জন্ম তারিখ: ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রাজশাহী
পেশা : ছাত্র ও চাকরিজীবী, শাহাদাতের স্থান : তালাইমারী, রাজশাহী সদর
মাকে উদ্দেশ্য করে সাকিব 'মা, কত মানুষ জীবন দিচ্ছে, আর আমি কি ঘরে বসে থাকতে পারি?' সাজানো-গোছানো, ছিমছাম, শান্ত, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন ছোট্ট শহর রাজশাহী। এই শহরের জেলা সদরের পাশেই বোয়ালিয়া থানা। আর এই থানার অন্তর্গত তালাইমারী গ্রাম। মায়াবতী পদ্মার কোলঘেঁষা স্নিগ্ধ গ্রাম তালাইমারী। এই গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক দম্পতি মো: মইনুল হক ও রোকেয়া খাতুন। এই দম্পতির ঘর আলোকিত করে, কোল জুড়ে আসে পরিবারের প্রথম সন্তান মো: সাকিব আনজুম। সেই দিনটি ছিল ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭। সাকিবের জন্মের দিনটায় এই পরিবারটা সেজেছিল রঙিন সাজে। উপচে পড়েছিল খুশির ফোয়ারা। মিষ্টি বিতরণ হয়েছিল বাড়ি বাড়ি। ব্যবসায়ী পিতা আর গৃহিণী মাতার সব স্বপ্ন যেন পূরণ হয়েছিল সাকিবের আগমনে। এরপর আদরে আহ্লাদে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা সাকিবের। পাঠশালা থেকে হাতেখড়ি পড়াশোনার। তারপর স্কুল, কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা। রাজশাহীর বিখ্যাত বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসসি বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাহিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সাকিব। বর্তমানে সাকিব ছিলেন চাকরিজীবী। ২০২০ সাল থেকে অর্গানিক কেয়ারে সেলস ডিপার্টমেন্টে কর্মরত ছিলেন। এছাড়াও তিনি তার বাবার মুদি দোকানের ব্যবসায় সাহায্য করতেন নিয়মিত। সাকিব ছিলেন বিবাহিত। তার স্ত্রী নিশাত সালসাবিল রাজশাহী কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত। সাকিবের দুই ভাইয়ের একজন মো: আকিব আনজুম। তিনি বঙ্গবন্ধু কলেজে অনার্সে অধ্যায়নরত। কনিষ্ঠ ভাই মো: আসিফ আনজুম উত্তরায় একটি মাদ্রাসায় অধ্যায়নরত। যেভাবে শহীদ হন শাকিব আনজুম শহীদ সাকিব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক লড়াকু সৈনিক। শুরু থেকেই ছিলেন এই আন্দোলনের সঙ্গে। ৫ আগস্ট ২০২৪, স্বৈরাচার পতনের দিন এবং ছাত্র জনতার গণআন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন। সেদিনও সকাল থেকে ছাত্র জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল রাজশাহী নগরী। তার নিজ এলাকা রাজশাহী নগরীর তালাইমারী মোড় থেকে হাজার হাজার ছাত্র জনতার মিছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র রায় সাহেব বাজার এলাকার দিকে রওনা হয়। সময় দুপুর ১টা ১৫ মিনিট। ছাত্রজনতার এই মিছিলে আওয়ামীলীগ নেতা ডাবলু সরকারের নেতৃত্বে গুলি বর্ষণ শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা প্রাণ বাঁচাতে দিগি¦দিক ছড়িয়ে যায়। কিছু নারী শিক্ষার্থীর উপর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এমতা অবস্থায় সাকিব আনজুম দৌড়ে গিয়ে একটা বাড়ির মধ্যে ওই নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চেষ্টা করেন। অধিকাংশ নারী বাড়ির মধ্যে চলে গেলেও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দৌড়ে এসে সাকিব আঞ্জুমকে সামনে থেকে গলার নিচের অংশে এবং বুকের বাঁ-পাশের উপরের অংশে দুটো গুলি করে। তবুও সাকিব আনজুম ওই বাড়ির মধ্যে ঢুকে যেতে চেষ্টা করলে পেছন থেকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তার কাঁধে নির্মমভাবে কোপ মারে। গুলিবিদ্ধ এবং মারাত্মক জখম অবস্থায় সাকিব ওই বাড়িতে ঢুকে গেলেও প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। আহত সাকিব আনজুমসহ অন্যান্য নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি টের পেয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী বাড়িটি অবরুদ্ধ করে রাখে। এদিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সাকিব আনজুম ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে থাকেন এবং কিছু সময় পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অদূরেই ছিল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ। কিন্তু আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনীর জন্য তাকে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে সাকিবকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন ৬ই আগস্ট বাদ জোহর এলাকায় প্রথম এবং বাদ আসর টিকাপাড়া গোরস্থানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে সেখানেই কবরস্থ করা হয় শহীদ মো: আনজুম সাকিবকে। পরিবারে শোকের মাতম সাকিবের নিহত হওয়ার খবরে তার পরিবারে নেমে আসে এক গভীর কালো শোক-ছায়া। মা বাবার বুকের ধন আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী দ্বারা নির্মমভাবে নিহত হওয়ার কথা শুনে মা রোকেয়া খাতুন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। যেন কলিজাটা ছিঁড়ে বেরিয়ে যায় তার। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে মার্কেটে গ্যাসের সিলিন্ডারে আগুন লাগে। সেখানে আমার সাকিব দৌড়ে গিয়ে আগুন নেভায়। মানুষের কোনো বিপদ দেখলে সবার আগে সে ছুটে যেত। আমি বলতাম, 'বাবা, তুমি মানুষের জন্য এত চিন্তা করো, কিন্তু আমাদের কথা ভাবো না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কী হবে?' ও আন্দোলনে যাওয়ার আগে আমি বলি, 'বাবা, যদি কোনো বিপদ হয়?' আমার সাকিব আমাকে বলে, 'মা, কত মানুষ জীবন দিচ্ছে, আর আমি কি ঘরে বসে থাকতে পারি?' কথাগুলো বলতে বলতে মা রোকেয়া বেগম অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন। তার মৃত্যুর খবরে তার পিতা মাইনুল হকের দু চোখ যেন অশ্রুনদী হয়ে যায়। বাকরুদ্ধ পিতা সন্তানের বিচ্ছেদ বেদনায় হাহাকার করতে থাকেন। তার ছোট দুই ভাইয়ের অবস্থাও ছিল অনুরূপ। প্রাণের প্রিয় বড় ভাইকে হারিয়ে তারা মনমরা হয়ে যায়। যেন তাদের হৃদয়টা ছিঁড়ে গেছে। আর প্রিয়তমা স্ত্রী! তিনি নির্বাক নিস্তব্ধ! প্রিয়তম স্বামীর শোকে তার চেহারা হয়ে গেছে মলিন। রাতে তিনি স্বামীর শোকে ঘুমাতে পারেন না। তিনি অনুভব করেন তার বুকের ভেতরটা যেন শূন্য হয়ে গেছে। স্বামীর শোকে এখনো মাঝ রাতে তিনি ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। সাকিবের স্ত্রী নিশাত সালসাবিল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ৫ আগস্ট আন্দোলনে যাওয়ার সময় ও আমাকে বলে, 'আমার নতুন জামা বের করে দাও আমি ওটা পড়েই আন্দোলনে যাব।' শহীদ সাকিব আনজুমের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ সাকিব আনজুমের পরিবার অর্থনৈতিকভাবে বেশ স্বচ্ছল। তার পরিবারে বর্তমানে প্রধান আয়ের উৎস হলেন তার বাবা মাইনুল হক। তিনি রাজশাহী শহরে একটি মুদি দোকান পরিচালনা করেন। মুদি ব্যবসা থেকে তার আয় মাসিক প্রায় ৪০,০০০ টাকা। এছাড়া রাজশাহী শহরের তালাইমারী এলাকায় তাদের তিন তলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি আছে। শহীদ সাকিবের ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : মো: সাকিব আনজুম জন্ম তারিখ : ০১.০২.১৯৯৭ শহীদ হওয়ার তাং ও সময় : ৫ই আগস্ট, ২০২৪; ২টা ৩০ মিনিট শহীদ হওয়ার স্থান : তালাইমারী, রাজশাহী সদর আঘাতের ধরন : বুকের বাঁ পাশে ও গলার নিচে গুলিবিদ্ধ এবং ধারালো অস্ত্র দ্বারা জখম হত্যাকারী : সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ সমাধিস্থল : টিকাপাড়া গোরস্থান, রাজশাহী পেশা : ছাত্র ও চাকরিজীবী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কর্মস্থান : অর্গানিক কেয়ার, রাজশাহী পিতা : মো. মাইনুল হক মাতা : রোকেয়া খাতুন স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম-তালাইমারী, ইউনিয়ন-রাজশাহী সদর , থানা-বোয়ালিয়া, জেলা-রাজশাহী বাড়িঘর ও সম্পদ : নিজেদের তিনতলা একটি বাড়ি। পিতার মুদি ব্যবসা স্ত্রী : নিশাত সালসাবিল। রাজশাহী কলেজে স্নাতকোত্তরে অধ্যায়নরত ভাইবোন : ২ ভাই। আকিব আনজুম ও আসিফ আনজুম। উভয়েই ছাত্র শহীদ পরিবারের জন্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ১. নিয়মিত শহীদ পরিবারের খোঁজখবর নেওয়া