জন্ম তারিখ: ২৮ এপ্রিল, ২০০১
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রাজশাহী
পেশা : গার্মেন্টস কর্মী শাহাদাতের স্থান :আশুলিয়া থানার সামনে।
হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর কিছুদিন পর ভ্যানের উপর লাশের স্তুপের যে ভিডিওটি দেশব্যাপী ব্যাপক ভাইরাল হয়েছিল, সেই লাশগুলোর মধ্যে ছিলেন শহীদ বায়েজিদ বোস্তামী। বায়েজিদ বোস্তামীর জন্ম ২৮ এপ্রিল ২০০১ সালে গ্রামের বাড়ি কৈগ্রাম ফার্শি পাড়ায়। তার ইউনিয়ন উমার, থানা ধামুইরহাট, জেলা নওগাঁ। তার পিতার নাম মৃত সাখাওয়াত হোসেন। মাতা বেনু আরা। বায়েজিদ বোস্তামীরা দুই ভাই এক বোন। বড় ভাই কারিমুল ইসলাম (২৪) দিনমজুর, ছোট বোন উম্মে সালমা (১৭) দশম শ্রেণির ছাত্রী। পড়াশোনা করেন কৈফতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। বায়েজিদ বোস্তামী বিবাহিত ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম রিনা আক্তার। তিনি একজন গার্মেন্টস কর্মী। বায়েজিদ বোস্তামীর ৭ মাসের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। নাম রাফি আব্দুল্লাহ। বায়েজিদ বোস্তামী বর্তমানে পেশায় গার্মেন্টস কর্মী ছিলেন। অফিস সহকারীর চাকরি করতেন ভেনেসা বাংলাদেশ লিমিটেড-এ। স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকতেন আশুলিয়া। যেভাবে শহীদ হন তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বায়েজিদ বোস্তামীর গার্মেন্টস বন্ধ থাকায় তিনি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। স্বৈরাচারের কবল থেকে নিজেকে, দেশকে, দেশের মানুষকে মুক্ত করতে ৫ই আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে ছাত্র জনতার আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। আনুমানিক বিকাল ৪টার সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ছাত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ গুলি করে এবং বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। গুলিবিদ্ধ হন শহীদ বায়েজিদ বোস্তামী। তার সাথে নিহত হন আরো অনেকে। পুলিশ সদস্যরা সেই লাশগুলো একটি ভ্যানের উপর স্তুপ করে। যে ভিডিওটি সারাদেশে ব্যাপক ভাইরাল হয় এবং আলোড়ন সৃষ্টি করে। তারপর তাকেসহ সেই লাশগুলো আশুলিয়া থানার সামনে একটি লেগুনাতে তুলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পুড়ে ঝলসে যায় শহীদ-বায়েজিদ বোস্তামীর সমস্ত দেহ। ৬ই আগস্ট শহীদ বায়েজিদ বোস্তামীর সাথে থাকা অধ্য পুড়ে যাওয়া কলেজের এইচএসসির আইডি কার্ড, মোবাইল ফোন ও স্ত্রীর ছবি দেখে মরদেহ সনাক্ত করা হয়। আশুলিয়া থানা থেকে শহীদ বায়েজিদ বোস্তামীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হয়। ফোন পেয়ে শহীদ বায়েজিদ বোস্তামির চাচাতো ভাই আলামিন, সালমানসহ তার স্ত্রী তৎক্ষণাৎ ছুটে যান আশুলিয়া থানায়। অতঃপর বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমন্বয়ক ও সেনাবাহিনীর মাধ্যমে শহীদের স্ত্রী রিনা আক্তারের কাছে তার পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়। শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ভিডিওটি ভাইরাল হয় এবং সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন পুলিশ সদস্য একটা ভ্যানের ওপর অনেকগুলো লাশ তুলে স্তুপ করেছে। তারপর বড় কাপড় দিয়ে লাশগুলোকে ঢেকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ ওই লাশগুলো নিয়ে একটি লেগুনাতে তোলে। তারপর পেট্রোল ঢেলে সেগুলো পুড়িয়ে দেয়। পোড়া লাশের ভিডিও চিত্র ৬ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। শহীদ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা বায়জিদ বোস্তামির বাবা মারা গেছেন ২০১৮ সালে। বাবা মারা যাওয়ার পর বায়েজিদের বড় ভাই কারিমুল ইসলাম লেখাপড়া বাদ দিয়ে সংসারের হাল ধরেন। বায়েজিদ তখন পড়াশোনা করতেন। বাবার রেখে যাওয়া কোনো সহায়-সম্পত্তি না থাকায় সংসার চালাতে দিনমজুরের কাজ করেন শহীদের বড় ভাই। মাঝে মাঝে বায়েজিদ বোস্তামীও কাজ করতেন। এভাবেই চলছিল ২ ভাই, ১ বোন ও মা'সহ ৪ জনের সংসার। যেখানে বায়েজিদ ও তার বোন পড়াশোনাও করতেন। বায়েজিদ ২০১৮ সালে এসএসসি পাস করে জীবিকার তাকিদে ঢাকায় আসেন। সাভার আশুলিয়ায় একটি গার্মেন্টসে অফিস সহকারীর চাকরি নেন। পাশাপাশি এসএসসিতে ভর্তি হন উত্তরা আইডিয়াল কলেজে। ২০২০ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর অনার্সে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। ২০২২ সালে রিনা আক্তারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে খুব কষ্ট করে নিজের সংসার ও ছোট বোনের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যেতে থাকেন বায়েজিদ বোস্তামী। তিনি শহীদ হওয়ায় ৭ মাসের শিশুসন্তানসহ তার স্ত্রী দারুণ অসহায় হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে তিনি চাকরি হারিয়ে সাভারের আশুলিয়ায় বোনের বাসায় মানবেতার জীবনযাপন করছেন। গ্রামের বাড়িতে বায়েজিদ বোস্তামীদের থাকার মতো মাত্র দুটি মাটির ঘর আছে। বসতভিটার ১৭ শতক জমি ছাড়া আর কিছুই নেই তাদের। শহীদ সম্পর্কে সামগ্রিক বর্ণনা বাজার থেকে খানিকটা দূরে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ পেরিয়ে তবেই দেখা যায় ছোট্ট একটি গ্রাম— কৈগ্রাম। নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থানার কৈগ্রামে ২৮শে এপ্রিল, ২০০১ সালে এক গরীব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এক ছেলেশিশু। মা বেনু আরা ও বাবা ছাকোয়াত হোসেন ছেলের নাম রাখেন বায়েজিদ বোস্তামী। ইতিহাসে মাতৃভক্ত বায়েজিদ বোস্তামীর কথা কে না জানে? এই শিশু বায়েজিদও ছিলেন পিতামাতা ভক্ত। বায়েজিদ বোস্তামী ছিলেন পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত প্রকৃতির। বাস্তবতাটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারতেন তিনি। পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি বড় ভাইয়ের সাথে মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। ২০১৮ সালে ফার্শিপাড়া মোজাফফর রহমানিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে তিনি দাখিল পাস করেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সেই ২০১৮ সালেই তার বাবা সাখাওয়াত হোসেন পাড়ি জমান পরপারে। পরিবারের দায়িত্ব চলে আসে দুই ভাইয়ের কাঁধে। তাই পরিবারের কথা চিন্তা করে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। আশুলিয়ায় ভেনেসা গার্মেন্টসে অফিস সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। চাকরির পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে থাকেন। উত্তরা আইডিয়াল কলেজে মানবিক বিভাগে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। চাকরির পাশাপাশি পড়ালেখা কষ্টকর হলেও তিনি ছোট বোন এবং নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করে থেমে থাকেননি। ২০২০ সালে বায়েজিদ উত্তরা আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে অনার্সে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর বায়েজিদ বোস্তামী রিনা আক্তারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দুজনেই গার্মেন্টসে চাকরি করতেন, যা দিয়ে তাদের সংসার ভালোই চলছিল। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ, বায়েজিদের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করে ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। নাম রাখেন রাফি আব্দুল্লাহ। পরিবারের সবাই খুশি। অথচ এই খুশি অচিরেই বিলীন হয়ে যায়। পরিবারে নেমে আসে চরম শোকের ছায়া। ৫ই আগস্টের এক কালো বিভীষিকা ভেঙেচুরে চুরমার করে দেয় এই পরিবারের সকল স্বপ্ন, সকল আশা-ভরসা। শোকে পাথর হয়ে যান বায়েজিদের স্ত্রী। সাত মাসের শিশু আব্দুল্লাহ কি বুঝেছিল কিছু? সে কি বুঝতে পেরেছিল মাত্র ৭ মাস বয়সে সে এতিম হয়ে গেছে? সে কি বুঝেছিল আর কখনোই তার পিতার মুখটি তার চোখের সামনে ভাসবে না? আশুলিয়া জামে মসজিদের সামনে শহীদ বায়েজিদ বোস্তামীর প্রথম জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। পরের দিন ৭ আগস্ট সকালে নওগার ধামুইরহাট থানার অন্তর্গত তার নিজ গ্রাম কৈগ্রামের ফার্শি পাড়াতে তার দ্বিতীয় জানাজার নামাজ শেষে সরকারি কবরস্থানে তাকে চিরদিনের জন্য সমাহিত করা হয়। এই পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে হারিয়ে যায় সংগ্রামী বায়েজিদ। সন্তানহারা বায়েজিদের মায়ের ক্রন্দনে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে! শহীদের স্বজনদের হাহাকার বায়েজিদের রেখে যাওয়া পোশাক নিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকেন তার বন্ধুর মতো বড় ভাই। তিনি ক্রন্দনরত কন্ঠে বলতে থাকেন, "তারা আমার ভাইকে গুলি করলো, কিন্তু আগুনে পুড়িয়ে জ্বালিয়ে দিলো কেন? কী দোষ ছিল আমার ভাইয়ের?" তিনি আরো বলেন, "আমার ভাইয়ের রেখে যাওয়া পোশাক আমি যত্ন করে রেখে দিব। তার ছেলে রাফি যখন বড় হবে, তখন তাকে দেখাবো। সে অনুভব করতে পারবে বাবার ঘ্রাণ আসলে কেমন হয়।" এ বলে পোশাকগুলো জড়িয়ে ধরে অবুঝের মতো কান্না করেন তিনি। ছোট বোন পাগলের মতো কান্না করেছেন আর বলছেন, "কে আমার লেখাপড়ার খোঁজ নিবে? কে আমাকে আদর করবে? বায়েজিদের মা বলেন, "বায়েজিদের মানিব্যাগে যে টাকাগুলো পাওয়া গিয়েছে, সে টাকাগুলো আমার কাছ থেকে নিয়েছিলেন বাড়িতে আসার জন্য।" তিনি বলেন, "আমার ছেলে বাড়িতে আসলো ঠিকই, কিন্তু সাদা কাফনে জড়িয়ে পোড়া শরীর নিয়ে।" শহীদদের এক প্রতিবেশী চাচা এনামুল হক জানান, "শহীদ বায়েজিদ বোস্তামী খুবই পরিশ্রমী ও সাহসী ছেলে ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তারা দুই ভাই খুব কষ্ট করে সংসার চালাতো।" তিনি তাদের সংসারের করুণ অবস্থা এবং শহীদ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। বায়েজিদ বোস্তামির পরিবারের সকরুণ অবস্থা দেখে তাদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা তখন কারো ছিল না। শহীদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : বায়েজিদ বোস্তামী জন্ম তারিখ : ২৮.০৪.২০০১ শহীদ হওয়ার তারিখ ও সময় : ৫ই আগস্ট, ২০২৪; বিকাল ০৪:৩০টা আঘাতের ধরন : গুলিবিদ্ধ অতঃপর পুড়িয়ে মারা গুলিবিদ্ধের স্থান : আশুলিয়া থানার সামনে ঘাতক : পুলিশ সমাধিস্থল : মহাদেবপুর কবরস্থান, নওগাঁ পেশা : গার্মেন্টস কর্মী পিতা : মৃত ছাকোয়াত হোসেন মাতা : বেনু আরা স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: কৈগ্রাম (ফার্শিপাড়া), ইউনিয়ন: উমার, থানা: ধামুইরহাট, জেলা: নওগাঁ বাড়িঘর ও সম্পদ : গ্রামের বাড়িতে মাত্র ২টি মাটির ঘর ও ১৭ শতক জমি স্ত্রী-সন্তান : স্ত্রী রিনা আক্তার, বয়স: ২০, গার্মেন্টস কর্মী, সন্তান রাফি আব্দুল্লাহ, বয়স: ৭ মাস ভাইবোন : ১ ভাই, ১ বোন, ভাই কারিমুল ইসলাম (২৪) দিনমজুর, বোন উম্মে সালমা (১৭) ১০ম শ্রেণির ছাত্রী শহীদ পরিবারের জন্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ১. শহীদের স্ত্রী রিনা আক্তারের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ২. শিশুসন্তানের লালন পালনের জন্য নিয়মিত মাসিক সাহায্য করা