জন্ম তারিখ: ৩০ অক্টোবর, ২০০৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা : স্যানেটারি দোকানে কাজ করতেন, শাহাদাতের স্থান : কুমার খালি বাস স্ট্যান্ড, কুষ্টিয়া
“স্কুলের সবাই যাচ্ছে, আমি কি ঘরে বসে থাকতে পারি? প্রয়োজনে আমি শহীদ হব।” মোঃ মাহিম হোসেন ৩০ অক্টোবর ২০০৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের বামন পাড়া গ্রামের ইব্রাহিম হোসেনের বড় ছেলে মাহিম। চাঁদট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র মাহিম ছোটবেলা থেকেই অনেক মেধাবী ও দূরন্ত ছিলেন। বিভিন্ন খেলাধুলায় পারদর্শী মাহিম ফুটবল খেলায়ও বেশ পারদর্শী ছিলেন। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় তিনি চাচা, ফুফু সবার আদরে বড় হয়েছেন। তাকে ঘিরে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। সে বড় চাকুরী করবে তাদের দুঃখের দিন ঘুচবে। কিন্তু এক নিমিষেই তার বাবার সব আশা শেষ হয়ে যায়। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ২০২৪ সালে জুলাই মাসে বাংলাদেশে সংগঠিত বৈষম্যবিরোধি ছাত্র জনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বেশ কয়েকটি মূল বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। প্রথমত, শিক্ষা ব্যবস্থার অসমতা ও বৈষম্য: দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার মান ও সুযোগ-সুবিধার মধ্যে যে বিশাল ফারাক রয়েছে, তা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছিল। সরকারি কলেজগুলোর অব্যবস্থাপনা এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাণিজ্যিকীকরণ শিক্ষার্থীদের জন্য সমস্যা তৈরি করেছে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক বৈষম্য: বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে উঁচু শ্রেণির ও নিম্ন শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। চাকরি, পেশা ও অর্থনৈতিক উন্নতির সুযোগের জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপ ও অস্থিরতা বেড়ে গেছে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক পরিবেশ: সরকারের দমন-পীড়ন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাব এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর ওপর নজরদারি এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। ছাত্রদের মধ্যে ন্যায্যতার দাবি এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করার প্রয়াস আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করেছে। দীর্ঘ ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, ভোটচুরি, দুর্নীতিন, খুন, অন্যায়, অত্যাচার জনমনে ফেলেছিল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কোটা প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে আওয়ামী সরকার। ২০১৮ সালে ছাত্রছাত্রীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সকল দাবী মেনে নিলেও তার অন্তরে ছিল হিংসার আগ্নেয়গিরি। তাই ২০২৪ তালে একটি বিরোধী দলহীন নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর আবার কোটা ফিরিয়ে আনতে চাইল হাসিনা সরকার। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত ১ জুলাই থেকে। অহিংস এই আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংস হয় । আন্দলোনে নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ওপর সশস্ত্র ঘাতক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও পুলিশ, র্যাব সদস্যরা হামলা চালাতে থাকে। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতের পর থেকেই আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি বৈষম্যবিরধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন ধীরে ধীরে ফ্যাসীস্ট সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; হয়ে উঠে দেশের আপামর জনতার এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ অভ্যুত্থানে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। ক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পদত্যাগের পূর্বে তিনি রেখে যান তার ঘৃণ্য ও বিকৃত মস্তিষ্কের অজস্র কুকীর্তি। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী সহ অনেক নিরীহ জনতার উপর লেলিয়ে দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী। তাদের গুলিতে শহীদ হয় নিরস্ত্র নিপীড়িত জনতা। আন্দোলনে যোগদান বাংলাদেশ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে জনগণ নানান অন্যায়, শোষণ, নিপীড়ন ও জুলুমের নির্মম ভুক্তভোগী। এদেশের মুক্তিকামী জনতা সময়ের দাবিতে সাড়া দিয়ে এহেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে বারংবার রুখে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে হুংকার দিয়ে সংগ্রামী জনতার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে ছাত্রবৃন্দ। উপরন্তু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সাক্ষী, দেশের ক্রান্তিকালে বরাবরই ছাত্রদের মাধ্যমে আন্দোলন সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে। জুলাই ২০২৪ এ সংগঠিত ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন একসময় রুপ নেয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পর্যায়ক্রমে শুরুহয় ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন আন্দোলন। সারা দেশের ন্যায় কুষ্টিয়াও স্বৈরাচারী খুনি হাসিনা সরকার পতনের একদফার আন্দোলনে ফুঁসে ওঠে। হাজার হাজার ছাত্র জনতা খালি হাতে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সে আন্দোলনে শহীদ মাহিমও দলবল নিয়ে অংশগ্রহন করেন; বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তুলে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। শাহাদাত বরণ ৫ আগস্ট আন্দোলনে যাওয়ার সময় তার মা তাকে আন্দোলনে যেতে বার বার নিষেধ করেছিলেন। পরম শ্রদ্ধেয় মমতাময়ী মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে মাহিম বলেছিলেন, “স্কুলের সবাই যাচ্ছে, আমি কি ঘরে বসে থাকতে পারি? আমি প্রয়োজনে শহীদ হব”। একথা বলে তিনি মিছিলে যোগ দিতে উপজেলা সদরে চলে যান। সেদিন প্রিয় সন্তানের অমূল্য প্রাণ সংশয়ের কথা ভেবে ফ্যাসিস্ট সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বুকের মানিকের এমন দেজদীপ্ত হুংকার হৃদয়ের মণিকোঠায় গর্বের সঞ্চার করে। পথিমধ্যে মাহিম ও তার দল ঘাতক পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। পুলিশের বাঁধার মুখে বন্ধুদের রেখে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে বাসে উঠেন। পাশের উপজেলা কুমারখালীতে গিয়ে বাস থেকে নেমে সেখানেই আন্দোলনে যোগ দেন। এসময় তিনি পুলিশের ছোঁড়া মুহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাসের মধ্যে পড়েন। অকস্মাৎ এমন পরিস্থিতিতে তিনি গুরুতর আহত হয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে সদর এলাকা ছাত্র জনতা ও ঘাতক পুলিশ, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এহেন পরিস্থিতিতে গুরতর আহত মাহিমকে উদ্ধার করা খুবই দুরূহ হয়ে পড়ে। কঠিন প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা স্থানীয় কয়েকজন নারী তাকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে নিরাপদে বাড়িতে ফেরার ব্যবস্থা করেন। বাড়িতে আসার পর তার শরীর ও মুখে জ্বালা যন্ত্রণা আরও বাড়তে থাকে। ১৭ আগস্ট তিনি সকাল থেকে প্রচণ্ড জ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন। ১৯ তারিখ শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন সকাল ৭.০০ টায় মারা যায়। শহীদ মাহিম হোসেনের মরদেহ বিকেলে গ্রামের বাড়ি পৌঁছালে বাড়ির পাশে ইয়াকুব আহমদ হাই স্কুলে জানাজা শেষে চাঁদট কবরস্থানে তাঁকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়। বন্ধ হয়ে যায় সকল চাওয়া, সকল আবদার। আর কেউ বলবে না আমাকে খেলার বল কিনে দাও। বাবা মা হারালেন কিশোর বয়সী এই দূরন্ত ছেলেকে। পারিবারিক অবস্থা মাহিম হোসেনের বাবা টাইলস মিস্ত্রীর কাজ করেন। এ কাজ করেই সংসারের খরচ ও সন্তানের পড়ালেখা খরচ চালাতেন। নিজস্ব জমি না থাকায় সরকারের গৃহায়ন প্রকল্পের অধীনে একটি সরকারী ঘরে থাকেন। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের অনুভূতি শহীদের চাচা চাঁদ আলী মোল্লা বলেন, “সে অনেক মেধাবী ছিল। আমার অজান্তেই সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে।” মাহিমের ফুফু মোসা: হালিমা খাতুন বলেন, “মাহিমকে আমরা কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। বিভিন্ন সময় আমাদের কাছে অনেক কিছু আবদার করেছে। অনেক সময় আবদার পূরণ করতে পেরেছি আবার অনেক সময় পারিনি। তাকে হারিয়ে আমরা অনেক শুণ্যতা অনুভব করছি। এ শুণ্যতা পূরণ করা অসম্ভব।” এক নজরে শহীদ পরিচিতিনাম : মো: মাহিম হোসেন জন্ম : ৩০-১০-২০০৮ পিতা : মো: ইব্রাহিম, টাইলস মিস্ত্রি-৪২ বছর মাতা : মোসা: রেহেনা খাতুন, গৃহিনী-৩৬ বছর পেশা : স্যানেটারি দোকানে কাজ করতেন শিক্ষা : ছাত্র, দশম শ্রেণি, চাঁদট মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: বামন পাড়া, ইউনিয়ন: বেতবাড়িয়া, থানা: খোকসা, জেলা: কুষ্টিয়া আহত হওয়ার সময় : ০৪ আগস্ট, ২০২৪, দুপুর ১২.৩০টা ঘটনার স্থান : কুমার খালি বাস স্ট্যান্ড, কুষ্টিয়া শাহাদাত : ২০ আগস্ট, ২০২৪, সকাল ৭.০০টা, কুষ্টিয়া সদর হাসপাতাল আক্রমণকারী : স্বৈরাচারী সরকারে যাত্রাবাড়ীর ঘাতক পুলিশ বাহিনী (কাঁদানে গ্যাস) কবরস্থান : চাঁদট গোঁরস্থান সহোদর : নাঈম, ১২ বছর, বামন পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫ম শ্রেণি : নিয়ামুল, ৮ বছর, বামন পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২য় শ্রেণি পরামর্শ ১। একটি দুগ্ধজাত গাভী ক্রয় করে দেয়া যেতে পারে ২। ছোট ভাইদের পড়ালেখার সম্পূর্ণ খরচের ব্যবস্থা করা ৩। এককালীন অনুদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা