জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা : ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : পল্টন
হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এক অকুতোভয় বীর সৈনিক মেধাবী ছাত্র ও হাফেজী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী শহীদ মো: সোহাগ। তিনি ১ জানুয়ারি ২০০৫ সালে ভোলা জেলার অন্তর্গত হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের চরফকিরা গ্রামে এক দিনমজুরের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে স্বপ্ন বুনতে থাকেন। স্বৈরাচার খুনি হাসিনার পেটুয়া বাহিনী কতৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে হঠাৎ অকালে মারা যাওয়ার দরুন কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। যার ফলে পুরো পরিবারে হতাশা নেমে আসে। তাঁর পিতা সালাউদ্দিন পেশায় একজন দিনমজুর এবং মাতা শাহনাজ গৃহিণী। সোহাগের ছোট এক ভাই ও এক বোন আছে। ব্যক্তিগত জীবন রিয়াজ একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষার্থী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনে আগ্রহী রিয়াজ হাফেজী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছিলেন। মাদ্রাসার বন্ধুদের মধ্যে তাঁর প্রতিভা এবং আদর্শবান জীবনের কারণে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। শিক্ষাজীবনে তার লক্ষ্য ছিলো ইসলামী শিক্ষার আলোকে সমাজের উন্নয়ন এবং ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করা। পারিবারিক অবস্থা মো: সোহাগের গ্রামে বাড়ি ভিটা আছে কিন্তু কোন ঘর বাড়ি নাই। তাঁর পরিবার ঢাকায় থাকেন ১৪ বছর ধরে। শহীদের পিতা দিন মজুরের কাজ করেন। তাঁর বড় ভাই রাব্বী ৮ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করেন। নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে শহীদ সোহাগের পরিবার কায়ক্লেশে দিন গুজরান করছে। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ছাত্ররাই অজেয়-এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। এ সফলতা যতটা না স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকার পরিবর্তন করে দেখিয়েছে তার চেয়ে বেশি পুরো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার বৈকল্যকে চলাকালীন তুলে ধরেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দেশে ছাত্র বিক্ষোভে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। যার সর্বশেষ উদাহরণ সৃষ্টি হয় বাংলাদেশে। ১ জুলাই ২০২৪ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা। দীর্ঘ ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, ভোটচুরি, দুর্নীতি, খুন, অন্যায়, অত্যাচার জনমনে ফেলেছিল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কোটা প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে ঘাতক আওয়ামী সরকার। ২০১৮ সালে ছাত্রছাত্রীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সকল দাবী মেনে নিলেও তার অন্তরে ছিল হিংসার অগ্নিগিরি। তাই ২০২৪ সালে একটি বিরোধী দলহীন নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর আবার কোটা ফিরিয়ে আনতে চাইল হাসিনা সরকার। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত ১ জুলাই থেকে। আন্দলোনে নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ওপর সশস্ত্র ঘাতক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও পুলিশ, র্যাব সদস্যরা হামলা চালাতে থাকে। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতের পর থেকেই আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; হয়ে উঠে দেশের আপামর জনতার এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ অভ্যুত্থানে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। ক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পদত্যাগের পূর্বে তিনি রেখে যান তার ঘৃণ্য ও বিকৃত মস্তিষ্কের অজস্র কুকীর্তি। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী সহ অনেক নিরীহ জনতার উপর লেলিয়ে দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী। তাদের গুলিতে শহীদ হয় নিরস্ত্র নিপীড়িত জনতা। আন্দোলনে যোগদান ‘সত্যের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ' এর মধ্যেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিহীত। এ শ্রেষ্ঠত্ব যুগে যুগে বলিষ্ঠ কণ্ঠে আওয়াজ তুলে নেতৃত্ব দেয় তরুণ ছাত্র-জনতা। একজন সচেতন ছাত্র দেশ ও জাতির সক্রিয় কার্যকর প্রতিবাদী জনশক্তি। এ তরুণ ছাত্র সমাজ যখন কোনো যৌক্তিক বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে তখনই তাদের যৌক্তিক দাবিগুলোর প্রাসঙ্গিকতা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনুভব করে ঝাঁপিয়ে পড়ে অকুতোভয় শহীদ মো: সোহাগ। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজ অবস্থান নিশ্চিত করেন। পরিবারের অভাব অনটন মাথায় রেখে স্বপ্নবাজ ও তরুণ প্রজন্মের আদর্শ শহীদ সোহাগের তাজা প্রাণ এত নির্মমভাবে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে বিদায় নেবে তা ছিল কল্পনাতীত। শাহাদাত বরণ স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট খুনি হাসিনার ক্ষমতার মসনদ ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে মুক্তিকামী ছাত্র জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে; নেমে আসে রাজপথে। জনমনে দীর্ঘদিনের ছাই চাপা আগুন স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। রাজপথ উত্তাল হয় ছাত্র জনতার বজ্রকণ্ঠের হুংকারে। শোষক গোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া সশস্ত্র ঘাতক বাহিনীর মুখোমুখি অবস্থানে নিরীহ, নিরস্ত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার ‘এক দফা এক দাবি খুনি হাসিনা তুই কবে যাবি’। ১৯ জুলাই ২০২৪। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতা আন্দোলন পল্টন এলাকায় অবস্থান নেয়। এ আন্দোলনের স্মমুখভাগে নেতৃত্ব দিতে থাকে বীর যোদ্ধা মেধাবী ছাত্র সোহাগ। আন্দোলনের এক পর্যায়ে মুক্তিকামী ছাত্র জনতার উপর চড়াও হয় জুলুমবাজ সরকারের লেলিয়ে দেয়া ঘাতক পুলিশ বাহিনী; শুরু করে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ। এমতাবস্থায় গোটা এলাকা মুহুর্তেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আন্দোলন চলাকালীন আনুমানিক দুপুর ১২:০০ টায় ঘাতক পুলিশের ছোঁড়া গুলি রিয়াজের মাথায় লাগে। তেজোদ্বীপ্ত সোহাগ সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। প্রতিকূল যুদ্ধের ময়দান থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় সোহাগের সাথের আন্দোলনকারী বন্ধুরা দ্রুত তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন দেখা দেয় রক্তের। এক ব্যাগ রক্ত এবং দুই ব্যাগ স্যালাইন দেওয়ার পরেও শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকরা তাঁকে বাঁচাতে পারেননি। দুপুর ২:৩০ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে হাসপাতালের বিছানায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জানাযা ও দাফন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমে শহীদ সোহাগ নিজের বলিষ্ঠ আদর্শকেই প্রতিফলিত করেছিলেন। তবে অভিযোগ আছে যে, সোহাগের মরদেহ দুই দিন পর্যন্ত পরিবারের হাতে পৌঁছায়নি। অবশেষে, তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পাওয়া যায় এবং নিজ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নামাজে জানাযা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তাঁর জানাজায় অংশগ্রহণকারীরা শহীদের জন্য চোখের পানি ফেলেছে এবং এলাকার মানুষ এই হত্যার জন্য কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতা আন্দোলনে বিপ্লবী শহীদ সোহাগের মতো যুবকদের সাহসিকতা সমাজের জন্য নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণার। শোকাচ্ছন্ন নিকটজন সোহাগের মৃত্যুতে তার পরিবার এবং সহপাঠীরা শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে তার পরিবার, যারা ১৪ বছর ধরে ঢাকায় বসবাস করছে, এই শোক সহ্য করতে পারছে না। শহীদের পিতা একজন দিনমজুর, আর বড় ভাই রাব্বী মাত্র ৮ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলার হাজারীগঞ্জের শশীভূষণ এলাকায়, যেখানে একটি ভিটা রয়েছে, কিন্তু সেখানে কোনো স্থায়ী ঘরবাড়ি নেই। দারিদ্রের সাথে লড়াই করেও রিয়াজ তার পরিবারকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিলো, কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূর্ণতা পেল না। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের অনুভূতি শহীদ সোহাগের মামী ফাতেমা তাঁর সম্পর্কে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, সোহাগ একজন ভালো ছাত্র ছিল। সে মাদ্রাসায় হাফেজি পড়েছিল। অভাব অনটনের কারণে সে ঢাকায় গিয়ে ছোট খাটো চাকরি নিয়েছে। এক নজরে শহীদ হাসনাইন নাম : মো: সোহাগ জন্ম তারিখ : ০১-০১-২০০৫ জন্মস্থান : ভোলা পেশা : ছাত্র স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: চরফকিরা ৫নং ওয়ার্ড, ইউনিয়ন: হাজারীগঞ্জ, থানা: শশীভূষণ, জেলা: ভোলা বর্তমান ঠিকানা : বাসা/মহল্লা: বাঁশতলা, গুলশান-২ ঢাকা পিতা : সালাউদ্দিন, পেশা ও বয়স দিনমজুর, ৪৬ মাতা : শাহানাজ, পেশা ও বয়স: গৃহিণী, ৪১ ঘটনার স্থান : পল্টন আক্রমণকারী : ঘাতক পুলিশ আহত হওয়ার সময়কাল : ১৯ জুলাই ২০২৪, দুপুর ১২ টায় মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : ১৯ জুলাই ২০২৪, দুপুর ২.৩০ টায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ কবরের অবস্থান : ভোলা জেলার অন্তর্গত হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের চরফকিরায় নিজ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থান ভাই : রাব্বি, বয়স ১৫, দোকানে চাকরি বোন : সোহানা, বয়স: ৭, ছাত্রী সম্ভাব্য প্রস্তাবনা : দরিদ্র পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা : শহীদের দিনমজুর বাবাকে স্থায়ীভাবে ব্যবসা ধরিয়ে দেয়া : নিম্ন বেতনে চাকুরিজীবী বড় ভাইয়ের উন্নত চাকুরি দেয়া : ছোট ভাই বোনের পড়ালেখার যাবতীয় খরচ বহন করা