জন্ম তারিখ: ৩ অক্টোবর, ২০০৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা : ছাত্র, ৮ম শ্রেণি। শাহাদাতের স্থান : যশোর চিত্রার মোড় জাবির হোটেল।
"আমি যদি শহীদ হয়ে যায় তার বিনিময়ে তোমরা ভালো থাকবে, দেশ ভালো থাকবে। আমার জন্যে দোআ করো।" যশোর জেলার সদর উপজেলার পুলেরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র মো: মেহেদী হাসান আলিফ। যশোর পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ড অধিভুক্ত চাঁচড়া আদর্শ পাড়ার জরাজীর্ণ এক ঘরে শুয়ে স্বপ্ন দেখত কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার তীব্র ইচ্ছা তার পড়াশোনায় ভালোই প্রভাব ফেলেছিল। সবসময় পড়াশোনায় ভালো করত। স্বপ্ন পূরনের ব্যাপরে সে ছিল আত্মবিশ্বাসী ছিল। মেহেদী হাসান আলিফের বাবা জনাব মো: হারুন অর রশিদ পেশায় একজন ড্রাইভার। তার একমাত্র আয়েই পরিবার চলে। তার মা মোসাা: মোমেনা বেগম ডলি। আলিফের একটি ছোট বোন আছে। তার নাম মীম। মীম স্থানীয় একটি স্কুলে ১ম শ্রেণিতে পড়ে। শহীদ মো: মেহেদী হাসান আলিফ ২০০৯ সালের ৩ অক্টোবর যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পুলেরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। ছোট থেকেই তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে মানুষের মন জয় করে নিতেন। কেউ একবার তার সংস্পর্শে আসলেই বন্ধু হয়ে যেত। ছোট বোন মীমের কাছে শহীদ মেহেদী ছিলেন একজন আদর্শ ভাই। ছাত্র হিসেবে যেমন ছিলেন মেধাবী তেমনি মানুষ হিসেবে ছিলেন চমৎকার। আলিফের দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ মেহেদী হাসান আলিফের মা মোমেনা বেগম ডলি একদিন ছেলেকে বলেন, "তোমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমাদের কি হবে?" প্রত্যুত্তরে আলিফ বলে, আমি যদি শহীদ হয়ে যাই, তার বিনিময়ে তোমরা ভালো থাকবে, দেশ ভালো থাকবে। আমার জন্য দোয়া করো।" এতটুকু একটা বাচ্চা ছেলের এমন জবাবে মা মোমেনা বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি কতটা ভালবাসা থাকলে এমন উত্তর দিতে পারে। জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সেও ছিল একজন সম্মুখ সারির যোদ্ধা। প্রায়শই বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যেত আন্দোলনে অংশ নিতে। ৫ আগস্ট ২০২৪, সকালে সে বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আন্দোলনে যায়। যাওয়ার আগে মা কে বলে যায়, "মা আমি যাচ্ছি। "কোথায় যাচ্ছ? জিজ্ঞসা করলে, বাবার ভয়ে সে ইশারায় উত্তর দেয়। এমন সময় বাবা ডেকে বলেন, "বাবা আলিফ, আমার সাথে ভাত খাও, আসো।" সে ভাত খাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে না। আনুমানিক সকাল ৯:৩০ এর দিকে আলিফ বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। বাসা থেকে বের হয়ে আলিফ তার অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়। ৫ আগস্ট ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শেষ দিন। ৬ আগস্ট ২০২৪ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সারা দেশের ছাত্র-নাগরিক-শ্রমিকদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানান। যাকে বলা হয় মার্চ টু ঢাকা। তবে আরেক ঘোষণায় এ কর্মসূচি এগিয়ে ৫ আগস্ট ২০২৪ এ নিয়ে আসা হয়। সেদিন স্বৈরাচার সরকার কমপ্লিট শাট ডাউন ঘোষণা করে। ডিজিটাল র্ক্যাক ডাউনের মাধ্যমে সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে পিস্তল, রাইফেল, সাজোয়াজান ও আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, অবস্থান নেয়। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছিল স্বৈরাচারের দোসর আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ। সাজোয়াজান ও ট্যাংক দিয়ে রাস্তা আটকে রাখে। সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে। উদ্দেশ্য ছিল গণভবন ঘেরাও করে স্বৈরাচার খুনি হাসিনাকে পদত্যাগ করানো। বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ হিসেবে যশোরের সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে আসে। তাদের প্রতিবাদ মিছিলে ঘাতকেরা আক্রমণ চালায়। পুলিশ সেখানে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা পিছু হটে না। এরপর শুরু হয় গুলি, গ্রেনেড নিক্ষেপ। পুলিশের গুলিতে আহত হয় শতাধিক নিহত হয় আরও অনেকে। আন্দোলন ছত্র ভঙ্গ হয়ে যায়। এদিকে সারাদেশ থেকে মুক্তিকামী মানুষ সকল বাঁধা উপেক্ষা করে ক্রমেই গণভবনের দিকে এগিয়ে আসে। অবস্থা বেগতিক দেখে খুনি হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যায়। পতন ঘটে স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদের। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে আনন্দ মিছিল বের হয়। এ মিছিলে যুক্ত হয় যশোরের সাধারণ জনতা। এ মিছিলে মেহেদী হাসান আলিফও অংশ নেয়। মিছিল নিয়ে চিত্রার মোড় জাবির হোটেল অতিক্রম করার সময় সেখানে অগ্নিকাণ্ড দেখতে পায়। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেকে ভিতরে আটকা পড়ে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যদের সাথে আলিফও আটকে পড়াদের উদ্ধার করতে যায়। উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই হোটেলের ভিতরে আটকা পড়ে। আর বের হতে পারে না। দগ্ধ হয়ে প্রাণ যায় মেহেদী হাসান আলিফের। এদিকে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেলেও ছেলে ঘরে ফিরে না। মা ছেলেকে খোঁজাখোজি শুরু করেন। তার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে, "তোমরা ত চলে আসলে কিন্তু আমার ছেলে ত এখনো আসল না।" ছেলেটি উত্তর দেয়, "চলে আসবে আন্টি, চিন্তা করিয়েন না"। অপেক্ষা করতে করতে আলিফের বাবা ও মা টিভিতে খবর দেখে জানতে পারেন হাসিনার পতনের কথা আর জাবির হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের কথা। খবর শুনে তারা আফসোস করতে থাকেন। বিকেল হয়ে গেলেও ছেলের ফিরে না বাসায়। মা চিন্তিত হয়ে খোঁজ-খবর নিতে থাকেন। এলাকারই আরেক শহীদ মাহিরের মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান তার ছেলেও বাড়ি ফেরেনি। এরপর প্রতিবশি ইউসুফের নিখোঁজের খবর শুনে আরও চিন্তিত হয়ে পড়েন। ছেলের খোঁজে সদর হাসপাতালে। খোঁজা-খুজির এক পর্যায়ে তারা মাহি ও ইউসুফের লাশ দেখতে পান। বুঝার আর বাকি রইল না তাদের ছেলেও আর বেঁচে নেই। একসময় তারা আলিফের লাশ খুজে পান। শরীরের অধিকাংশ অংশ পুড়ে যাওয়া তাকে চিনা যাচ্ছিল না। এদিকে আলিফের কাছে অন্য একজনের ফোন থাকায় আলিফের লাশ তার মা-বাবাকে দিতে অসম্মতি জানায়। অবশেষে অনেক কষ্টে বিভিন্ন উপায়ে পরিচয় নিশ্চিত করে ছেলের মরদেহ বাড়ি নিয়ে আসেন। হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে এসে তাদের নিজ বাড়িতেই দাফন-কাফন সম্পন্ন করেন। তাকে চাচড়া রাজবাড়ী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের অনুভূতি একমাত্র আদরের ছেলেকে হারিয়ে মা শোকে পাথর। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলেটা কখনো নিজের কথা ভাবেনি। সবসময় দেশের কথা দেশের মানুষের কথা ভাবত। তিনি বলেন, একদিন শুয়ে শুয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমাদের কি হবে?" প্রত্যুত্তরে আলিফ বলে, আমি যদি শহীদ হয়ে যাই, তার বিনিময়ে তোমরা ভালো থাকবে, দেশ ভালো থাকবে। আমার জন্য দোয়া করো।" এতটুকু একটা বাচ্চা ছেলের এমন জবাবে মা মোমেনা বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি কতটা ভালবাসা থাকলে এমন উত্তর দিতে পারে। পারিবারিক অবস্থা মেহেদী হাসান আলিফের বাবা জনাব মো: হারুন অর রশিদ পেশায় একজন ড্রাইভার। তার একমাত্র আয়েই পরিবার চলে। তার মা মোছা: মোমেনা বেগম ডলি। আলিফের একটি ছোট বোন আছে। তার নাম মীম। মীম স্থানীয় একটি স্কুলে ১ম শ্রেণিতে পড়ে। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। জায়গা জমি নেই। ভাড়া গাড়ি চালিয়ে সংসার চালান। ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : শহীদ মেহেদী হাসান আলিফ পেশা : ছাত্র, ৮ম শ্রেণি বয়স : ১৪ বছর জন্ম তারিখ : ০৩/১০/২০০৯ জন্ম স্থান : ঝালোপাড়া, ভার্থকলা, সিলেট পিতা : জনাব মো: হারুন অর রশিদ মাতা : মোসা: মোমেনা বেগম ডলি আহত হওয়ার তারিখ : ৫ আগস্ট ২০২৪, আগুনে দগ্ধ হন, শাহাদাতের তারিখ : ৫ আগস্ট ২০২৪ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: চাঁচড়া আদর্শ পাড়া, ৫ নং ওয়ার্ড, থানা: সদর থানা জেলা: যশোর বর্তমান ঠিকানা : ঐ পরামর্শ ১। শহীদ পরিবারের জন্য একটি স্থায়ী বাসস্থান তৈরি করে দেওয়া। ২। শহীদ পরিবারের জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করা। ৩। শহীদের ছোট বোনের পড়ালেখার ব্যয়ভার বহন করা।