায়িক ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করত। লেখাপড়াতে সে খুব ভালো ছিল। ক্রিকেট খেলা তার খুব প্রিয় ছিল। আমাদের ক্লাসের অনেকেই তার মত হতে চাই। রিয়ান সম্পর্কে তার পিতার বক্তব্য বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই সে নিজেকে ইসলামের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে এবং সে সর্বদা ঠাণ্ডা, ঝড়-বৃষ্টি সত্ত্বেও নামাজের শুরুতে মসজিদে যেতো এবং নামাজের পর পড়তে বসতো। সে তার আচরণে সৎ ছিলো, তার সর্বদা অশ্রুসিক্ত চোখ তার ভাল সততাকে নির্দেশ করে এবং তার সম্পূর্ণ লক্ষ্য ছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য। সে সর্বদা পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করতো। তিনি তার পিতাকে সম্মান করতেন এবং মায়ের প্রতিও ভীষণভাবে মমতাময়ী ছিলেন। ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। শহীদ রিয়ান তার উচ্চ আধ্যাত্মিকতার জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি নিয়মিত মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতেন। তার রুকু ও সিজদা দীর্ঘায়িত করতেন। শুক্রবারে অজু করে এবং নিয়মিতভাবে অজু করে তিনি একজন ইবাদতগুজারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে তারা মধ্যরাতে নামজে উঠতেন। গোপনে সদকা করতেন। নিয়মিত তার বন্ধু ফারহানকে সাথে যিনি ১৮ জুলাই শহীদ হন) নিয়ে নিয়মিত গরীব দুঃখী মানুষকে খাবার বিতরণ করতেন। শহীদ রিয়ান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে খুব ভালোবাসতেন। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ নাসিব হাসান রিয়ানের বাবা কৃষি মন্ত্রনালয়ে চাকুরী করেন। তার মাসিক আয় ৩২ হাজার টাকা। তিনি রাজধানী শ্যমলীতে নিজস্ব ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। নাসিবের বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ছোট ভাই ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করে। নাসিব হাসানের বাবার ৫ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ঋণ আছে। একনজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলি শহীদের পূর্ণ নাম : নাসিব হাসান রিয়ান জন্ম তারিখ : ১৩-০৯-২০০৭ জন্মস্থান : ঢাকা পেশা/পদবী : ছাত্র বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) কলেজ, একাদশ শ্রেণি পিতার নাম : গোলাম রাজ্জাক, চাকুরীজিবী, কৃষিমন্ত্রণালয়/৫২ মায়ের নাম : সামী আক্তার, গৃহিনী, ৪৫ স্থায়ী ঠিকানা : ফ্ল্যাট বাসা/মহল্লা : ট-এ/১, ২৭/৩, রোড-৩ ইউনিয়ন : বিসমিল্লাহ টাওয়ার থানা : শেরেবাংলা নগর জেলা : ঢাকা বর্তমান ঠিকানা : ফ্ল্যাট-এ/১, ২৭/৩, রোড: ৩, বিসমিল্লাহ টাওয়ার শেরেবাংলা নগর, ঢাকা বৈবাহিক অবস্থা : অবিবাহিত লেখাপড়া : বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) কলেজ, একাদশ শ্রেণি পিতার নাম : গোলাম রাজ্জাক, চাকুরীজীবী, কৃষিমন্ত্রণালয়/৫২ মায়ের নাম : সামী আক্তার, গৃহিনী, ৪৫ ১. বড় ভাই : নিহাশ হাসান রাফিন (২০), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনার্স প্রথম বর্ষ ২. ছোট ভাই : নাবিল হাসান রাফসান (১২) ৬ষ্ঠ শ্রেণি, ধানমন্ডি আহত হওয়ার স্থান ও তারিখ : শ্যামলী লিঙ্ক রোড মৃত্যুর তারিখ ও সময় : ৫ আগস্ট ২০২৪, বিকেল ৫ টায় আক্রমণকারী : স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ বাহিনী জানাজা : শ্যামলী জামে মসজিদে গোসল শেষে ১ম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় কেরানিগঞ্জে ২য় জানাজা শেষে নানার পাশে তাকে দাফন করা হয় দাফন : কেরানিগঞ্জ কবরস্থান, ঢাকা