জন্ম তারিখ: ২ মে, ২০০২
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা : ব্যবসা (চা দোকানদার) শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার সংলগ্ন, ঢাকা
"আমারে একটু তাঁর কাছে নিয়া চল, আমি জানতে চাই, আমার পোলারে কেন গুলি করছে, কেন আমার পোলারে হত্যা করা হল? আমারে কেউ জবাব দে? আমার হাফেজ পোলা। দুপুরেও আমার ঘরে ভাত খায়ছে। আমার পোলার জীবন ফেরত দে। ঐ হাসিনা আমার পোলারে মারছে, আমার বুক খালি করে দিছে, একদিন হের বুকও খালি হইব।” - শহীদ জননী হাফেজ দীন ইসলাম বেপারী। ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় ২০০২ সালের মে মাসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাল্যকাল থেকে অত্যন্ত ভদ্র, মিশুক এবং মেধাবী ছিলেন। সন্তানের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে জনাব শাহ আলম সন্তানকে জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। মেধাবী হওয়ায় দ্রুত মাদ্রাসা শিক্ষায় সফলতা অর্জন করেন তিনি। কৃতিত্বের সাথে পবিত্র কুরআনুল কারীম সম্পূর্ণ মুখস্ত সম্পন্ন করেন। পরিবারের প্রথম সন্তান হাফেজে কুরআন এজন্য দীন ইসলামকে সকলে বাড়তি আদর করতেন। পৈতৃক বাড়ী চাঁদপুর হলেও গত পঁচিশ বছর স্ব-পরিবারে যাত্রাবাড়ী এলাকায় বসবাস করে আসছেন শহীদ দীন ইসলামের পরিবার। তার বাবা একজন চা-দোকানদার। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার সংলগ্ন মোড়ে তাদের একটি চায়ের দোকান রয়েছে। দোকানটি ভাড়ায় চালিত। শহীদের গ্রামের বাড়িতে আবাদি কোনো জমি নেই। তবে এক রুমের জীর্ণশীর্ণ একটি ঘর রয়েছে। যেখানে হাফেজে কোরআনের দাদী বসবাস করেন। বাড়িটি বাঁশ ও টিনের বেড়া দিয়ে তৈরী। তবুও জীবন চলছে জনাব শাহ আলম শারীরিকভাবে অসুস্থ। চা-ব্যবসার পূর্বে মেশিনের সাহায্যে তিনি আখ মাড়ানোর কাজ করতেন। হঠাৎ একদিন মেশিন চলাকালীন শার্টের হাতা হেঁচকা টান লেগে মর্মান্তিক জখম হন তিনি। মেশিনের মধ্যে তার পুরো শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে যায়। পরবর্তীতে আশেপাশের মানুষ তাকে উদ্ধার করেন। প্রাণে বাঁচলেও চিরদিনের জন্য তিনি পঙ্গু হয়ে যান। ছয় মাস ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি থাকার পর তার শরীরে প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়। বর্তমানে তার শরীরের বাম পাশ পঙ্গু হয়ে আছে। পাঁচ কেজির বেশি ওজন তুলতে পারেন না তিনি। -দুনিয়াতে সবই পাবে কিন্তু ভাইয়ের ভালোবাসা আর পাবে না। সামিউল ইসলাম শহীদ দীন ইসলামের একমাত্র ছোট ভাই। যাকে তিনি প্রচন্ড ভালোবাসতেন। সবসময় আলাদা করে তাকে আগলে রাখতেন। কখনও ছোট ভাইয়ের সাথে দুর্ব্যবহার করতেন না তিনি। বর্তমানে সামিউল সবুজ বিদ্যাপীঠ স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তির দ্বারপ্রান্তে আছে। স্বৈরাচার নিপাত যাক বাংলাদেশ মুক্তি পাক আন্দোলনের জবানবন্দি সারাদেশে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত করতে একদফা দাবি ওঠে। প্রথমত কোটা সংস্কার দাবিকে কেন্দ্র করেই এই আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে হাসিনা সরকার ছাত্রদের রাজাকার বলে উস্কানি দেয়। ফলে ছাত্র-জনতা উপহাসের শিকার হয়ে আরও বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ঢাকাসহ সারাদেশে শেখ হাসিনার পদত্যাগে একদফা দাবি তোলেন তারা। ০৫ আগস্ট ২০২৪ গণভবন ঘেরাও কর্মসূচী দেয় বৈষম্যবিরোধী সমন্বয়কবৃন্দ। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে লক্ষ্য জনতা রাজপথে নেমে আসে। ছাত্র জনতার দাবী নস্যাৎ করতে সারাদেশে আওয়ামী সন্ত্রাস বাহিনী গুম, নির্যাতন, ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। যার সরাসরি মদতদাতা ছিল তৎকালীন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। তার নির্দেশে ছাত্রদের উপর ঘাতক পুলিশ বাহিনী অগণিত টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, ছররা গুলি এবং স্নাইপার নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। চারিদিকে অসংখ্য ছাত্র-জনতা এবং বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষ শাহাদাত বরণ করেন। তারপর আর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি খুনি হাসিনা। ছাত্র-জনতা গনভবনে পৌঁছানোর পূর্বে সরকার থেকে পদত্যাগ করেনসে। জনতার রোষানলে পড়ে হেলিকপ্টার যোগে সুদূর ভারতে পলায়ন করে। বিজয় যখন বেদনার সারাদেশে বিজয় মিছিল আরম্ভ হয়। সে মিছিল দেখতে ছোট ভাই সামিউলকে (১৭) নিয়ে যাত্রাবাড়ীর ফ্লাইওভার সংলগ্নে মিলিত হয় হাফেজ দীন ইসলাম। সরকার পদত্যাগ করার পরও হাসিনার পালিত পুলিশ বাহিনী ব্যাপক গুলি ছুড়তে থাকে। চারিদিকে লাশের স্তপ পড়ে যায়। পুলিশকে সরাসরি গুলি করতে দেখে দুই ভাই প্রচন্ড ভয় পায়। তারা সেখান থেকে সরে আসার চেষ্টা করেন। ফ্লাইওভারের খুঁটির পিছনে আশ্রয় নেন তারা। সময়-দুপুর ৩.৩০, সামিঊল লুকাতে পারলেও দীন ইসলাম পুলিশের সামনে পড়ে যায়। তাঁকে দেখতে পেয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে পুলিশ সদস্যরা। তার বাম হাত এবং ডান পায়ে পুলিশ গুলি চালায়। এলোপাথাড়ি সেই গুলিতে হাফেজ দীন ইসলাম ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরণ করেন। সন্তানের মৃত্যু সংবাদ শুনে চিৎকার করে ওঠেন শিল্পী আক্তার। বারবার বলতে থাকেন,“আমারে একটু তার কাছে নিয়ে চল, আমি জানতে চাই, আমার পোলারে কেন গুলি করছে, কেন আমার পোলারে হত্যা করা হল। আমারে কেউ জবাব দে? আমার হাফেজ পোলা। দুপুরেও আমার ঘরে ভাত খায়ছে। আমার পোলার জীবন ফেরত দে। ঐ হাসিনা আমার পোলারে মারছে, আমার বুক খালি করছে, একদিন হের বুকও খালি হইব।” অবশেষে হাফেজে কোরআন শহীদ দীন ইসলাম বেপারীর লাশ তার গ্রামের বাড়িতে নেয়া হয়। ঠেটালিয়া মাঠ প্রাঙ্গণে গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে জানাজা সম্পন্ন হয়। বৃদ্ধা দাদী বারবার জনাতে চায়- ও শাহ আলম, আমার দীনরে তুই কোথায় নিয়ে যাবি।” পৃথিবীতে সবচাইতে ভারী বোঝা হচ্ছে পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ! জগতে সন্তান হারাবার চাইতে বড় কষ্ট আর হতে পারে না। মৃত্যু জগতের সবচাইতে নিশ্চিত ব্যাপার। মৃত্যু আসবেই। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবেই এটা জগতের অবধারিত নিয়ম! সন্তানকে কাঁধে তুলে নেয় পঙ্গু বাবা। দোকানের কেটলি তুলতে যার হাত কাঁপে, সে আজ খাটিয়া উঁচু করে ধরেছে। সন্তানকে বয়ে নেয়ার সময় অঝোরে কাঁদেন শহীদ পিতা। ছেলের হাসি-মুখ কল্পনা করে আবারও রওনা করেন কবরস্থানের দিকে। কাঁধ থকে খাটিয়া নামিয়ে রাখেন শহীদের কবরের পাশে। পরবর্তীতে গ্রামের বাড়ী চাঁদপুর ঠেটালিয়া কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত হয় হাফেজে কোরআন শহীদ দীন ইসলাম বেপারী। অমায়িক ব্যবহার যার মুখে আছে, পৃথিবীও ঋণী হয় ঠিক তার কাছে দিশেহারা পরিবার শহীদের হঠাৎ মৃত্যুতে পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। তার বাবা কাঁদতে কাঁদতে জানায়, “আমি প্যারালাইসিস পঙ্গু মানুষ, কিভাবে এই সংসার চালাব? কিভাবে এই শোক ভুলে যাব? পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন শহীদ দীন ইসলাম বেপারী। তার মৃত্যুতে চায়ের দোকানটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আর এই দোকানটিই পরিবারের একমাত্র রুটিরুজির জায়গা।” শহীদের মামী বলেন- “আমি দীন ইসলামকে যখন দেখি তার বয়স ছিল দশ বছর। সদা হাসিমুখে থাকত ছেলেটি। আমি উচ্চস্বরে কথা বললে আমাকে নিষেধ করত। বলত- মামি, আপনি আস্তে কথা বলবেন। আল্লাহ আস্তে কথা পছন্দ করেন। ছোটদেরকে খুব আদর করত দীন। ওর কাছে এক টাকা থাকলেও ছোটদেরকে চকলেট কিনে দিত। দ্বীন ইসলাম যে নেই, আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।” এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : দীন ইসলাম বেপারী পেশা : ব্যবসায়ী (চা দোকানদার) জন্ম তারিখ ও বয়স : ০২ মে ২০০২, ২২ বছর শহীদ হওয়ার তারিখ : ৫ আগস্ট ২০২৪, সোমবার, আনুমানিক দুপুর ৩.৪৫ টায় শাহাদাত বরণের স্থান : যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার দাফন করা হয় : মধ্য ঠেটালিয়া কবরস্থান, এনায়েত নগর, মতলব উত্তর, চাঁদপুর স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মধ্য ঠেটালিয়া, ইউনিয়ন: এনায়েত নগর, থানা: মতলব, জেলা: চাঁদপুর পিতা : শাহ আলম বেপারী, পেশা: চা-দোকানদার, বয়স: ৪৪, (পঙ্গু) মাতা : শিল্পী আক্তার, পেশা: গৃহিণী বয়স: ৩৯ ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : স্বল্প পরিসরে বসতি জমি রয়েছে ভাইবোনের বিবরণ : সামিউল ইসলাম, বয়স: ১৭, সবুজ বিদ্যাপীঠ স্কুল এন্ড কলেজ প্রস্তাবনা ১. শহীদের একমাত্র ছোট ভাই সামিউলের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়া যেতে পারে। ২. তার বাবাকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া যেতে পারে। ৩. পরিবারের একমাত্র অবলম্বন চায়ের দোকানটি বড় পরিসরে করে দেয়া যেতে পারে।