জন্ম তারিখ: ১৩ অক্টোবর, ১৯৯৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা : লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান তাইসার রিচ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে কর্মরত। শাহাদাতের স্থান : মিরপুর-১০, ঢাকা।
এক প্রদীপ্ত ফুল শহীদ মো: রাকিবুল হোসেন। জুলাই বিপ্লবে প্রথম দিবসে এক ডজন রাবার বুলেট শরীরে বিদ্ধ হওয়ার পরেও আজাদির নেশায় পরের দিন ছাত্রজনতার বিপ্লবে শরিক হন শহীদ রাকবুল হাসান। আচমকা পিছনের দিক থেকে সরাসরি ঘাড়ে গুলি লেগে শাহাদাতের সুধা পান করেন রাকিবুল। রাকিবুল হোসেন ১৯৯৫ সালের ১৩ অক্টোবর ঝিনাইদহ জেলার হরিষাকুন্ড এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিকী, যিনি বিমান বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এনং তার মায়ের নাম মোসা: হাফিজা সিদ্দিকী। আবু বকর সিদ্দিকীর দুই ছেলের মধ্যে রাকিবুল ছিলেন ছোট। বাবার ইচ্ছা ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। রাকিব ছোট থেকেই অনেক মেধাবী ছিলেন। বিএফ শাহিন কলেজ, যশোর থেকে ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি পান। তিনি ২০১১ সালে এসএসসিতে কাঞ্চননগর মডেল হাইস্কুল থেকে জিপিএ ৫.০০ পেয়ে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়। ঝিনাইদহের সুনামধন্য কে.সি কলেজ থেকে জিপিএ ৫.০০ পেয়ে এইচ এস সিতে উত্তীর্ণ হয়ে এম আই এসটিতে ইঞ্জিনয়িারিং এ ভর্তি হন। সফলতার সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ১ জুলাই ২৪ তারিখে কাজে যোগদান করে। সর্বশেষ তিনি লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান তাইসার রিচ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকেই রাকিবুল পরিবারে অর্থনৈতিক সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করতেন। বাবা মার সাথে একসাথে থাকবেন বলে রাকিবুল ঢাকায় বাসা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। মহান আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল রাকিবুলের পরিকল্পনার ঊর্ধ্বে। আল্লাহ তার পছন্দের বান্দাকে শহীদ হিসাবে কবুল করে নিলেন। ঘটনার বিবরণ জুলাই ২০২৪, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কোটা আর মেধার প্রশ্নে, ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার কোটাকে অগ্রাধিকার দেয়। অতঃপর মেধাবীদের রাজাকার সম্বোধন করলে মেধাবী ছাত্রসমাজ ফুঁসে উঠে।তাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে, নিজেদের অধিকার রক্ষার স্বার্থে, মেধাকে জীবন্ত রাখতে গঠিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের ধারা। জুলাই এর প্রথম সপ্তাহ হতে চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন ক্রমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র দেশে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের পাশাপাশি প্রতিবাদে শরিক হন কৃষক, শ্রমিক, হকার, চাকরিজীবীসহ আবালবৃদ্ধবনিতা সকল শ্রেনী পেশার মানুষ। তাঁদের অংশগ্রহণে আন্দোলন বেগবান হওয়ায় ছাত্রজনতার উপর নেমে আসে স্বৈরাচারের নির্যাতনের ঝড়। পুলিশ-র্যাব-বিজিবির পাশাপাশি সরকার দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনীর যৌথ প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ছাত্রজনতার উপর মুহুর্মুহু তাজা গুলি, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ইত্যাদি দিয়ে আক্রমণ শানানো হয়েছিল। বিপ্লবী জনতা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রবল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে স্বতস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ জোরদার করতে থাকে। শহীদ রাকিবুল হোসেন ছোট থেকেই ন্যায়ের প্রতীক ছিলেন। যেকোনো অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করতেন না। ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি শহীদ রাকিবুল হাসানের হৃদয়ে আলোড়ন তৈরী করে। ছাত্রদের উপর স্বৈরাচারের স্ট্রীমরোলার আঘাত করেছিল রাকিবুলের হৃদয় কুঠরীতে। তাই তিনি ছাত্রদের আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করলেন। ১৮ জুলাই বেলা এগারোটা থেকেই রাজধানী ঢাকার বেশ কিছু পয়েন্টে নিরস্ত্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের উপর রাষ্ট্রীয় গুন্ডাবাহিনী এবং শেখ হাসিনার লেলিয়া দেওয়া জানোয়ার রূপি ছাত্রলীগের গুন্ডারা অতর্কিত হামলা চালায়। পাষান পুলিশের গুলিতে স্পট ডেড হতে থাকে নিরীহ ছাত্ররা। অফিসে থাকাকালীন রাকিবুল হোসেন এই দৃশ্যগুলো ফেসবুকে দেখে ঠিক থাকতে পারেন নি। অবিরাম চোখে অশ্রুর ধারায় শপথ নিলেন অফিস শেষেই ছাত্রদের আন্দোলনে শরীক হবেন। তারই ধারাবাহিকতায় শহীদ রাকিব রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর চত্ত্বর এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সন্ধ্যায় যোগদান করেন। গোধূলির সূর্যাস্তের পরপরই পুলিশ মুহুর্মুহু রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। শহীদ রাকিবুল এই বুলেটকে উপেক্ষা করে ছাত্রদের রক্ষা করতে,তাদের নিরাপদ যায়গা খুঁজে দিতে সামনে এগিয়ে যান।এক পর্যায়ে ডজনখানিক রাবার বুলেট শহীদ রাকিবুলের তলপেটে এসে লাগে। নিথর হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাকিবুল। তবুও তিনি দমে যাননি। ছাত্রদের কিছু নিরাপদ যায়গায় রেখে তার নিজের বাসায় চলে যান। ১৯ জুলাই, শুক্রবার।ছাত্রজনতার প্রতিরোধ সংগ্রামের দ্বিতীয় দিন। আকাশ যেনো এদিন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। বাতাসে টিয়ারশেলের অসহনীয় বিষবাষ্প আর সাউন্ড গ্রেনেড ফাটিয়ে পুলিশ জনমনে আতংক ছড়িয়েছিল। এনদিন পুলিশ, বিজিবি, ছাত্রলীগ ছিল আরো ভয়ংকর ও সতর্করূপে। তবুও মুক্তিকামী জনতা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের প্লাটফর্মের ছাত্ররা দলমত নির্বিশেষে জীবনের পরোয়া না করে রাজপথে চলে এসেছেন। বিবেকের প্রচন্ড আঘাতে ঠিক থাকতে পারেন নি রাকিবুল। হৃদয়টা ছটফট করছিল তার, কখন আবার আন্দোলনে যোগ দিবেন। শুক্রবার অফিস বন্ধ থাকায় আগের দিনে রাবার বুলেটবিদ্ধ শরীর নিয়ে শাহাদাতের জজবা নিয়ে সন্ধ্যার দিকে মিরপুর-১০ নং সেক্টরে মেট্রোরেল স্টেশনের পাশেই আন্দোলনে অংশ নেন। এ দিনও জুমার নামাজের পর থেকে পুলিশের গুলিতে শাহাদাত বরণ করে শতশত নিরীহ ছাত্র-জনতা। আনুমানিক রাত ৯.০০ দিকে সন্তান গুলিবিদ্ধ হয়েছে এমন খবর পেয়ে, রাকিবের সামনে দিয়ে আর্তনাদ করতে করতে একজন মহিলা ঘটনাস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন। পুলিশ, আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া নিরিহ ছাত্রজনতাকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। তখন পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। এমন পরিস্থিতে রাকিব মহিলার গতি রোধ করে আটকে দেন এবং তাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করেন। সান্তনা দিতে দিতেই হঠাৎ করে ১টি বুলেট রাকিবের পিঠের উপরের অংশে লেগে গলার নিচের অংশ দিয়ে বের হয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শহীদ রাকিবুলের নিষ্পাপ দেহ। পাশেই আন্দোলনে অংশ নেওয়া তার বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করতে গেলো। এমন শোকার্ত পরিবেশ ও অনেক ঝুঁকি। পুলিশ আর বিজিবির টহল তখনও চলছে। খোঁজ পেলেই ক্রস ফায়ার অথবা গ্রেফতার। তবুও ঝুকি নিয়ে রাকিবুলের বন্ধুরা নিকটস্থ ডা. আজমল হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে সাথে সাথে মৃত ঘোষণা করেন। রাকিবের বন্ধুরা তার বাবার মোবাইল নাম্বারে ফোন করে তার ভাইয়ের নিকট মৃত্যুর সংবাদ দেয়। সে খবর শুনে শহীদ রাকিবুলের মা শোকার্ত হৃদয় নিয়ে প্রায় আধা পাগল হয়ে যান। গভীর এক ভূতড়ে রাত। রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই। রক্তের ফিনকিতে উত্তাল শহর। অনেক খোজাখুজির পর অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেলো। রাকিবুলের বন্ধু পিয়াস ও ফয়সাল এ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ পরদিন ভোরে ঝিনাইদাহ শহরের বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেন। কিন্তু তখনও ঝুঁকি লাশ নিয়ে। জানাজা কে করাবে। কিভাবে কবরস্থ করাবে সে বিষয় নিয়ে। কারণ, হাসিনার নোংরা প্রশাসন ছিল সদা তৎপর। তাদের অনেক অনুনয় বিনয় করে কিছু সময় পাওয়া গেলে সকাল ৯ টায় ১ম জানাজা ঝিনাইদহ শহরে এবং গ্রামের বাড়ি বাসুদেবপুরে বেলা ১১.০০ টায় ২য় জানাজা শেষে বাসুদেবপুর কবরস্থানে শহীদ রাকিবুলকে কবরস্থ করা হয়। প্রতিবেশী ও বন্ধুদের অভিব্যক্তি শহীদ রাকিবুলকে নিয়ে এলাকাবাসীর ধারণা খুবই স্বচ্ছ ও ভালো ছিল। রাকিবুলের চাচা স্মৃতিচারণ করতে করতে বলেন, ‘ওর মতো মেধাবী ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ছেলে আমাদের গোটা গ্রামে খুবই কম আছে। রাকিবুলের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছিল, আর এরমধ্যে কি যে হয়ে গেলো। রাকিবুলের মা ছিল ক্যান্সারে আক্রান্ত। ছেলের মৃত্যুর কথা শুনে পাগলের মতোই হয়ে গেলো। কান্নার স্রোতে ভাসিয়ে বলতে লাগলো, ‘আরে খোকা তুই না বললি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বি। সত্যি সত্যিই ঘুমালিরে আমার খোকা।‘ শাহাদাত স্রষ্টার দেওয়া গৌরবের সম্পদ। শহীদ মো: রাকিবুল হোসেন সেই মহান গৌরবের উত্তরাধিকারী। রাকিবুল হোসেনের মতো অজস্র শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ জুলাই বিপ্লবের লোমহর্ষক ঘটনা সবার হৃদয়ে দাগ লাগিয়ে যাক এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে শহীদ রাকিবুলদের মতো লাখো তরুণ বৈষম্যবিরোধী নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করুক। তবেই শহীদ রাকিবুল হোসেনদের এ আত্মত্যাগ স্বার্থকতা লাভ করবে। একনজরে শহীদের পরিচয় নাম : মো: রাকিবুল হোসেন জন্ম তারিখ : ১৩/১০/১৯৯৫ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মহিষাকুণ্ড, ইউনিয়ন: ৭ নং ওয়ার্ড, ঝিনাইদহ পৌরসভা, ঝিনাইদহ সদর সর্বশেষ ঠিকানা : বাসা: মহিষাকুণ্ড, চড়িয়ার বিল, ঝিনাইদহ সদর, ঝিনাইদহ পিতার নাম : মো: আবুবকর সিদ্দিকী (৬০) পিতার পেশা : বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (জেসিও) পিতার মাসিক আয় : ১৫,০০০/- (পেনশন) মায়ের নাম : মোসা: হাফিজা খাতুন (৪৮) মায়ের পেশা : গৃহিণী পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ০৫ (পাঁচ) বড় ভাইয়ের নাম : মো: ইকবাল হোসাইন (পেশা: সিনিয়র অফিসার, সোনালী ব্যাংক) ঘটনা/মৃত্যুর স্থান : মিরপুর-১০, ঢাকা আক্রমণকারী : পুলিশ আহত হওয়ার সময় : ১৯ জুলাই ২০২৪, রাত ৯:৩০ মিনিট নিহত হওয়ার সময় : ১৯ জুলাই ২০২৪, রাত ৯:৩০ মিনিট শহীদের কবরস্থান : বাশুদেবপুর কবরস্থান, হরিণাকুণ্ড পরামর্শ ১। শহীদ পরিবারের জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করা