জন্ম তারিখ: ১ মে, ২০১২
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা : ছাত্র, বিভাগ: হিফজুল কোরআন, জামিয়া মাদানিয়া বাইতুস সুজুদ মাদরাসা শাহাদাতের স্থান : সাইনবোর্ড, নারায়নগঞ্জ, ঢাকা
"নামাজে দাঁড়িয়েছে মা, ইব্রাহীমের আন্দোলনে যেতে আর বাঁধা রইলো না।" জন্ম ও শৈশব শহীদ মো: ইব্রাহিম খলিল ২০১২ সালের মে মাসের ১ তারিখে ঢাকা জেলার অন্তর্গত ডেমরা থানার মাতুয়াইল এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হানিফ মিয়া ও মাতার নাম ছখিনা বিবি। শৈশবটা খুব বেশি সুখকর ছিল না তার। ইব্রাহিমের যখন মাত্র ছয় মাস বয়স, সে সময় তার ৬ বছর বয়সী বড় ভাই ও মাকে ফেলে বাবা চলে যান অন্যত্র। পরবর্তীতে আর কখনও তিনি পরিবারের খোঁজখবর নেননি। ইব্রাহিমের জীবনের গল্প তখন থেকেই অপ্রাপ্তি, দুঃখ-কষ্ট ও লড়াই সংগ্রামে থরেথরে সাঁজানো। তাই একেবারে ছোট থেকেই পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত সে। এ অভাব পূরণ করতে শহীদের মা ছখিনা বিবি যারপরনাই চেষ্টা করে গিয়েছেন। সুখ কি তবে অধরাই ছখিনা বিবিদের জীবনে? দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রামে জন্ম ছখিনা বিবির। দরিদ্র কৃষক পিতা, মা আর পাঁচ সহোদর ভাইবোনের বড় সংসার। সিদ্ধান্ত নিলেন দরিদ্র পরিবারটিকে সহযোগিতা করার। খালাতো বোন আসমার সাথে চলে আসলেন রাজধানী ঢাকায়। শুরু হলো কিশোরী ছখিনার গৃহ পরিচারিকার কাজ। ধানমন্ডির একটি বাসায় একটানা পাঁচ বছর কাজ করে গেলেন। একপর্যায়ে পরিচয় হানিফ মিয়ার সাথে, বাধলেন জুটি। বিয়ে পরবর্তী অনেকটা সময় নিঃসন্তান থাকলেও একটা সময় জন্ম নিলেন শহীদের বড় ভাই ইয়াকুব আলী। আর তার ঠিক সাড়ে ৫ বছর পর জন্ম হলো ইব্রাহিমের। সহীদের জন্মের ছয় মাস পর তিন সদস্যের এই পরিবারকে মাঝ দরিয়ায় ফেলে নিরুদ্দেশ পাষাণ পিতা। ছোট্ট দুই সন্তানকে নিয়ে ছখিনা বিবির শুরু হলো আরেক জীবন যুদ্ধ! খেয়ে না খেয়ে বড় করতে লাগলেন নিজের জীবনের চেয়েও প্রিয় দুই সন্তানকে। ব্যক্তিগত জীবনে ছখিনা বিবি বেশ ধর্মীয় অনুভূতি সম্পন্ন একজন মানুষ। তাই নিজের দুই সন্তানের মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণের জন্য সচেষ্ট ছিলেন তিনি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "জীবনে বহুত কষ্ট করছি। আমি জানি এ কষ্ট থাইকা একমাত্র আল্লাহ আমারে উদ্ধার করতে পারবো। তাই আমার দুই পোলারে মাদ্রাসায় দিছিলাম, যাতে এর উসিলা কইরা হলেও আল্লাহ আমার সব দুঃখ-কষ্ট শেষ করেন।" কি চমৎকার অভিব্যক্তি! কি দৃঢ় বিশ্বাস মহান আল্লাহর প্রতি! শহীদ ইব্রাহিম ও তার বড় ভাই ইয়াকুব আলী দুজনেই মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। ইয়াকুব আলী হিফজ শেষ করার পর আরও পড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। তবে পরবর্তীতে পারিবারিক টানাপোড়নে আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ছোট ভাই ইব্রাহিমের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিলেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে গুলিস্তানের একটি কাপড়ের দোকানে কাজ শুরু করেন তিনি। এদিকে শহীদ ইব্রাহিম ডেমরার জামিয়া মাদানিয়া বাইতুস সুজুদ মাদ্রাসায় কুরআনের হিফয্ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ইতোমধ্যে কুরআনের প্রায় ৬ পারার হিফজ সম্পন্ন হয়েছিল তার। এ সংসারের বটবৃক্ষ মা ছখিনা বিবি বিয়ের প্রায় ১৯ বছর পর সদ্য ভূমিষ্ঠ ইব্রাহিম ও ছয় বছরের ছোট্ট ইয়াকুব আলীকে ফেলে যখন তাদের পাষাণ পিতা নিরুদ্দেশ, তখন এই দুই সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা ছখিনা বিবি। উপায়ান্তর না করতে পেরে আবার শুরু করতে হয় জীবনের বিরাট অংশে করে আসা সেই গৃহপরিচারিকার কাজ। এভাবেই শত অভাব অনটনের মধ্যেও বড় করতে লাগলেন নিজের দুই স্বপ্ন, দুই সন্তানকে। ঢাকায় অবস্থানের ২৫ বছরের প্রায় পুরোটাই অন্যের বাসা বাড়িতে কাজ করতে হয়েছে ছখিনা বিবিকে। সর্বশেষ, তিনটি বাড়িতে কাজের পাশাপাশি একটি মেসে রান্নার কাজ করতেন তিনি। সেখান থেকে আয় হওয়া অল্প কিছু টাকার মধ্যে ৬০০০ টাকা দিতে হতো বাসা ভাড়া বাবদ। জীবন সংগ্রাম চলছিল এভাবেই। তবে মায়ের বিভিন্ন রোগ আর কষ্টের কথা চিন্তা করে জীবনের একপর্যায়ে এসে পড়াশোনা ছাড়তে হয় ইয়াকুব আলীকে। পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ ও ছোট ভাই ইব্রাহিমের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য গত ২০২২ সাল থেকে গুলিস্তানের একটি কাপড়ের দোকানে খাবার আর অসামান্য কিছু হাত খরচের চুক্তিতে কাজ করে চলছেন তিনি। জেগে উঠলো ছাত্র জনতা, সঙ্গী শহীদ ইব্রাহিম প্রায় দেড় যুগের আওয়ামী দুঃশাসনের পুরোটাই বিভীষিকাময়। শান্তি ছিল কই? বিরোধী মতের মানুষগুলোকে হত্যা, গুম তো পুরনো ব্যাপার। চারিদিকে মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি, বাজারে অব্যবস্থাপনা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে তখন সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস। ছোট্ট এই জীবনে যার পুরোটাই পরখ করেছে ইব্রাহিম। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জনগণ এবার শামিল হয় ছাত্রদের যৌক্তিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে। চলতি বছরের ৫ জুন সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পুরোনো পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় আদালত। নতুন করে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন, শুরু থেকেই নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর হায়নার মতো ঝাপিয়ে পড়ে সরকারের পালিত ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সন্ত্রাসীরা আর পুলিশ। জুলাইয়ের ১৬ তারিখে শহীদ হলেন রংপুরের আবু সাঈদ, চট্টগ্রামের ফয়সাল মাহমুদ শান্ত, ওয়াসিম আকরামসহ আরো বেশ কয়েকজন। এবার আন্দোলন তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হলো। দেশের অপরপ্রান্তে থাকা নিরস্ত্র ভাইকে হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলনে অংশ নেন কিশোর ইব্রাহিম। কিশোর ইব্রাহীমের শহীদ হওয়ার গল্প ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, সেদিন সকাল থেকেই সাইনবোর্ড এলাকায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি। জুম্মার সালাত আদায় করে একবার বাসায় যায় ইব্রাহিম। দরজার আড়াল থেকে দেখে মা ভিতরে নামাজ আদায় করছেন। তাকে আর ঠেকায় কে? চলে যান আন্দোলনে অংশ নিতে। ১৬ তারিখ পরবর্তী সারা দেশের সকল ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সেদিন তীব্র আন্দোলন চলছিল সাইনবোর্ড এলাকায়। উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে মারমুখী পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাঁধে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট আর গুলির বিপরীতে ছাত্র-জনতা পালিয়ে না গিয়ে আরো সঙ্ঘবদ্ধ হয়। প্রতিবাদ জারি রাখে। পুলিশের সাথে যোগ দেয় বিজিবি। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে দমাতে থেমে থাকেনি সীমন্তরক্ষী বিজিবি। বিজিবির নিয়োগ দেখে বিস্মিত হলেও আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ চালিয়ে গেছেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বেশ অতর্কিতভাবেই ছাত্র জনতার ওপর যৌথ আক্রমণ শুরু করে পুলিশ, বিজিবি। তখন বিকাল আনুমানিক ৪টা, একটি বুলেট এসে লাগে ইব্রাহিমের ডান কানের নিচে, লুটিয়ে পড়েন তিনি। মুখের ডান পাশ থেকে ছিটে আসা রক্তের ফিনকি আর অসংখ্য ছররা বুলেটের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় ১৩ বছর বয়সী ইব্রাহিমের মুখ। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ততক্ষণে দুনিয়ার সফর শেষ করেছেন ছোট্ট ইব্রাহিম। আসর নামাজের ঠিক পর পর ইব্রাহিম এর কাছে থাকা ফোন থেকে খবর দেয়া হয় বাড়িতে। শুরু হয় তার মা আর একমাত্র ভাইয়ের শোকের মাতম। মুহূর্তেই পাল্টে গেল হাজী বাদশা মিয়া রোডের পুরো মহল্লার চিত্র। নিস্তব্ধ হয়ে যায় সবাই। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ যায় পরিবারের সাথে শহীদ ইব্রাহিমের লাশ আনতে। শহীদ ইব্রাহিম সম্পর্কে সহপাঠী ও এলাকাবাসীর অনুভূতি শহীদ ইব্রাহিমের সহপাঠীরা বলে,“ইব্রাহিম ছিল খুব ভালো মনের একজন। সে সব সময় সবার উপকার করত। একই সাথে সে প্রচন্ড মেধাবী ও ধার্মিক ছিল।” তার নিকট প্রতিবেশী ও বাড়িওয়ালা শামীম মিঞা বলেন,“সকলের খুবই প্রিয় ছিল ইব্রাহিম। সে ছোট থেকেই খুব শান্ত স্বভাবের। তাকে নিয়ে পরিবারের পাশাপাশি আমাদেরও স্বপ্ন ছিল যে, একদিন সে বড় আলেম হবে। দেশ ও দশের জন্য কাজ করবে। হাল ধরবে এই অসহায় পরিবারের।” এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য শহীদের পূর্ণনাম : শহীদ মো: ইব্রাহিম খলিল জন্ম তারিখ : ০১ মে ২০১২ পেশা : ছাত্র (হিফজ মাদ্রাসা) পিতার নাম : মো: হানিফ মিয়া মাতার নাম : ছখিনা বিবি মাতার পেশা : অন্যের বাসা বাড়িতে কাজ পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৩ পরিবারের মাসিক আয় : ৯০০০ (মাতার আয় পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস) সহোদর নাম : মো: ইয়াকুব আলী, বয়স: ২০ বছর পেশা : কাপড়ের দোকানের কর্মচারী বর্তমান ঠিকানা : হাজী বাদশা মিয়া রোড, থানা: ডেমরা, জেলা: ঢাকা পরিবারটির সহযোগিতা প্রসঙ্গে ১. শহীদের বড় ভাইয়ের একটি চাকরির বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে ২. পরিবারটি দীর্ঘ ২৫ বছর ভাড়া বাসায় থাকে, তাদের একটি বাসস্থানের খুব প্রয়োজন ৩. নিয়মিত আর্থিক সহায়তা করা যেতে পারে