জন্ম তারিখ: ৩ ডিসেম্বর, ১৯৯৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : কৃষি, শাহাদাতের স্থান : মাদারিপুর সার্বিক তেলের পাম্পের সামনে
সালটি ছিলো ১৯৯৭। ঘন কুয়াশায় ঘেরা চারপাশ। ঠান্ডাও পড়েছে বেশ। তেমনি এক শীতের দিনে কৃষক আমর আলী বেপারী ও রিনা বেগমের কোলজুড়ে এলো এক ফুটফুটে শিশু। তাদের প্রথম সন্তান ও ছেলে হিসেবে দুনিয়ায় আগমন ঘটেছিলো রুমান বেপারীর। হ্যাঁ, বলছিলাম মাদারিপুর জেলার মাদারিপুর থানার অন্তর্গত ঘটমাঝি মাদারিপুর ইউনিয়নের ভদ্রখোলা গ্রামের কৃতি সন্তান শহীদ রুমান বেপারীর কথা। দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলো বটে, তবে অন্তর ছিলো গরীয়ান আর অসীম সাহসে ভরপুর। আচরণে ছিলো উদার, আর অন্যের সহযোগিতা করার মধ্যে ছিলো তার সুখ। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে দায়িত্ববোধ শিখে নিয়েছিলো শুরু থেকেই। সেই দায়িত্ববোধকে কাজে লাগিয়েই দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করার আন্দোলনে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে স্থান করে নিয়েছিলো বীরদের কাতারে। পারিবারিক অবস্থা কৃষক পিতা ও গৃহিণী মাতার বড় সন্তান ছিলেন রুমান ব্যাপারী। পিতামাতা, ছোট ভাই, প্রিয়তমা স্ত্রী ও একমাত্র আদরের কন্যাসহ ছয়জনের সাজানো সংসার ছিলো, ছোট্ট একটি টিনের চালের নিচে।এই ঘর ছাড়া আর কোন চাষের জমি ও ছিলো না। বাবার কৃষিকাজ ছিলো আয়ের একমাত্র উৎস। তাই বাবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধরেছিলেন সংসারের হাল। দারিদ্রের কশাঘাত যেন দমিয়ে রাখতে পারেনি রুমান ব্যাপারীকে। পিতামাতার দু:খ মোচন, একমাত্র ছোট ভাই ও আদরের মেয়ের ভবিষ্যৎকে সুন্দর করতে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। এরই মধ্যে শেষ করেছিলেন পাসপোর্টের কাজও, কিন্তু বিদেশে যাওয়া আর হলো না। স্বৈরাচার সরকারের গুন্ডাবাহিনীর হাতেই শেষ হয়ে গেলো রুমানের প্রাণ। কেউ কি জানতো পরিবারের এই অভিভাবক তাদের ছেড়ে চলে যাবেন না ফেরার দেশে? প্রিয়তমা স্ত্রী কি জানতো একটি বারের জন্যও তার প্রিয় মানুষটির মুখ আর দেখবেনা? অবুঝ সন্তান কি আর বুঝে তার বাবা হারিয়ে গেছে চিরতরে ? ঘটনার প্রেক্ষাপট সেদিন ছিলো শুক্রবার। সারদেশ জুড়ে চলছিলো স্বৈরাচার হাসিনার তাণ্ডব।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে নস্যাৎ করার বিভীষিকাময় সব আয়োজন ই একের পর এক প্রত্যক্ষ করছিলো সারাদেশের জনগণ। এর আগে, ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা আসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে।সেই কর্মসূচি যেন বাস্তবায়ন করতে না পারে, সেজন্য বৃহস্পতিবার রাত থেকেই ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয় স্বৈরাচার সরকার। ঢাকাসহ সারাদেশে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করে, যারা নির্বিচারে ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালায়। পুলিশ বাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছিলো ছাত্রলীগ, যুবলীগের গুন্ডারা,যারা অবৈধ সরকারের ছত্রছায়ায় ছাত্র-জনতাকে নির্মমভাবে অত্যাচার করে ও অসংখ্য নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ১৯ জুলাই শুক্রবারেও চলছিলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রম। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়েই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন রুমান বেপারী। বিকেল ৫:৩০ টার দিকে রুমান ও তার সহযোদ্ধারা অবস্থান করছিলো মাদারীপুর সার্বিক তেলের পাম্পের সামনে। ঠিক সেই সময় অবৈধ সরকারের সাবেক নৌ ও পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খানের নির্দেশে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ বাহিনীর যৌথ আক্রমণ শুরু হয়।তাদের এলোপাতাড়ি আক্রমণের মুখে গুলিবিদ্ধ হন রুমান।তার সহযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে তাকে নিয়ে যান মাদারীপুর সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে পৌছার কিছুক্ষন পরেই আনুমানিক ৬ টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে ঝড়ে যায় আরও একটি তাজা প্রাণ। অভিভাবক হারা হয় একটি পরিবার। বিধবার তালিকায় যোগ হয় প্রিয়তমা স্ত্রীর নাম আর এতিম হয়ে যায় তার আদরের রাজকন্যা। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়দের অনুভূতি শহীদ রোমান ছিলেন তার মায়ের সেই সন্তান, যার মুখে তিনি প্রথম মা ডাক শুনেছিলেন। রুমান প্রতিবার যখন তাকে মাকে মা বলে ডাকতেন হয়তো তার মা সেই প্রথমবার মা ডাক শোনার অনুভূতি পেতেন। সেই মমতাময়ী মায়ের প্রতি ছিলো তার অগাধ ভালোবাসা ও সম্মান,মায়ের যত্নে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর মা বলেন- “আমার ছেলে আমার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করতো না। আমার যখন যা লাগতো তা ই এনে দিতো। আমি অনেকদিন ধরেই অসুস্থ আছি, সবসময় আমার ঔষধ এনে দিতো।” আর প্রতিবেশীদের অন্তরেও তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন তার সুন্দর আচরণের মাধ্যমে। বিপদ আপদে, সুখে-দু:খে সবাই তাকে পাশে পেতো। প্রতিবেশী বলেন- “রুমান বেপারী অনেক ভালো মানুষ ছিলেন, আশেপাশের কেউ যখনই কোনো সমস্যায় পড়তো তখন সে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে যেতো।” রুমানের মৃত্যুর মাধ্যমে হারিয়ে গেলো একটি সাহায্যের হাত। এখন তার পরিবারের লোকেরাই দেশের লোকেদের সাহায্যের অপেক্ষায়। সহযোগিতার প্রস্তাবনা যে রুমান তার জীবনের বিনিময়ে আমাদেরকে একটি স্বৈরাচার মুক্ত দেশ উপহার দিয়ে গেলো সেই রুমানের প্রতিদান হয়তো কোনো কিছুতেই দেয়া সম্ভব না।অন্তত তার এতিম মেয়ের ভরণপোষণ এবং পড়াশোনার দায়িত্ব পালন করতে পারলে কিংবা তার পরিবারের জন্য স্থায়ী কোনো আয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে হয়তো নিজেদের কিছুটা দায়মুক্ত করা যাবে। এক নজরে শহীদের ব্যাক্তিগত তথ্য পুরো নাম : রুমান বেপারী জন্ম : ৩/১২/১৯৯৭ ঠিকানা : গ্রাম: ভদ্রখোলা, ইউনিয়ন: ঘটমাঝি মাদারিপুর, থানা: মাদারিপুর, জেলা: মাদারিপুর পিতা : আমর আলী ব্যাপারী, পেশা: কৃষি, বয়স: ৫৭ মাতা : রিনা বেগম, পেশা: গৃহিণী, বয়স: ৫৫ পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৫ জন ১. পিতা, ২. মাতা, ৩. ছোট ভাই, ৪. স্ত্রী, ৫. চার বছর বয়সী মেয়ে ঘটনার স্থান : মাদারিপুর সার্বিক তেলের পাম্পের সামনে আক্রমণ কারী : সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও ঘাতক পুলিশের যৌথ আক্রমণ আহত হওয়ার তারিখ : ১৯/০৭/২০২৪ (বিকেল ৫:৩০) নিহত হওয়ার তারিখ ও স্থান : ১৯/০৭/২০২৪ আনুমানিক সন্ধ্যা ৬:০০ (মাদারিপুর সদর হাসপাতাল)