জন্ম তারিখ: ৫ ডিসেম্বর, ২০০৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা : শিক্ষার্থী, ৯ম শ্রেণি শাহাদাতের স্থান : চাঁচড়া চেকপোস্টে ,পৌরসভা: ৫নং ওয়ার্ড থানা : সদর, জেলা: যশোর
মো: সাকিবুল হাসান মাহি একজন প্রতিভাবান শিক্ষার্থী, যিনি ৯ম শ্রেণিতে যশোর জেলা স্কুলে পড়াশোনা করছিল । তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যশোর জেলার সদর থানার চাঁচড়া ডালমিল পাড়ায়, যেখানে পরিবারের সাথে তিনি বসবাস করতেন। পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত এই গ্রামীণ পরিবেশ সাকিবুলের শৈশবকে রঙিন করেছে। প্রকৃতির মাঝে তার দুরন্তপনা এবং খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসা তাকে তার বয়সী অন্যদের থেকে একটু আলাদা করে তুলেছে। তার পিতা, মো: শহীদুর রহমান, একজন পরিশ্রমী ব্যবসায়ী। ৪৫ বছর বয়সী শহীদুর মাছের ব্যবসার মাধ্যমে পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করেন এবং মাসিক ১০,০০০ টাকা আয় করেন। পরিবারের কর্তা হিসেবে তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল এবং তার কঠোর পরিশ্রমের ফলেই পরিবার একটি স্বচ্ছল জীবন যাপন করে। সাকিবুলের মাতা, মোছা: আইরিন সুলতানা, একজন আদর্শ গৃহিণী। ৪০ বছর বয়সী এই নারী তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের দেখাশোনা করেন এবং ঘরোয়া কাজের পাশাপাশি সন্তানদের আদর-যত্নে কোনো ত্রুটি রাখেন না। পরিবারের ৪ সদস্যের মধ্যে সাকিবুল তার ছোট বোন সুসকান সুলতানাকে নিয়ে ভীষণ স্নেহপ্রবণ ছিলেন। সুসকান রাঙা প্রভাত কিন্ডারগার্টেনের ২য় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এবং মাত্র ৮ বছর বয়সী। পরিবারের ছোট সদস্য হিসেবে সে সবার আদরের এবং সাকিবুল তাকে সবসময় আগলে রাখত। সাকিবুল তার মা-বাবার অত্যন্ত আদরের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই সে দুরন্ত এবং খেলাধুলায় মেতে থাকলেও, মায়ের কাজে সাহায্য করতে সে কখনো দ্বিধা করত না। ছোট হলেও পরিবারের প্রত্যেকের প্রতি তার দায়িত্বশীল আচরণ এবং মায়ের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব তাকে পরিবারের মাঝে অত্যন্ত প্রিয় করে তুলেছে। একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে, সাকিবুল এমন এক চরিত্রে গড়ে উঠছে, যেখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং পারিবারিক দায়িত্ববোধের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। শাহাদাতের প্রেক্ষাপট ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থান ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের অবসান সমকালীন বিশ্বে এক বিরল উদাহরণ। তবে এই অসাধারণ জাগরণ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৬ বছরের চরম স্বেচ্ছাচার ও দুর্নীতির পতন আকস্মিকভাবে ঘটেনি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা জনগণের অসন্তোষ, যেখানে স্কুলের ছাত্ররা পর্যন্ত অংশ নিয়েছিলেন, ফলে এটি গণবিস্ফোরিণে পরিণত হয়েছিল। তেমনি এক স্কুল ছাত্র যশোর জেলা স্কুলের নবম শ্রেণির সাকিবুল হাসান মাহি। সে শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল। বিশেষ করে যখন রংপুরে আবু সাঈদ শহীদ হয়, সেদিন থেকে মাহি সরাসরি রাজপথের আন্দোলনে যোগ দেয়। তার অনুরোধে তার বাবা তাকে একটি জাতীয় পতাকা কিনে দেন। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের বিজয়ের দিনে চাঁচড়া চেকপোস্টে ছাত্র-জনতার জমায়েতের খবর পেয়ে মাহি বাসা থেকে সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়। কিছুক্ষণ পর বিজয় মিছিলে অংশ নিতে তার বাবা ও বোনও যুক্ত হোন। মুসকান ভাইয়ের সাথে দেখা করতে চাইলে তারা রেলওয়ের কাছে মাহির দেখা পান। তখন মাহি বাবাকে বলে, "বাবা, তুমি বাড়ি চলে যাও, আমি বিজয় মিছিল করে তারপর আসব।" এই কথা বলে মাহি রোড ডিভাইডার পার হয়ে বোনের গালে একটি চুমু খায় এবং মিছিলের অগ্রভাগে চলে যায়। সন্ধ্যার দিকে এলাকার সব ছেলে ফিরে এলেও মাহি বাসায় ফেরেনি। তখন তার বাবা খবর নিতে গিয়ে জানতে পারেন যে, জাবির হোটেলের লাগা আগুনের কথা। মাহি জাবির হোটেলে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছে এবং মাহি সহ এলাকার আরও তিনজন ছেলে নিখোঁজ রয়েছে। এই খবর পেয়ে মাহির বাবা তাকে অনবরত ফোন করেন, কিন্তু ফোন রিসিভ হয়নি। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর তার ফোনটিও বন্ধ হয়ে যায়। তারপর তার বাবা জাবির হোটেলের বাইরে এবং হাসপাতালে পাগলের মতো খোঁজ শুরু করেন। আনুমানিক সন্ধ্যা ছয়টার দিকে উদ্ধারকর্মীরা মাহিকে মৃত অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে গিয়ে তার বাবা মৃতদেহ সনাক্ত করেন এবং আগুনে বিকৃত দেহ দেখে তার বাবা মুহুর্তেই আতকে উঠে। বিজয় মিছিলে অংশ নেয়া প্রিয় মাহিকে বাবার কাধে করে বাসায় নিয়ে আসেন। বাড়িতে শোকের ছায়ায় , চারিদিকে অন্ধকার হয়ে যায়। ফুটফুটে ছেলের অকালে দেশের জন্য জীবন দেওয়াটা অনেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু সারাদেশের শহীদদের দিকে তাকিয়ে, বিশেষ করে রংপুরের আবু সাঈদের প্রেরণা, হৃদয়ে পাথর বেঁধে শহীদ সাকিবুল হাসান মাহিকে চিরবিদায় জানানো হয়। পরদিন ৬ আগস্ট সকাল ১০:০০ ঘটিকায় ঢালমিল মোড়ে প্রায় হাজার মুসল্লির উপস্থিতিতে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাকে স্থানীয় চাচড়া রাজবাড়ী কবরস্থানে দাফন করা হয়। বিদায় নেয় সকলের আদরের মধ্যমণি, দেশের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া প্রিয় শহীদ সাকিবুল হাসান মাহি। শহীদ সম্পর্কে অনুভুতি সাকিবুল হাসান মাহি ছিল এমন এক কিশোর, যার জীবন আলোকিত হয়েছিল তার অসাধারণ মেধা ও সৎ জীবনধারায়। প্রতিবেশী বড়রা আজও গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাকে স্মরণ করেন। তারা বলেন, "সাকিবুল ছিল মেধাবী, সৎ এবং অত্যন্ত মিশুক।" তার মায়াবী হাসি আর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ সবার হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। মায়ের কাজে সাহায্য করতে সে সবসময়ই প্রস্তুত থাকত, যেন তার দায়িত্ববোধ এবং পরিবারের প্রতি ভালোবাসা সবসময় জাগ্রত ছিল । তার কাজের প্রতি আন্তরিকতা এবং নিরলস শ্রম তাকে অন্যান্য সমবয়সীদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল । সাকিবুলের আচরণ সবসময়ই ছিল প্রশংসনীয়। বড়দের সাথে বিনয়ী এবং ছোটদের প্রতি ভালোবাসাপূর্ণ ব্যবহার তাকে সবার কাছে অনুকরণীয় করে তুলেছিল। এমনকি যখন তার চারপাশের অনেক কিশোর বাজে সঙ্গের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছিল , সাকিবুল সেই সব অসৎ সঙ্গ থেকে নিজেকে দূরে রাখতো। তার এই সচেতনতা, শুদ্ধ মনোভাব এবং জীবন সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি তাকে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো করে তুলেছিল, যার আলো আজও মানুষের মনে জ্বলজ্বল করে। আজ তার অনুপস্থিতিতে, সবাই অনুভব করে তার সেই কোমল, বিনয়ী এবং অনন্য ব্যক্তিত্বের শূন্যতা, যা অনেকের জীবনে এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। পারিবারিক আর্থিক অবস্থার বিবরণ শহীদ হাসিবুল হাসানের বাবা তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। স্থানীয়ভাবে মাছের রেণু ফুটিয়ে প্রাপ্ত ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা দিয়ে সংসার পরিচালনা করা অনেকটাই অসম্ভব। সম্প্রতি প্রিয় ছেলে মারা যাওয়ায় কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। শহীদের পিতা ব্যবসায় সহায়তা পেলে হয়তো বাকী সদস্যদের নিয়ে স্বাস্ছন্দে নিজেদের জীবন পার করতে পারবে। ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : মো: সাকিবুল হাসান মাহি, জন্ম: ০৫-১২-২০০৯ পেশা : শিক্ষার্থী, ৯ম শ্রেণি প্রতিষ্ঠান : যশোর জেলা স্কুল স্হায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : চাঁচড়া ডালমিল পাড়া, পৌরসভা: ৫নং ওয়ার্ড থানা : সদর, জেলা: যশোর পিতার নাম : মো: শহীদুর রহমান, বয়স : ৪৫, পেশা ব্যবসা মাতার নাম : মোছা: আইরিন সুলতানা, বয়স: ৪০, পেশা : গৃহিণী মাসিক আয় : ১০০০০/- আয়ের উৎস: মাছের ব্যবসা পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৪ জন ১) বোন : সুসকান সুলতানা, বয়স: ০৮ রাঙা প্রভাত কিন্ডারগার্টেন, ২য় শ্রেণি পরামর্শ ১। শহীদ পরিবারের জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করা।