জন্ম তারিখ: ২৬ নভেম্বর, ১৯৯৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রাজশাহী
পেশা : গার্মেন্টস কর্মী, শাহাদাতের স্থান :এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
০৫ আগস্ট, ২৪। সকাল ১১টায় মো: সোহেল রানা ও তার মেসের সদস্য রাসেল ও হিমেল সাভার আশুলিয়ায় তাদের মেসের নিচে দেশব্যাপী চলমান স্বৈরাচারী সরকার বিরোধী আন্দোলনে যায়। ছাত্র-জনতার সে আন্দোলনে ঘাতক পুলিশ হামলা চালায় এবং নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে অবশেষে স্বৈরাচারী হাসিনা পদত্যাগ করে ভারত পালিয়ে গেলে, সারাদেশে বাধভাঙ্গা আনন্দের বন্যা বয়ে যায়, অলিতে গলিতে মিষ্টি বিতরনের ধুম পড়ে, ছাত্র-জনতা বিজয় মিছিল বের করে। হাসিনা পালিয়ে গেলেও বিগত ১৫ বছর যাবত আওয়ামী সরকারের চালানো জুলুম নির্যাতনের একান্ত সহযোগী পুলিশ বাহিনী তখনও সারা দেশের পুলিশ ফাড়িগুলোতে বিদ্যমান। আওয়ামী রেজিমের পতন ঘটলে তাবেদার পুলিশ বাহিনী বুঝতে পারে তাদেরও এদেশ ছেড়ে পালাতে হবে নতুবা জালিম হিসেবে মজলুমের কাঠগড়ায় বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু এর কোনোটাই করতে তারা প্রস্তুত ছিলনা। দীর্ঘ প্রায় দেড়যুগের আরাম আয়েশের জীবন, ক্ষমতার যথেচ্ছা ব্যবহার, অবৈধ টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠা ব্যাংক ব্যালেন্স এসব কিছু হঠাৎ করেই হারানোর চিন্তা তাদের দিশেহারা করে দেয়। দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত আশ্রয় দেওয়া ঠকবাজ হাসিনা সরকারের পলায়ন তারা মেনে নিতে পারে না, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় মুক্তিকামী জনতার বিজয় মিছিলে। এমনকি সেনাসদস্যরা তাদের নিবৃত করতে এলে তাদের উপরও গুলি ছোঁড়ে। স্বৈরাচার সরকার হাসিনার পতন হলে আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতার আনন্দ মিছিলের উপর পুলিশ টিয়ারশেল ও গুলিবর্ষণ করতে থাকে। হতাহত হয় বহু মানুষ। সন্ধ্যা ৬:০০টা। সোহেল রানা বিজয় মিছিল শেষ করে বাসায় এসেছেন কিছু আগে। বাইরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত, গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে। বেশ কিছু জায়গায় পুলিশ এবং আওয়ামীলীগ মিছিলে হামলা করেছে, হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। মেসের ৫ম তলার জালানা খুলে পরিস্থিতি দেখার চেষ্টা করেন মো: সোহেল রানা। তারপর জানালার পিছনে ঘুরে দাঁড়ালে হঠাৎ মনে হয় কোমড়ের পেছনটায় কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিয়েছে। প্রচন্ড ব্যথায় কুঁকড়ে যান সোহেল। হঠাৎ দেখেন নাভীর নিচে ডান পাশটায় একটা ফূটো, গলগল করে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত। লাল হয়ে যাচ্ছে পরনের কাপড় ও আশপাশ। বুঝলেন ৫ তলার জানালা ভেদ করে একটি গুলি এসে তার কোমরের পেছনের অংশ দিয়ে প্রবেশ করে নাভির নিচের ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। চিৎকার করে মেসের অন্য সঙ্গীদের ডাকেন। তারপর মেসের বাকি সদস্যরা তাৎক্ষনিক একটি গামছা দিয়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সাভারে ৩টি হাসপাতাল ঘুরে অবশেষে মুমূর্ষু অবস্থায় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় মো: সোহেল রানাকে। এর মধ্যে সাভারে অবস্থানরত সোহেল রানার চাচার পরিবারকে জানানো হলে তার চাচি আনোয়ারা বেগম দ্রুত হাসপাতালে চলে আসেন। গ্রামের বাড়িতে তার পরিবারকেও জানানো হয়। তখন সোহেল রানার বড় ভাই চাচিকে বলেন, টাকা পয়সার কথা চিন্তা না করে চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। এরপর রাত ৯:০০ বাজে কর্তব্যরত ডাক্তাররা মৃত ঘোষনা করেন মো: সোহেল রানাকে। রাত ১২:০০ টা বাজে ১৭০০০/- টাকায় একটি মাইক্রো ভাড়া করে মরদেহ তার নিজ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। জানাজা ও দাফন পরদিন জানাজা সম্পন্ন করে নাটোরের সিংড়া থানার শোয়াইড় কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয় শহীদ মো: সোহেল রানাকে। তার মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের অনুভুতি বাবা মো: মতলেব আলি প্রামানিক বলেন, আমার ছেলেকে আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দান করেছেন। আমি নিজ হাতে তাকে কবরে নামিয়েছি, তার জানাজা পড়িয়েছি। একটা বাবার জন্য তা কতটা কষ্টের সেটা তো বলে বোঝানো যাবে না। আমার তো আয়-রোজগার তেমন নেই, ছেলে টাকা পয়সা দিয়ে আমাকে সাহায্য করতো। ওর ছোট বোনের পড়াশোনার খরচও দিত। মা মোসা: রেহেনা বেগম কিছুতেই ভুলতে পারছেন না ছেলে হারানোর বেদনা। তিনি বলেন, আমি ছেলেকে দুপুরে ফোন দিয়েছিলাম। সে সময় ও কথা বলতে পারে নাই, বলসে মা এখানে অনেক ঝামেলা হচ্ছে আমি তোমাকে পরে ফোন দিব। এরপর আমি আমার ছেলের সাথে আর কথা বলতে পারি নাই। ও যে রাতের বেলা মারা গেসে তাও কেউ আমাকে বলে নাই। আমি সারা রাত কান্না করে কাটিয়েছি, পরে সকাল বেলা দেখি আমার ছেলের লাশ আসছে বাড়িতে। আমার ছেলে কোরবানি ঈদের ছুটিতেও বাড়িতে আসতে পারে নাই। ও আমাকে বলছে, মা এখন আসলে বেশী দিন ছুটি পাবো না, কিন্তু পরে আসলে বেশী দিন ছুটি কাটাতে পারবো। আগস্টের ১০ তারিখে আমার ছেলের বাড়ি আসার কথা ছিল। কিন্তু ৫ তারিখেই আমার ছেলে লাশ হয়ে ফিরল। শহীদের ভাই সাদ্দাম বলেন, ‘আমাদের দুই ভায়ের মধ্যে অনেক বেশী মিল ছিল। ও আমার বয়সে ছোট হলেও সংসারের প্রয়োজনে যখন যা চেয়েছি ওর কাছ থেকে কোনো দিনই না করে নাই। আমাদের যে কি পরিমাণ সম্মান করতো তা বলে বোঝাতে পারবো না।‘ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার বিস্তারিত বিবরণ কৃষিই বর্তমানে পরিবারটির একমাত্র আয়ের উৎস। বাবা এবং বড় ভাই কৃষিকাজ করেন। প্রতি মাসে আনুমানিক ২০-২২ হাজার টাকা আয় হয়। যা দিয়ে ছোট বোন মিম খাতুনের পড়াশোনা সহ সংসারের যাবতীয় খরচ পরিচালিত হয়। নিজস্ব সোয়া বিঘা জমি ও কিছু জমি বর্গা নিয়ে তারা চাষাবাদ করেন। জন্ম ও বেড়ে উঠা নাটোর জেলার সিংড়া থানার বালাল পাড়া গ্রামে মো: মতলেব আলি প্রামানিক ও মোসা: রেহেনা বেগমের ঘরে জন্ম গ্রহণ করে মো: সোহেল রানা। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তার অবস্থান দ্বিতীয়। বাবা মো: মতলেব আলি কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। সোহেল রানা গ্রামের হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। এরপর ইনন্সিটিউট অফ ইনফরমেশন টেকনোলজি, নওগাঁ থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। দরিদ্র কৃষক মো: মতলেব আলির স্বল্প আয়ে সংসারের সকল খরচ বহন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। তাই সংসারের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে, পড়াশোনা ছেড়ে চাকরির জন্য ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান তিনি। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে সাভারের নরবান গার্মেন্টসে যোগদান করেন তিনি। সেখানে ৬ বছর চাকরি করেন। তারপর ২০২৩ সালে তিনি বেক্সিমকো গার্মেন্টসে এমব্রয়ডারি সুপারভাইজার হিসেবে যোগদান করেন। ধীরে ধীরে পরিবারের সচ্ছলতা ফিরে আসতে থাকে। একনজরে শহীদ সোহেল রানা নাম : মো: সোহেল রানা জন্ম তারিখ : ২৬-১১-১৯৯৮ পিতা : মো: মতলেব আলি প্রামানিক মাতা : মোসা: রেহেনা বেগম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: শোয়াইড় (বালাল), ইউনিয়ন: রামানন্দ খাজুরিয়া, থানা: সিংড়া, জেলা: নাটোর বৈবাহিক অবস্থা : অবিবাহিত পেশা : গার্মেন্টস কর্মী ঘটনার স্থান : বাইপাইল, আশুলিয়া আহত হওয়ার সময়কাল : ০৫/০৮/২৪ সন্ধ্যা ৬:০০টা শাহাদাতের সময়কাল : ০৫/০৮/২৪, রাত ০৯:০২ মিনিট,এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আঘাতের ধরন : গুলি কোমরের পেছনের অংশ দিয়ে প্রবেশ করে নাভির নিচের ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে যায় আক্রমণকারী : স্বৈরাচারী সরকারের ঘাতক পুলিশ শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : শোয়াইড় কেন্দ্রীয় কবরস্থান, সিংড়া, নাটোর প্রস্তাবনা ১. শহীদের বড় ভাই আব্দুল্লাহ (সাদ্দাম) এর জন্য একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া ২. ছোটবোনের পড়াশোনার খরচ বহন করা ৩. শহীদের পরিবারেরে জন্য এককালীন অনুদান প্রদান করা