জন্ম তারিখ: ২৩ নভেম্বর, ১৯৯৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : স্থানীয় প্রতিনিধি, এপেক্স কোম্পানী, মাদারীপুর। শাহাদাতের স্থান : গুলিস্থান, ঢাকা।
“স্ত্রীর গর্ভে সন্তান রেখে শহীদ হলেন বাবা পরিবারের দেখাশোনার জন্য রইল না যে কেউ” শহীদ মো: মনিরুজ্জামান মোল্লা ছিলেন এক সংগ্রামী, সৎ ও ধর্মপ্রাণ মানুষ, যিনি দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েও জীবন সংগ্রামে নিজের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ১৯৯৮ সালের ২৩ নভেম্বর মাদারীপুর জেলার এক ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছেলেবেলা থেকেই শান্ত-স্বভাবের, মেধাবী এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। তার পিতা, জনাব নুরুল ইসলাম মোল্লা, একজন অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, এবং মা, মনোয়ারা বেগম, একজন গৃহিণী। শহীদ মনিরুজ্জামান ছিলেন একটি ৭ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পরিবারের বড় দায়িত্ব তার কাঁধে ছিল। পিতার বার্ধক্যজনিত কারণে কোনো কাজ করতে না পারায়, ছোটবেলা থেকেই মনিরুজ্জামান বুঝেছিলেন তার পরিবারে অর্থনৈতিক সাহায্য দরকার। তাই গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর তিনি মাদারীপুরে এপেক্স কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। তার বেতন ছিল মাত্র ১৫ হাজার টাকা, কিন্তু সেই সামান্য আয়ে তিনি তার বাবা-মা, স্ত্রী, এবং বড় দুই বোনের সহ পরিবারের সকল খরচ বহন করতেন। তার বোনের স্বামী মানসিকভাবে অসুস্থ্য থাকায়, বোন ও তাদের সন্তানরাও তার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। মানুষ হিসেবে মনিরুজ্জামান ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী ও দায়িত্বশীল। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি পরিবারের দায়িত্ব পালন এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে কাটিয়েছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় ও ইসলামের মৌলিক এবাদতগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা তার জীবনের অংশ ছিল। পরিবারের প্রতি তার দায়িত্ববোধ ও সমাজের প্রতি তার সহানুভূতি তাকে সবার কাছে প্রিয় করে তুলেছিল। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট, ছাত্র আন্দোলনের বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণের সময় তিনি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। শহীদ মনিরুজ্জামানের এই আত্মত্যাগ তার পরিবারের জন্য গভীর বেদনার হলেও, তার সংগ্রামী জীবন আজও আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণা। তিনি ছিলেন এক সাহসী এবং মানবিক মানুষ, যিনি শুধু নিজের পরিবারের জন্য নয়, সমাজের জন্যও সংগ্রাম করে গেছেন। যেভাবে শহীদ হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হয় সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন। সারাদেশে জুলাই ও আগস্ট মাসের ৪ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ১০০০ ছাত্র-জনতা হত্যা করে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার। ছাত্র-জনতা একসাথে কর্মসূচি দেয় ঢাকা টু মার্চ কর্মসূচি। এই কর্মসূচিতে সারা দেশ থেকে মানুষ ছুটে আসে ঢাকায়। ৫ তারিখ সকাল ১১ টার পর থেকেই ঢাকার রাজপথে নামে মানুষের ঢল। এদিনও স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের নির্দেশে পুলিশ বিজিবি নির্মমভাবে হত্যাযজ্ঞ চালায়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে গেলেও তার প্রেতাত্মা ভরকারী পুলিশ বাহিনী অবিরাম গুলি চালাতে থাকে। বিশেষ করে সাভার, যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি ৩২ , আজমপুর ও গুলিস্তান সহ বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য মানুষের লাশ ফেলে এই আওয়ামী সরকারের সন্ত্রাসী বাহিনী। তবে ছাত্র-জনতা এর মধ্যেই ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথেই দাঁড়িয়ে থাকে। শেষ পর্যায়ে শেখ হাসিনা পরিস্থিতি অনুকূলে দেখতে না পেয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই ৫ তারিখেই মাদারীপুরের কৃতি সন্তান মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মোল্লা সকাল ১২ টার দিকে তার কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে মোটরসাইকেলে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথের বিভিন্ন বাধা পেরিয়ে ঢাকা গুলিস্তানে এসে আসরের নামাজ পড়ে। নামাজ শেষ করে দেখতে পান মসজিদের বাহিরে এক ভয়ানক দৃশ্য। এক ঝাঁক পুলিশ বাহিনী তাদেরকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। শুধু তাই নয়, মুসল্লিদের উদ্দেশ্য করে একের পর এক গুলি বর্ষণ করছে। হঠাৎ করে দুটি গুলি এসে মনিরুজ্জামানের বুকে ও পেটে বিদ্ধ হয়। তিনি মসজিদের সীমানাতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। তিনি গুলিস্থানে শহীদ হলেও তার লাশ গুলিস্থানে বন্ধুরা খুঁজে পায় না। পরবর্তীতে হাতিরঝিল থেকে উদ্ধার করা হয় তার লাশ। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে তার পরিবারকে জানালে সেখান থেকে লাশ মাদারীপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। শহীদ পরিবারের করুণ দৃশ্য শহীদ মো: মনিরুজ্জামান মোল্লা ছিলেন এক সংগ্রামী এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি, যিনি তার সামান্য উপার্জন দিয়ে পরিবারের বিশাল বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। একটি জুতার কোম্পানিতে মাত্র ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেও তিনি তার বাবা-মা, স্ত্রী, এবং দুই বোনের পরিবারের খরচ চালাতেন। তার পিতা বার্ধক্যের কারণে কোনো কাজ করতে পারতেন না, এবং তার বোনের স্বামী মানসিক বিকারগ্রস্ত হওয়ায়, তিনিও পরিবারে কোনো সাহায্য করতে পারতেন না। ফলে, পুরো পরিবার মনিরুজ্জামানের আয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল। তার এই দায়িত্বশীলতা তাকে পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় এবং শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলেছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণের সময়, তিনি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন, যার ফলে তার পরিবারে উপার্জনের আর কোনো মাধ্যম রইল না। শহীদ মনিরুজ্জামানের মতো একজন সংগ্রামী মানুষের অনুপস্থিতি তার পরিবারের জন্য যে কী পরিমাণ শূন্যতা তৈরি করেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয় ও বন্ধুর বক্তব্য/অনুভূতি শহীদ মনিরুজ্জামানের স্ত্রী বলেন, মনিরুজ্জামান খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ ইসলামের মৌলিক ইবাদত পালন করতেন এবং আমাকেও ইসলামের বিধান মেনে চলতে বলতেন। সে সকল আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ খবর রাখতেন। সকলের বিপদে ছুটে যেতেন। সে ছিলো আমার বন্ধুর মতো। সে নেই এটা ভাবতেই আমি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন মনিরুজ্জামান বলতেন আল্লাহ আমার ১৫,০০০ টাকার ইনকামে ৫ লক্ষ টাকার বরকত দেন। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য নাম : শহীদ মো: মনিরুজ্জামান মোল্লা জন্ম তারিখ : ২৩ নভেম্বর, ১৯৯৮ ধর্ম : ইসলাম জাতীয়তা : বাংলাদেশী পিতার নাম, বয়স, অবস্থা : জনাব নুরুল ইসলাম মোল্লা, বয়স: বৃদ্ধ (অবসরপ্রাপ্ত, কর্মক্ষম নন) মায়ের নাম, পেশা : মনোয়ারা বেগম, গৃহিণী পারিবারিক সদস্য : ৭ জন (পিতা, মাতা, স্ত্রী, ২ বোন, ২ ভাগ্নে/ভাগ্নি) ছেলে মেয়ে : নেই (স্ত্রীর গর্ভে ৭ মাসের সন্তান আছে) স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: শাখারপার, ইউনিয়ন: লুন্দি, থানা: রাজৈর, জেলা: মাদারীপুর বর্তমান ঠিকানা : বাসা/হোল্ডিং: ০৫৩৩-০০, গ্রাম/রাস্তা: প্রধান সড়ক, ডাকঘর: মাদারীপুর সদর ৭৯০০ মাদারীপুর সদর, মাদারীপুর পৌরসভা, মাদারীপুর ঘটনার স্থান : গুলিস্তান আক্রমণকারী/আঘাতকারীর : আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পুলিশ আহত হওয়ার সময়কাল : ৫ আগস্ট ২০২৪ আনুমানিক বিকাল ৫ টা মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : ৫ আগস্ট ২০২৪ আনুমানিক বিকাল ৬ টা শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : শাখারপাড়, লুন্দী, রাজৈর, মাদারীপুর প্রস্তাবনা ১. শহীদ পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতা প্রদান। ২. যোগ্যতানুযায়ী শহীদের স্ত্রীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। ৩. আগত সন্তানকে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা।