Image of মাসুদুর রহমান জনি

নাম: মাসুদুর রহমান জনি

জন্ম তারিখ: ২২ এপ্রিল, ১৯৮৪

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা_সিটি

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : ব্যবসা (পুরাতন গাড়ি ক্রয় বিক্রয়) শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ী

শহীদের জীবনী

“মা, আমি বাইরে যাচ্ছি। আমার ছেলেকে তুমি খেয়াল রেখ” ১৯৮৪ সালের ২২ এপ্রিল ঢাকা জেলার বংশাল এলাকায় জেবোল হোসেনের ঘর আলোকিত করে প্রথম জগত সংসারে পা রাখেন শহীদ মাসুদুর রহমান জনি। গ্রীষ্মের দাবদাহ, গরমে মাঠঘাট তখন ফেটে চৌচির। ঠিক তার বিপরীতে মায়ের কোলে ওম জড়িয়ে ঘরে আসে ছেলেটি। একমাত্র সবেধন নীলমনি সন্তানকে কাছে পেয়ে আনন্দ অশ্রু ঝরে মোমেনা বেগমের। সেদিনের ছোট্ট জনি বড় হয়ে দেশ প্রেমিক বীর যোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ পায়। তিনি ছিলেন মোমেনা খাতুন ও জেবোল হোসেনের পালক পুত্র। মোমেনা খাতুনের কোনো সন্তান না হলে তাঁর শাশুড়ি নাতী হিসেবে জনিকে দত্তক নেয়। নিজের আপন মা’কে খালা এবং খালাকে মায়ের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিল জনি। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বিষয়টি তিনি জানতে পারেন। আঁধার দিল দেখা দীর্ঘদিন পর সন্তানহারা মায়ের কাকুতি মিনতি কবুল করেন মহান রব। জনিকে দত্তক হিসেবে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েন মোমেনা বেগম ও জোবেল হোসেনের পরিবার। নাতিকে কাছে পেয়ে আদর সোহাগে মাতিয়ে রাখেন তার দাদী। কিন্তু সে আদর হঠাৎ অনাদরে রূপ নেয়। গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় জনি এবং ওর মমতাময়ী মায়ের জীবন। হঠাৎ জেবোল হোসেনের মৃত্যু হয়। পরিবারকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর মোমেনা খাতুনের উপর নেমে আসে চরম নির্যাতন ও মানসিক যন্ত্রণা। একপর্যায়ে শশুর বাড়ী থেকে বিতাড়িত হয়ে বোনের বাড়িতে চলে আসতে হয় মোমেনাকে। আঁধার হল দূর বাবার অবর্তমানে আত্মীয়স্বজনরা জনির পাশে এসে দাঁড়ায়। ধীরেধীরে বড় হতে থাকে জনি। একটু বড় হলে নিকটাত্মীয় ও কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। সকলে মিলে পুরাতন প্রাইভেট কার (মাইক্রো) ক্রয় করে সার্ভিস পয়েন্টে মেরামত করেন। এরপর বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করে উপার্জন শুরু করেন তিনি। কিছুদিন পর খালার বাসা থেকে মা’কে নিয়ে আসেন জনি। আলাদা বাসা ভাড়া নিলে আবারও নতুন জীবন শুরু হয় মোমেনা খাতুনের। -শেষ জীবনে আমি তোমার কাছে থাকতে চাই।’ জীবন যখন রঙ্গিন নিজের একাকীত্ব জীবনের অবসান ঘটাতে মনস্থির করেন জনি। কিছুদিন পর তিনি বিয়ে করেন। নতুন সংসার গুছিয়ে নিতে কোনো ত্রুটি ছিল না তার। অতঃপর সংসার আলোকিত করে জন্ম নেয় তার একমাত্র পুত্র আহমাদ ইসলাম মাহী (৫)। পরিবার জুড়ে চলে উৎসব আমেজ। মোমেনা খাতুন তার পুত্রবধূকে বলেন,“শেষ জীবনে আমি তোমার কাছে থাকতে চাই।” স্বপ্ন যখন ফিকে হয়ে যায় সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ একদিন স্ত্রীর সাথে বাকবিতণ্ডা হয় জনির। যা পরবর্তীতে বিচ্ছেদে রূপ নেয়। একপর্যায়ে তার স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে করে। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদে জনির একমাত্র ছেলে মাহির জীবন হঠাৎ থমকে যায়। দাদীর কাছে বড় হতে থাকে সে। বর্তমানে মাহি স্থানীয় একটি মাদ্রাসার হেফজ বিভাগে লেখাপড়া করছে। দেশে এলো আন্দোলন ২০২৪ সালের ১ জুলাই। সারা বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনের ডাক দেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশি হামলার শিকার হয়। আন্দোলন দীর্ঘ হলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের “রাজাকারের নাতি-পুতি” হিসেবে অভিহিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর বিরূপ মন্তব্যে শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে, “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার” এবং “চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার” স্লোগান দেয়। ধীরে ধীরে আন্দোলন অসহযোগে রূপ নেয়। চারিদিকে হাসিনার পেটুয়া বাহিনী ও লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনী ব্যাপক সহিংসতা চালায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সের অগণিত মানুষ প্রাণ হারায়। পালিয়ে গেল হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ কারফিউ ঘোষণা করে তৎকালীন খুনি শাসক শেখ হাসিনা। সেই কারফিউ ভেঙে রাজধানীর অলিগলিতে অবস্থান নেয় ছাত্র-জনতা। তাদেরকে মূল সড়কে উঠতে বাধা দেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। চালানো হয় নির্বিচারে গুলি। ওইদিনও প্রাণ হারান বহু মানুষ। এরপর বেলা দুইটার সময় গণমাধ্যমে খবর আসে, পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। ঢাকার রাজপথসহ সারাদেশে লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতা একে অপরকে ধরে বিজয় উল্লাস করতে থাকেন। নানা স্লোগানে প্রকম্পিত হয় রাজপথ। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের দিকে যাত্রা এবং গণভবনের পাশাপাশি জাতীয় সংসদ ভবনেও অবস্থান নেয় ছাত্র-জনতা। -জনি ভাই রক্তের উপরে শুয়ে আছে শাহাদতের প্রেক্ষাপট সেদিন যেন হিংস্র হায়েনায় রূপ নেয় হাসিনার পালিত পুলিশ বাহিনী। একদিকে চলে বিজয় মিছিল অন্যদিকে রক্তের স্রোতে ভেসে যায় যাত্রাবাড়ী ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তর। সে মিছিলে যোগদান করতে বাসা থেকে বের হয় জনি। যাওয়ার সময় মা’কে বলে যায়- ‘মা, আমি বাইরে যাচ্ছি। আমার ছেলেকে তুমি খেয়াল রেখ’। কে জানত এই খেয়াল রাখার অর্থ সারাজীবনের দায়িত্ব গ্রহণ। অতঃপর যাত্রাবাড়ী থানা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয় জনি। স্লোগানে ফেটে পড়ে ছাত্র জনতা। তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পুলিশ। হটাৎ কয়েকটি গুলি জনীর শরীরে এসে বিদ্ধ হয়। মাটিতে লুটিয়ে ছটফট করতে থাকেন তিনি। আশেপাশের ছাত্ররা তাকে দ্রুত মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক জানায় তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। খবর পেয়ে জনির খালাত ভাই দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছায়। মোমেনা খাতুনকে ফোন করে জানায়, “খালা জনি ভাই রক্তের উপরে শুয়ে আছে। আমার ভাই আমাদেরকে ছেড়ে শহীদ হয়ে গিয়েছে।” কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে পরিবারের। একমাত্র নাতিকে ধরে কাঁদতে থাকে জনির মা। লাশ বাড়ীতে এসে পৌছায়। শেষবারের মত সন্তানকে পাগলের মত ছুঁয়ে দেখেন মোমেনা খাতুন। বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। পরবর্তীতে জানাজা শেষে শহীদের লাশ আজিমপুর কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। বারবার তার বায়নাগুলো আমার কানে ভেসে আসছে। বড় বোনের ক্রন্দন অনুভুতি জনি আমার আদরের ছোট ভাই ছিল। আমি বেতন পেয়েছি জানতে পারলে সারাদিন আমার পিছনে ঘুরঘুর করত। আর বলত- আপু কখন খাওয়াবি? বাইরের খাবার জনির খুব পছন্দ ছিল। জনির চলে যাওয়ার দুদিন পর আমি বেতন পেয়েছি। বারবার তার বায়নাগুলো আমার কানে ভেসে আসছে। আমার আদরের ছোট ভাইকে যারা হত্যা করেছে, তাদের যেন ফাঁসি হয়। তাদের যেন সঠিক বিচার হয়। - সাকিলা সোবাহান (খালাত বোন) বৃদ্ধা মায়ের বিষাদময় জীবন শহীদ মাসুদুর রহমান জনির মৃত্যুতে একমাত্র নাতীকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন মোমেনা খাতুন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস, হার্টের রোগে ভুগছেন। প্রতি মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকার ঔষধ প্রয়োজন হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর শশুর বাড়ী থেকে বিতাড়িত হয়েছেন তিনি। তাই একমাত্র সন্তানই ছিল তার পথ চলার অবলম্বন। অনেক শখ করে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন শেষ বয়সে পুত্রবধূ ও ছেলেকে নিয়ে বেশ স্বাছন্দে কাটবে তার জীবন। সকল স্বপ্ন ফিকে হয়েছে মোমেনা খাতুনের। বর্তমানে এক নাতীকে নিয়ে কীভাবে বাকি জীবন পার করবেন তার উত্তর হয়ত কেউ জানে না।‘‘স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ইন্ধনে সকল স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়েছে শহীদ জননীর। পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু আহমাদ ইসলাম মাহী বারবার লাঠি হাতে নেয়- যে লাঠি দিয়ে শেখ হাসিনাকে মারতে চায় সে। বারবার বলে-আমার আব্বাজানকে যে কবরে পাঠিয়েছে, আমি তাঁকে লাঠি দিয়ে মারব। ঘাতকের একটি বুলেট মুহূর্তে তছনছ করে দিল মোমেনা খাতুনের স্বপ্ন । বন্ধ করে দিল মাহির অনাগত জীবনের পথচলা। বিয়োগান্ত এই শোঁক কিভাবে ভুলবে নিঃস্ব এই পরিবারটি।’’ এক নজরে শহীদ মাসুদুর রহমান জনি নাম : মো: মাসুদুর রহমান জনি পেশা : ব্যবসায়ী জন্ম তারিখ ও বয়স : ২২ এপ্রিল ১৯৮৪ ও (৪০) শহীদ হওয়ার তারিখ : ৫ আগস্ট ২০২৪ বিকাল ০২:০০ শাহাদাত বরণের স্থান : যাত্রাবাড়ী দাফন করা হয় : আজিমপুর কবরস্থান স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: ছিপাতলি, উপজেলা: হাটহাজারী, জেলা: চট্টগ্রাম পিতা : জেবোল হোসেন (মৃত) মাতা : মোসা: মোমেনা খাতুন (গৃহিণী) ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : স্থায়ী কোনো জায়গা-জমি, বাসস্থান নেই ভাইবোনের বিবরণ : নেই একমাত্র সন্তান : আহমাদ ইসলাম মাহি, বয়স: ৫ বছর

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মাসুদুর রহমান জনি
Image of মাসুদুর রহমান জনি
Image of মাসুদুর রহমান জনি
Image of মাসুদুর রহমান জনি
Image of মাসুদুর রহমান জনি

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: মেহেদী হাসান

মো: সোহেল রানা

গঙ্গা চরন রাজবংশী

মো: জাহিদ হোসান

মো: সাফাকাত সামির

মো: জাহাঙ্গীর

মো: রবিউল ইসলাম

মো: রেজাউল করিম

দীন ইসলাম বেপারী

মোঃ ইয়াকুব

মো: আহমাদ আব্দুল্লাহ

মো: মাহাদী হাসান প্রান্ত

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo