জন্ম তারিখ: ১৪ জানুয়ারি, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রাজশাহী
পেশা : ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবী , শাহাদাতের স্থান : খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
পুলিশ গুলি ছুড়তে শুরু করলে আমরা একসাথে দৌড় দেই, কিন্তু পেছনে তাকিয়ে দেখি ও পড়ে গেছে, চোখগুলো উল্টানো, এদিকে পুলিশ গুলি ছুড়ছে তো ছুড়ছেই। এর মধ্যেই ওকে ৩-৪ জন ধরে সাইডে নিয়ে যায়, চোখের সামনে এই ছটফটানি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না ” - শহীদের বন্ধু আহমেদ সাদ শহীদ মো: শিহাব আহমেদ সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামে ১৪ই জানুয়ারি ২০০৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সফি মিয়া(৪৫) মালয়েশিয়া প্রবাসী, মাতা: মোছা: শাহনাজ খাতুন (৪৫) গৃহিণী। শহীদ শিহাব সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে কাজ করতেন এবং স্থানীয় একটি ব্লাড ব্যাংকের অন্যতম সদস্য ছিলেন। এনায়েতপুরের মাধবপুর গ্রামে শৈশব থেকে কৈশোর কেটেছে শহীদ শিহাবের। ক্রিকেট ছিল তার পছন্দের খেলা। বিকেল হলেই বল আর ব্যাট হাতে ছুটে যেতেন মাঠে। মিশুক ও মিষ্টিভাষী শিহাব যেকোনো মানুষের সাথেই সহজে মিশে যেতে পারতেন। সমাজের মানুষের প্রতিও ছিল বিশেষ দায়বদ্ধতা। রক্তদানকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথে যুক্ত শহীদ শিহাব কোনো মানুষের রক্তের প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো ভাবে রক্তের ব্যবস্থা করে দিতেন। অন্যায় ও জুলুমের প্রতি তীব্র ঘৃণা লালনকারী শহীদ শিহাব চোখের সামনে অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করতেন। প্রবাসী বাবার সঙ্গে ছোটকাল থেকে তেমন কোনো দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও বাবার প্রতি ছিল তীব্র ভালোবাসা। শাহাদতের প্রেক্ষাপট রক্তাক্ত জুলাই, প্রেরণার জুলাই, দ্বিতীয় স্বাধীনতার বিজয়ের মাস জুলাই। এই জুলাই মাসেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। অবৈধ দখলদার ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে এ দেশের মানুষ এক কাতারে সমবেত হয়। সর্বত্র দাবি ওঠে হটাও স্বৈরাচার বাঁচাও দেশ। স্বৈরাচার হাসিনার পতনের এক দফা দাবি ওঠে। এক দফার দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র বাংলাদেশ। এ দাবি শহর থেকে শহরে এবং গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন দমাতে মরিয়া স্বৈরাচার সরকার গুলি করে পাখির মত একের পর এক মানুষ মারতে থাকে। মানুষ আরো আন্দোলনমুখী হয়ে পড়ে। ৪ আগস্ট শহীদ শিহাব আহমেদ হাসপাতালে যাচ্ছেন একজন মানুষকে রক্ত দিতে । এমন মিথ্যা কথা বলে আন্দোলনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। দুপুর ১২টার সময়ও মায়ের সঙ্গে কথা হয়। মাকে বলেন, আমি হাসপাতালে আছি পরে কথা বলব। দুপুর দেড়টার দিকে এনায়েতপুর থানার সামনে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি শুরু করে। একটি গুলি শহীদ শিহাবের ডান পাঁজরে আঘাত হানে। সাথে সাথে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ভ্যানে তুললে ভ্যানেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তারপরেও আন্দোলনকারীরা তাকে স্থানীয় খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শাহাদাতের পর বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতিক্রিয়া শহীদ শিহাব আহমেদের বন্ধু আহমেদ সাদ বলেন, শত চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারিনি। ও আমার জুনিয়র হলেও সম্পর্কটা বন্ধুর মতই ছিল। অহংকারহীন মানুষদের মধ্যে আমি ওকে সবার উপরেই রাখবো। মারা যাওয়ার দশ মিনিট আগেও বিস্কুট নিয়ে কাড়াকাড়ি করলাম, থানার সামনে দাঁড়িয়ে ওর আম্মুর ফোনে মিথ্যা বলল যে, আমি আন্দোলনে যাইনি, খাজা হাসপাতালে আছি। একজনের রক্ত লাগবে, ম্যানেজ করতে হবে। এটাই ছিল ওর আম্মুর সাথে ওর লাস্ট কথা। হঠাৎ করে পুলিশ গুলি ছুড়তে শুরু করলে একসাথে দৌড় দিই কিন্তু পেছন ফিরে দেখি ও পড়ে আছে। চোখগুলো উল্টানো। এদিকে পুলিশ গুলি ছুড়ছে তো ছুঁড়ছে। এরই মধ্যে ওকে ৩-৪ জন ধরে সাইডে নিয়ে যায়। চোখের সামনে এই ছটফটানি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ভ্যানে তুললেই ও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। মুখ ফ্যাকাসে হলুদ। শরীরে স্পন্দন নেই বোঝার পরও নিজেকে বোঝাচ্ছি ও হয়তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। ওর জানাযা বা দাফনও করতে পারিনি। শত ভুলে থাকার চেষ্টা করেও এখনো রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। ও সরল একটা ছেলে ছিল। তার জন্য হয়তো আল্লাহ ওকে বেছে নিয়েছে শহীদ হিসেবে।" শহীদের ভাই মো: হাসান বলেন "আমার ভাই আমাকে খুব ভালোবাসতো, আদর করত। সে যখন খেত, তখন আমাকে তার সাথে খাওয়ার জন্য ডাকতো। বাইরে থেকে এসে আমাকে আগে ডাকতো। আমার পড়াশোনার খোঁজখবর নিত। এখন আমার ভাইয়ের কথা অনেক বেশি মনে পড়ে, আমি ঠিকমতো এখন রাতে ঘুমাতে পারি না। শহীদের পরিবার সংক্রান্ত বিশেষ তথ্য শহীদের পিতা শফিউদ্দিন একজন মালয়েশিয়া প্রবাসী। শহীদ শিহাবের ছোট দুই ভাই জমজ। একজন মোঃ হাসান ও অপরজন মোঃ হোসাইন। একজন ক্লাস সিক্সে অন্যজন নূরানী মাদ্রাসায় পড়ে। অর্থনৈতিকভাবে শহীদের পরিবার মোটামুটি স্বচ্ছল। ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : শিহাব আহমেদ পিতার নাম : সফি মিয়া (৪৫) মাতার নাম : মোছা: শাহনাজ খাতুন (৪০) জন্ম তারিখ : ১৪ জানুয়ারি ২০০৫ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মাধবপুর, ইউনিয়ন: এনায়েতপুর, থানা: এনায়েতপুর, জেলা: সিরাজগঞ্জ বর্তমান ঠিকানা : মাধবপুর, এনায়েতপুর, সিরাজগঞ্জ আহত হওয়ার স্থান : এনায়েতপুর থানার সামনে, সিরাজগঞ্জ আহত হওয়ার সময় কাল : ৪ আগস্ট, ২০২৪, দুপুর ১টা ৩০ মিনিট শহীদ হওয়ার সময় ও স্থান : ৪ আগস্ট, ২০২৪, দুপুর ২টা, এনায়েতপুর থানার সামনে, সিরাজগঞ্জ যাদের আঘাতে শহীদ : পুলিশের গুলিতে শহীদ শিহাব সাহস ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশের মুক্তির সংগ্রামে একটা উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করে গেছেন। তার জীবন ও মৃত্যুর স্মৃতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে।