জন্ম তারিখ: ১৬ অক্টোবর, ২০০৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২৪ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: খুলনা
পেশা : চাকরিজীবী (গ্যাস সিলিন্ডার ডেলিভারির কাজ করতেন), শাহাদাতের স্থান : মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঢাকা
খুলনা জেলার রহিম নগরে নূর ইসলামের পরিবারে জন্মগ্রহন করেন মো ইয়াসিন আলী শেখ। হতদরিদ্র পিতা মাতার ঘরে আলো হয়ে আসে ছোট্ট ছেলে মো: ইয়াসিন আলী শেখ। তার জন্মের পরেই তার বাবা মারা যান। বড় তিন বোনের আদরের একমাত্র ভাই। মায়ের স্বপ্ন ছেলে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। ছোট থেকেই লেখাপড়ায় ভালো ছিল, সাথে ছিল দুরন্তপনা। চঞ্চল হলেও ছোট বেলা থেকেই কোনো বিবেক বর্জিত কাজে যুক্ত হতো না। মানবিক সকল কাজে সাহায্য ছিল উল্লেখ করার মতো। প্রতিবেশীদের খোজখবর রাখতেন নিয়মিত। তিনি অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী ছিলেন। তিন বোন এর ছোট ভাই হিসেবে যথেষ্ট আদরেই বেড়ে উঠেছেন। যদিও পরিবারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। অভাব অনটন দেখা ছোট্ট ছেলেটি কখনো পরিবারে খুব দামি কিছু কিনতে চায়নি, বরং বোনদের খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে তিনি ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। ছেলেটি স্বপ্ন দেখত আমি একদিন বড় হবো, বড় হয়ে বোনদের আমার নিজের টাকায় বিয়ে দিবো। পারিবারিক অভাব আর অনটনের মধ্যে খুব বেশি পড়াশোনা না করতে পারলেও তার বিবেকবোধ ছিল প্রখর। তিনি সাধাসিধা ও সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। পরিবারের অভাব মেটানোর জন্যই ঢাকা আসেন ইয়াসিন। ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানে ডেলিভারি ম্যানের কাজ করতেন। শাহাদাতের ঘটনা সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক কোটা প্রথা আদালত কর্তৃক পুনর্বহাল হলে সারা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। শান্তিপূর্ণ মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন, রাষ্ট্রপতি বরাবর স্বারকলিপি প্রেরণ- এই সমস্ত কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্রদের আন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে। এর মাঝে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে ছাত্ররা এগিয়ে গেলে পুলিশ তাদের বিনা উস্কানিতে লাঠিচার্জ, কাঁদানো গ্যাস এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের মাধ্যমে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ছাত্ররাও পুলিশের এরূপ গনতান্ত্রিক অধিকার হরণের প্রতিবাদে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এরপর থেকেই সরকার ও আন্দোলনকারীদের মাঝে উত্তাপ বাড়তে থাকে। এরই মাঝে ১৬ জুলাই ২০২৪ তারিখে দেশব্যাপী পুলিশের অত্যাচার ও গুলিতে আবু সাঈদ, শান্ত ও ওয়াসিম আকরাম সহ ৬ জন নিহত হলে ছাত্রসমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সরকার ছাত্র সমাজের ন্যায্য দাবি গ্রাহ্য না করে আন্দোলনকারীদের উপর দমন-পীড়ন নীতি অবলম্বন করে। ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ব্যাপক হামলা করা হয়। আবাসিক ছাত্রদের হল থেকে বের করে দেয়া হয়। পুলিশ ও ছাত্রলীগের গুলিতে বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যা। ১৮ জুলাই ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলনের নেতৃত্ব নিলে ঢাকা জুড়ে নিরস্ত্র ছাত্র ও সশস্ত্র পুলিশ-ছাত্রলীগ বাহিনীর সংঘর্ষে লাশের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় শতকের ঘর। মাত্র তিন দিনে শত শত সাধারণ ছাত্রের লাশ দেখে আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি দেশের সাধারণ জনগণ, শ্রমিক সমাজসহ অন্যান্য শ্রেণিপেশার মানুষ। তারাও ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে এর পরদিন থেকে একযোগে মাঠে নামে। কোটা সংস্কার ছাত্রআন্দোলন পরিণত হয় বৈষম্য বিরোধী গন গনআন্দোলনে। ১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার, পবিত্র জুমার দিন। যাত্রাবাড়ী এলাকা। সকাল থেকেই এখানকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। তবে সকাল থেকে নামাজের আগ পর্যন্ত কোনো অপ্রতিকর ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়নি। পবিত্র জুমার নামাজ আদায় করে আপামর ছাত্র-জনতা একযোগে রাজপথে নেমে আসে। জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে বাধা প্রদান ও অতর্কিত হামলা চালায় পুলিশ বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। তাদের এলোপাথাড়ি গুলিতে রাস্তার উপর একের পর লাশ পড়তে থাকে। বড় হতে থাকে শহীদের মিছিল। নামাজের পর গ্রাহকের বাসায় গ্যাসের সিলিন্ডার পৌঁছে দোকানে ফেরার সময় শহীদ ইয়াসিন যাত্রাবাড়ীতে ছাত্র-জনতা ও আওয়ামী লীগের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মাঝে পড়ে যান। সংঘর্ষের একপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের ছোড়া বুলেট আঘাত করে ইয়াসিনকে। আহত অবস্থায় তাকে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শহীদের মায়ের কথা রূপসার রহিম নগরের ইয়াসিন শেখের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, জীর্ণশীর্ণ কুড়ে ঘরে বসবাস তাদের। ইয়াসিনের মা মনজিলা বেগম জানান, ‘ইয়াসিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কয়েকটা ছেলে ঢাকার যাত্রাবাড়ী মাতুয়াইল এলাকায় আমার ভাড়া বাসায় এসে জানায় তার গুলির খবর। তখন আমার কাছে একটা টাকাও ছিল না, অনেক অনুরোধের পর এক রিকশাচালক বিনা ভাড়ায় আমাকে ইয়াসিনের কাছে নিয়ে যায়। এরপর তাকে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করি। ২৫ তারিখ সে মারা যায়। এরপর গ্রামের লোকজনের দেয়া চাঁদার টাকায় অ্যাম্বুলেন্সে করে ইয়াসিনের লাশ খুলনার বাড়িতে আনি। আনার পথেও অনেক হয়রানি পোহাতে হয়।’ কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরো বলেন, ‘আমার ছেলের কোনো দোষ ছিল না। সে পথচারী ছিল। সে তো কোনো দল করতো না। কাজ করতো, ভাত খেত। আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করতাম। ইয়াসিনের আয় দিয়েই বাসা ভাড়াসহ সংসার চলতো। আমি এখন কী করে চলবো, আমাকে কে খাওয়াবে? আমার তো সব শেষ। এত অল্প বয়সে সে আমার বুক খালি করে চলে যাবে তা ভাবতেও পারিনি।' পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ আলী ছাড়াও আরও তিন বোন রয়েছে। সব বোনের বিয়েও হয় কিন্তু কিছুদিন আগে ছোট বোনের ডিভোর্স হয়। ইয়াসিন পরিবারের ছোট হওয়ায় তখনও কোনো কাজে যুক্ত ছিল না। হত দরিদ্র পরিবার, সংসারে নুন আনতে পানতা ফুরায়। মা অন্যের বাড়ী কাজ করেন এবং এই আয় দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালান। মায়ের এমন কষ্ট দেখে ইয়াসিন আলী সিদ্ধান্ত নেন ঢাকা গিয়ে কিছু করে মাকে সাহায্য করার। অর্থনৈতিক অবস্থা শুধু মো: ইয়াসিন আলীকে নয় তার মাকেও ঢাকায় আনতে বাধ্য করে। একনজরে শহীদের পরিচয় নাম : মো: ইয়াসিন আলী শেখ জন্ম তারিখ : ১৬-১০-২০০৮ পিতা : মরহুম নুর ইসলাম শেখ মাতা : মনজিলা বেগম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: রহিম নগর, ইউনিয়ন: ৩নং নৈহাটি, থানা: রূপসা, জেলা: খুলনা পেশা : চাকরিজীবী (গ্যাস সিলিন্ডার ডেলিভারির কাজ করতেন) ঘটনার স্থান : যাত্রাবাড়ী আহত হওয়ার সময়কাল : ১৯ জুলাই বিকেল ৩টা শাহাদাতের সময়কাল : ২৪ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা আঘাতের ধরন : গুলির আঘাত আক্রমণকারী : পুলিশ শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : রহিমনগর, খুলনা কলোনি কবরস্থান প্রস্তাবনা ১. শহীদের মাকে ব্যাবসার পুঁজি হিসেবে এককালীন সহযোগিতা করা যেতে পারে