জন্ম তারিখ: ২১ নভেম্বর, ১৯৭৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রাজশাহী
পেশা :ব্যবসা, শাহাদাতের স্থান :জান্নাতি প্যালেস (অত্যাচারী এমপি শিমুলের বাসভবন), নাটোর সদর।
দেখো, তোমার ছেলেকে কালকে যারা মেরেছে, আজ তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে” শহীদ শরিফুল ইসলাম (মোহন) নাটোর জেলার সদর উপজেলার উত্তর বড়গাছা গ্রামে ২১ নভেম্বর ১৯৭৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোঃ আব্দুল মজিদ। মায়ের নাম মোসা: সফুরা বেগম। তার পিতামাতা বর্তমানে বয়োবৃদ্ধ। শহীদ শরিফুল ইসলাম মোহনেরা ২ ভাই, ২ বোন। ৪ ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন বড়। তার ছোট ভাই সেলিম মাসুম (৪২) পেশায় চাউল ব্যবসায়ী। তার ২ বোন মোছা. ময়না বেগম (৩০) ও মোছা. মিতা বেগম (২৫) বিবাহিতা। শহীদ শরিফুল ইসলাম মোহন ছিলেন বিবাহিত। তার স্ত্রীর নাম জান্নাতুল ফেরদৌসী। পেশায় তিনি গৃহিণী। ফারহান ফুয়াদ নামের ১৬ বছর বয়সী একাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া একটি পুত্র সন্তান আছে তার। পুত্র ফুয়াদ আগাগোড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাথে সম্পৃক্ত ছিল। শহীদ শরিফুল ইসলাম (মোহন) ওয়ার্কশপের ব্যবসা করতেন। নাটোর সদরে 'ফুয়াদ এসএস মেটাল' নামের একটি ওয়ার্কশপের দোকান আছে তার। দোকানটি ভাড়া নেওয়া। এই দোকান থেকে যে আয় আসতো, তা দিয়েই চলত তার সংসার এবং ছেলের পড়াশোনার খরচ। যেভাবে শহীদ হন তিনি জান্নাতি প্যালেস। নাটোরের এক আলোচিত নাম। নাটোর সদরের অত্যাচারী এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের ব্যয়বহুল বাড়ি এটি। সাধারণ জনতার প্রবেশ অধিকার নিষিদ্ধ ছিল এই বাড়িতে। ৫ আগস্ট ২০২৪। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। শহরের কানাইখালী পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান নেয় হাজারো মানুষ। সেদিন বিকেল ৩টার পর থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মূল সড়কে ছাত্র-জনতার খণ্ডখণ্ড মিছিল বের হয়। ছাত্র-জনতা বিজয় মিছিল থেকে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়া নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। অনেককে মিষ্টি বিতরণ করতেও দেখা যায়। এসময় সেনা সদস্যদের সঙ্গে আলিঙ্গন করতেও দেখা যায় ছাত্রজনতাকে। সেদিন নাটোরের অধিকাংশ মানুষের গন্তব্য ছিল অত্যাচারী এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাসা জান্নাতি প্যালেস। এমপি শিমুল পালিয়ে গেলে হাজার হাজার জনতা তার জান্নাতি প্যালেস দেখার জন্য উপস্থিত হয়। সে উদ্দেশ্যে মোহনও উপস্থিত হয় সেই আলোচিত-সমালোচিত জান্নাতি প্যালেসে। বিকেল ৪টার দিকে এমপি শিমুলের সেই বাসভবন জান্নাতি প্যালেসে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধরা। বাসার নিচতলায় আগুন লাগলে যে যার মতো উপর থেকে নামার চেষ্টা করে। কিন্তু একটা রুমে অটো লক থাকার কারণে মোহনসহ কয়েকজন আটকে যায় সেই রুমে। অনেক চেষ্টা করেও বের হতে পারে না। আগুন ছড়িয়ে যায় চারিদিকে। একটা সময় রুমের সবাই নিস্তেজ হয়ে যায়। অতঃপর আগুনে পুড়ে মারা যায় মোহনসহ সকলে। এদিকে মাগরিবের আজান হয়ে গিয়েছে, মোহন এখনো বাড়িতে আসছে না, ফোনও বন্ধ! বাড়ির সবাই অনেক চিন্তিত। মোহনের বড় ভাই অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছে, সেদিন সারারাত তারা মোহনকে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেছে। পরদিন ৬ আগস্ট উৎসুক জনতা আবারো জড়ো হয় এমপি শিমুলের পোড়া বাড়ি জান্নাতি প্যালেসের সামনে। তখন তারা হঠাৎ একটি পোড়ালাশ দেখতে পায়। ভেতরে ঢোকার পর পাওয়া যায় একে একে আরো ৩টি লাশ। যার মধ্যে মোহন অন্যতম এভাবেই শহীদ শরিফুল ইসলাম মোহনকে খুঁজে পায় তার পরিবার। আরো কিছু কথা এক ছেলের জনক ৪৫ বছর বয়সি শরিফুল ইসলাম মোহন একটি দোকান ভাড়া নিয়ে নিজেই ওয়ার্কশপের কাজ করতেন। স্ত্রী সন্তান নিয়ে মোহন একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। সামান্য আয় রোজগার দিয়ে চলে যাচ্ছিল তাদের সংসার। একটু একটু করে ছেলেটাও বড় হয়েছে। পড়াশোনা করছে একাদশ শ্রেণিতে। খরচও বাড়ছে। তাই মোহনের ইচ্ছে ছিল বিদেশ গিয়ে ইনকাম করে সংসারের সচ্ছলতা আনা। এরই মধ্যে দেশে শুরু হয় ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। মোহনের ১৬ বছর বয়সি ছেলেও আন্দোলনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করত। ৪ আগস্ট আন্দোলনে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মোহনের ছেলেকে মারধর করে। পরদিন শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে গেলে মোহন রিকশায় করে আনন্দ মিছিলে যায়। যাওয়ার আগে মোহন তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসীকে বলেন, "দেখো, তোমার ছেলেকে কালকে যারা মেরেছে, আজ তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে।" দিকে দিকে আনন্দ মিছিল! আকাশে বাতাসে মুক্ত পাখির ঝাপাঝাপি। মোহনেরও মনে হয়েছিল, সেও যেন এক মুক্ত পাখি। তাইতো আনন্দ মিছিলে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার সেই বেরোনোটা যে শেষ বেরোনো, তা কি ভেবেছিল কেউ? মুক্ত পাখি হয়ে মোহন আকাশে ডানা মেলেছিল ঠিকই, কিন্তু আর ফিরে আসেনি নিড়ে। ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাস! মোহনকে হারিয়ে তার পরিবার পড়েছে এক মহাসংকটে। স্বামীহারা শোকাহত স্ত্রী, পিতৃহারা এতিম সন্তান! তাদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। তাদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো ভাষা যেন কারো নেই। স্বামী ফিরে আসার, বাবা ফিরে আসার পথের দিকে তারা কেবলই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়।নিজস্ব আবাদযোগ্য জমিজমা নেই শরিফুলের। তিনিই ছিলেন পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস ব্যক্তি। তার শহীদ হওয়ার পর পরিবারের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে পুরোপুরি। ফলে তার স্ত্রী এবং সন্তান এখন চরম অসহায় আর নিঃস্ব! শহীদ শরিফুল ইসলাম মোহনের ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : মো. শরিফুল ইসলাম মোহন জন্ম তারিখ : ২১.১১.১৯৭৯ শহীদ হওয়ার তাং ও সময় : ৫ আগস্ট, ২০২৪; বিকাল ৪টা শহীদ হওয়ার স্থান : জান্নাতি প্যালেস (অত্যাচারী এমপি শিমুলের বাসভবন), নাটোর সদর আঘাতের ধরন : আগুনে পোড়া আগুনদাতা : অজ্ঞাত সমাধিস্থল : বড় গাছা গোরস্থান, নাটোর পেশা : ব্যবসা পিতা : মো. আব্দুল মজিদ মাতা : মোছা. সফুরা বেগম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: উত্তর বড়গাছা, জেলা: নাটোর বাড়িঘর ও সম্পদ : নিজস্ব বাড়ি নেই, আবাদযোগ্য জমি জমা নেই স্ত্রী-সন্তান : স্ত্রী মোছা. জান্নাতুল ফেরদৌসী, বয়স: ৪০, গৃহিণী, এইচএসসি পাশ ১ ছেলে: ফারহান ফুয়াদ, বয়স ১৬ বছর শহীদ পরিবারের জন্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ১. আর্থিক সহায়তা দিয়ে শহীদ মোহনের ওয়ার্কশপটা পুনরায় চালু করে দেওয়া ২. সন্তানের পড়াশোনার দায়িত্ব নেওয়া